উম্মে রায়হানা: মহিলা ও শিশু বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান রেবেকা মোমেন বলেছেন, নারীর অশালীন চলাফেরা ও পারিবারিক শৃঙ্খলা না থাকার কারণে দেশে ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেছে।
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অন্তত আমি অবাক হইনি। তিনি কথাগুলো খানিকটা মোটা দাগে বলেছেন। এর আগে চিকন দাগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর চেয়েও ভয়াবহ কথা বলেছেন।
দাগটা চিকন বলে আমরা দেখতে পাইনি বা খেয়াল করিনি। প্রধানমন্ত্রীর দাগ কেবল চিকনই না, প্যাঁচানোও ছিল, সেই প্যাঁচ তিনি নিজের সুবিধামতো ব্যবহারও করেছেন।
আমি কী নিয়ে কথা বলছি তা হয়ত স্পষ্ট হচ্ছে না। ব্যাখ্যা করছি।
মহা আলোচিত তেঁতুল তত্ত্ব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী কী বলেছিলেন মনে আছে? সে সময়কার একটি লেখার কথা মনে পড়ে গেল। তুলে দিচ্ছি –
নারী বিষয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্য করার জন্য হেফাজতে ইসলাম নামের একটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের প্রধান শাহ আহমদ শফীর বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে নিন্দামন্দের ঝড় দেখতে পাচ্ছি।
গণমাধ্যমের একটা অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে কোন ঘটনা বা সামাজিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করার ক্ষমতা। এই ক্ষমতা যে গণমাধ্যম বা প্রচারমাধ্যম নিজ দায়িত্বে বা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে তা নয়। বরং বলা ভালো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। ভোক্তা অর্থাৎ পাঠক-দর্শক-শ্রোতার আগ্রহেও যে পরিবর্তিত হয় না– এমন কথাও বলা যায় না। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ব্যক্তির মতামত প্রকাশের সুযোগ এই পরিবর্তনকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। ফলে যেকোন ঘটনার গুরুত্ব আরও দ্রুত ওঠানামা করে।
শফী বিষয়ক উত্তেজনা অনেকটাই স্তিমিত হয়ে এসেছে পরপর আরও কিছু ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ঘটনা ঘটায়। যেমন-বিসিএস কোটা আন্দোলন,গোলাম আজমের রায়ের যথার্থতা, জামায়াতে ইসলামের রাজনীতি করার অধিকার, আশু জাতীয় নির্বাচন ইত্যাদি। কিন্তু শফী বিতর্কের শেষ তো আসলে হয়নি। এই চাপা পড়ে যাওয়া বিতর্ক ,পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করছি।
শফীর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করার দায়িত্ব বোধ করেননি এমন মানুষজন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাই বলে তার এই মতামতের পক্ষে যে কেউ নেই – এমনটা ধরে নেওয়া খুবই মুর্খামি হবে। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এই প্রতিবাদকারীদের নিয়েই। বলা ভালো প্রতিবাদকারী একজন প্রধান ব্যক্তির প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে।
সেটা বিস্তারিত বলার আগে একটু দেখি এই মন্তব্যের পক্ষে ও বিপক্ষে কি কি ধরনের আলোচনা এই পর্যন্ত পাওয়া গেছে।
হেফাজতে ইসলামের চারজন নায়েবে আমীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, শফীর বক্তব্য নতুন কিছু নয়, গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষদের ধর্মের নিয়মনীতি সহজ ভাষায় বোঝানোর জন্য এ ধরনের প্রচলিত উদাহরণ সবসময়ই ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
মজার ব্যপার হচ্ছে, এদেশে ধর্ম ও পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে কলম ধরে সবচেয়ে বেশী বিতর্কিত হয়েছেন যে লেখক, তসলিমা নাসরিন, তিনিও প্রায় একই রকম কথা বলেছেন। যদিও সম্পূর্ণ আলাদা অবস্থান থেকে।
তিনি বলেছেন …“ প্রতিদিন ঘরে-বাইরে মেয়েরা যৌনবস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। লোকটা এসব কথা না বললেও এভাবেই চলছিল সমাজ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার কারণেই তো চলছিল।… আল্লামা কিন্তু নতুন কোনও কথা বলেনি। সবার জানা কথাগুলোই বলেছে।”
যারা প্রতিবাদ করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন লেখক, শিক্ষক, আইনজীবী, এমপি, মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। এই প্রতিবাদকারীদের মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয়েই আছেন। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা ও দৃষ্টিকোণ একেক জনের এক এক রকম। সেটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এঁদের মধ্যে স্পষ্ট কিছু বিভাজনের রেখা লক্ষ্য করার মত।
যেমন-কেউ কেউ সম্পূর্ণ ‘রাজনৈতিক’ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে এই মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শফীর মন্তব্যের সমর্থনকারীদের ‘গণতন্ত্রবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
নারী ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, আহমদ শফীকে ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, তার এই বক্তব্য সংবিধান বিরোধী, কেননা সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে।
এই দুইজন মন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘রাজনৈতিক’ বলছি এই জন্যে যে, তাঁরা তাঁদের বক্তব্যের যুক্তি হিসেবে ধর্মে বা আল-কুরানে কি আছে না আছে তা নিয়ে কোন কথা বলেননি।
আবার কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মিডিয়াকেই দোষারোপ করেছেন। যেমন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সালমা আলী বলেছেন “…আমাদের বাবা, স্বামী, ভাই, বন্ধুরা যদি সবাই এমন হতো তাহলে পৃথিবী আজ এখানে আসতো না।…নারীর চরিত্র নিয়ে বারবার হেফাজত এভাবে আক্রমণ করে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দল এবং মিডিয়ারও দোষ রয়েছে এতে আমি মনে করি। মিডিয়া কেন হেফাজত ও শফীকে এতো কাভারেজ দিচ্ছে? কোথাকার, কোন শফী কি বললো, সেটা এটা ফলাও করে প্রচার করার কি আছে। নারী আজ তার যোগ্যতায়, দক্ষতায় এগিয়ে এসেছে, এগিয়ে যাবে, নারী কোন ভোগ্য পণ্য নয়…”
আরও দুইজন নারী আইনজীবী এ বিষয়ে প্রতিবাদ করেছেন। যেমন আইনজীবী এলিনা খান মনে করেন –‘এসব কথা কোনভাবেই ধর্মের কথা হতে পারে না’। ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ মাদ্রাসা শিক্ষার আড়ালে অসুস্থ মানুষ তৈরি হচ্ছে –এই বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
এছাড়াও প্রতিবাদ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ।
আমার আলোচনার উদ্দেশ্য এঁদের কেউ নয়। প্রত্যেকে নিজের নিজের অবস্থান ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে যে কোন অন্যায়ের, অপমানের প্রতিবাদ করবেন এটাই স্বাভাবিক। আগেই বলেছি একজন প্রধান ব্যক্তির প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করাতেই প্রসঙ্গের অবতারণা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী প্রতি অবমাননাকর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছেন। দেশের সব কয়টি সংবাদপত্রে এখবর প্রকাশ হয়েছে। তাঁর পুরো বক্তব্যের মধ্যে বেশ কিছু অংশ উল্লেখযোগ্য।
তিনি বলেছেন -ইসলামে নারীর সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে। একজন মুসলিম হিসেবে তিনি এ কথা বলতেই পারেন। যুদ্ধে যাবার অধিকার, পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে অধিকার, প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী – ইত্যাদি আরও অনেক উদাহরণ দিয়ে তিনি সম্মানের পক্ষে যুক্তিও দিয়েছেন। এসব যুক্তির পাল্টা যুক্তি থাকতে পারে,কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
কিন্তু তাঁর বক্তব্যের মধ্যে কিছু কিছু দিক আছে যা অত্যন্ত আপত্তিকর।
প্রথমত, তিনি বলেছেন-নারীনেত্রী ও নারী অধিকার কর্মীদের প্রতিবাদ করা উচিত। তাঁর এই কথা নিতান্তই হতাশাজনক,কারণ নারী কোন আলাদা জাতিগোষ্ঠী নয় যে, তাঁদের মান-অপমান অধিকার নিয়ে তাঁদেরই পথে নামতে হবে। আর বিষয়টা যদি এমনই হয় যে ‘নারীর প্রতি অবমাননাকর’ যে কোনকিছুতে নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে,তাহলে তিনি নিজে কেন এগিয়ে আসছেন না? তিনি তো দেশের সব চেয়ে ক্ষমতাধর নারী।
নারীরা যে কেউ চুপ করে বসে নেই, তার একাধিক উদাহরণ লেখার শুরুতে দিয়েছি। ফলে প্রধানমন্ত্রীর নারী সমাজের প্রতি আহবান ও উপদেশ মেনে নেওয়ার কোন কারণ দেখছি না।
উপরন্তু শফীর বক্তব্য তো কেবল নারী নয়, বরং পুরুষদের জন্য আরও বেশী অপমানজনক। নারীকে বস্তুর সঙ্গে তুলনা করলেও নারীর কোন মৌলিক প্রবণতাকে কলঙ্কিত করা হয়নি। তাদের অক্রিয় থাকতে বলা হয়েছে।
উল্টোদিকে পুরুষের স্বভাব বা আচরণকেই অনেক বেশী কলঙ্কিত করা হয়েছে। যেমনটা বলেছেন সালমা আলী ‘… শফীতো শুধু নারী নয়,পুরুষদেরও অপমান করেছে। আমি বুঝতে পারছি না,পুরুষরা কেন এর প্রতিবাদ করছে না, সেটাও এক প্রশ্ন আমার। প্রতিটি পুরুষকে সে লালসাময় ভাবে উপস্থাপন করেছে, কোনো পুরুষের কী এতে অপমানবোধ হয়নি?…’
দ্বিতীয়ত, তিনি ‘প্রত্যেকেই মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছে, ফলে নারীর সম্মান রাখতে হবে’ ধরনের দুর্বল যুক্তির অবতারণা করেছেন।
মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণের দায়ে পুরুষজাতি যদি নারীর প্রতি কামবোধ বিসর্জন দেয়, তবে তো মানব প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হতে বেশী সময় লাগবে না। নারীকে যদি ‘মাতৃত্বে’র বিনিময়ে ‘সম্মান’ কিনে নিতে হয়, মানুষ হিসেবে কোন স্থান না থাকে, সেটা নারীর জন্যে সমূহ বিপদের কথা। একথা শফীর কথারই প্রতিধ্বনি বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়।
তৃতীয়ত, তিনি আজকে নারী সমাজকে আহবান করছেন ধর্মীয় এই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। অথচ কিছুদিন আগে এই ধর্মীয় গোষ্ঠীকেই তিনি নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন যে, কুরান হাদীস বিরোধী কোন আইন পাস হবে না। কুরান ও হাদীসে যা আছে, তা যদি এই সময়, এই সমাজ, এই দেশের নারীর জন্যে যথেষ্ট হতো, তাহলে তো নারীনীতি প্রণয়নের কোন দাবী উঠত না। নাকি এ দেশের নারী সমাজ সম্পূর্ণ অকারণেই ‘নারীনীতি’ ‘নারীনীতি’ করে গলা শুকাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন?
চতুর্থত, তিনি বিরোধী দলীয় নেত্রীর সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গের অবতারণা করে বলেছেন ‘তিনিও কি তেঁতুল?’– এটা বলার সময় তিনি কি একবারও ভাবেননি যে, চরম অশ্লীল,অবমাননাকর ও নোংরা অস্ত্রটি শফী নারীজাতির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন, সেটাই তিনি ব্যবহার করলেন বিরোধী দলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে?
কখনও কোন প্রয়োজনে তাঁরও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করতে হতে পারে। আকাশে ছুঁড়ে ফেলা থুতু যেমন নিজের গায়েই লাগে, তেমনি অন্য নারীর প্রতি ব্যবহার করা তির্যক কথার এই তীর কি তাঁর গায়েও লাগবে না?