কালো মেয়ে ফরসা মেয়ে

Aparna 2সালেহা ইয়াসমীন লাইলী: সারারাত বিয়ে বাড়ির হৈ-হুল্লোড়, গান-বাজনা, ছুটাছুটিতে ক্লান্ত হয়ে ভোর রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এক বিছানায় একই বয়সী ছয়জন। পাট জাগানোর মতো করে গাদাগাদি শোয়া। সবার ঢুলু ঢুলু শরীর। কোন রকমে এক বালিশে তিনটা-চারটা মাথা রেখে ঘুম।

সকাল হওয়ার সাথে সাথে গ্লোরী আপা (ফুপাতো বোন) সবগুলাকে ঘুম থেকে টেনে হিঁচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে দিয়ে নিজে বিছানার মাঝখানে বসে কাঁদতে লাগল। কিছুই বুঝতে পারিনি তখন। কারণ জানতে চাওয়ারও সাহস হয়নি। বাড়ির সবাই চুপচাপ। পুরুষ সদস্যরা শুয়ে শুয়ে আছে। নারীরা আচঁলে চোখ মুচছে।

যে ঘরে গত দুদিন ধরে শহর থেকে সাজিকর এনে বাসর সাজানো হয়েছিল, সে ঘরের বিছানা ঘিরে বসে আছে পাড়া-পড়শি ভাবীরা। কারো মুখে কোন কথা নাই। শ্যামলী আপার (জ্যাঠাতো বোন) শরীরে তখনও বিয়ের শাড়ী, গয়না। চোখের জলে কাজল ধুয়ে ধুয়ে তার শ্যামল কপোলের রং আরো মলিন করে দিয়েছে।

একদিন আগেও আপার গায়ে হলুদের আগে আমাদের সবার হাতে আপা নিজেই মেহেদী পরিয়ে দিয়েছে। খুশিতে কী উচ্ছল ছিল আপার আনন্দভরা চোখ-মুখ। তার মিষ্টি স্নিগ্ধ হাসি ও উচ্ছলতায় ঢাকা পড়ে যেত তার শ্যামলিমা রুপ। বাড়ির অন্য মেয়েদের চেয়ে তার গায়ের রং মলিন। হয়তো এজন্যই তার নাম রাখা হয়েছিল শ্যামলী।

শ্যামলী আপা তখন এইচএসসি পাশ করে বাড়িতে ফিরেছে। আমি তখনও পঞ্চমে পড়ি। আপা পড়াশুনার পাশাপাশি অনেক বেশী দায়িত্বশীল হয়ে বড় হয়েছে। ছোট-বড় সবার সাথে সুমিষ্ট কথা বলতেন। হাসতে পারতেন প্রাণ শীতল করা।

এই বাড়িতে হৈ চৈ করার বাহানা লাগে না। তার উপর বাড়ির বড় মেয়ে শ্যামলী আপার বিয়ে। সবাই সবার আনন্দে মিশিয়েছে রং। আত্মীয় স্বজন এক বাড়িতে জড়ো হলো। তিনদিন ধরে বাবুর্চি রান্না করছে বড় বড় হাড়ি পাতিলে। গায়ে হলুদ হল একদিন আগে। পরদিন বিয়ে। বরের বাড়ি পাশের জেলায়। সরকারী কর্মকর্তা।

বরযাত্রী এসেছে বিকেলে। সন্ধ্যার পর বিয়ে হয়ে গেল। আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বরযাত্রীরা সবাই ফিরে গেল বরকে রেখে। আপাতত বরের বাড়িতে বউ তোলা হবে না, তাই এই বাড়িতেই বাসর। বর-বউকে ঘিরে নাচ, গান, বাদ্য-বাজনা শেষে দ্বিপ্রহরে তাদের বাসর ঘরে রেখে এলেন ভাবী ও দুলাভাইরা। সবাই যার যার মতো কাত হওয়ার জায়গা খুঁজে নিল। সবারই ক্লান্ত শরীর। তিন গ্রামের কুকুরগুলো উচ্ছিষ্ট খাবার হাড়গোড় নিয়ে কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে তখনও। আমরা কাজিনরা সবার আগে ঘুমিয়ে পড়লাম। আর ঘুম হলো কই গ্লোরী আপার উচ্ছেদ ক্রিয়ায়!

কেউ কিছুই জানাল না আমাদের। বুঝলাম ভয়ঙ্কর কিছু একটা হয়েছে। এতটা দুঃখী এই বাড়ির মানুষকে কখনও হতে দেখিনি। মরার বাড়ির চেয়ে মৌনতা অনেক বেশী। মানুষ মরে গেলে শোক প্রকাশের জন্য বাড়ির সবাই চিৎকার করে কাঁদে। কিন্তু কী এমন শোক যে কারো কান্না কেউ কাউকে দেখাচ্ছে না। শুধু শ্যামলী আপা কাঁদছে। আত্মীয়-স্বজন সবাই সকাল হওয়ার সাথে সাথে চলে যেতে থাকল। জ্যাঠাআব্বা ঘরের জানালা-দরজা ভেজিয়ে দিয়ে জায়নামাজে বসে মুখ আড়াল করে আছেন।

শ্যামলী আপার মুখেই অনেক পরে শুনেছিলাম। সে রাতে শ্যামলা মেয়েকে বউ হিসেবে পছন্দ হয়নি বলে বাসর ঘর থেকে চলে গেছে লোকটা। আপার কথামতো আর কোন যোগাযোগ করা হয়নি। আর বিয়েও করেননি আপা।

আপার চঞ্চলতা একটুও মলিন হয়নি আজো, যতটা মলিন হয়েছে সেই দুঃসহ স্মৃতিগুলো। পরিবার, আত্মীয়, পাড়া-পড়শি সবাই তাকে ভালবাসে। যদিও আপা হেসে হেসেই বলে ‘শ্যামলা মেয়েকে কেউ অপছন্দ করে, আবার কেউ করুণা করে ভালবাসে!’

মেজ বোন বিজলী আপা। শ্যামলী আপার উল্টো। দেখতে ফর্সা, সুন্দরী ও শান্ত চুপচাপ। কারো সাথে মিশতে পারে না সহজে। সর্বদাই নিজেকে দ্বিধাক্রান্ত করে রাখে। ভয়ে ভয়ে থাকে। যেন সুন্দর হওয়াই তার অপরাধ।

এই বাড়ীর বড় মেয়ের বিয়ের শোক কাটতে না কাটতে মামাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হল বিজলী আপার। স্বামীর সংসারে দুই সন্তানের মা যখন সে, তখন তার স্বামী একটা দুর্ঘটনায় অসুস্থ হযে বিছানায় পড়ে গেলেন। আর দীর্ঘমেয়াদী এমন অসুস্থতার জন্য চাকরিটাও চলে গেল। চিকিৎসা সামলাতে হিমশিম অবস্থা সংসারের। সুস্থ তাকে করতেই হবে। কিন্তু কোন আশা দেখাতে পারছিল না ডাক্তার। স্বামীর জন্য ডাক্তার, হাসপাতাল, সন্তানদের জন্য স্কুল, হাট-বাজার, উপার্জনের জন্য একটা ছোট চাকরি জোগাড় করে সামলাতে সারাক্ষণ ছুটতে থাকতে হয় বিজলী আপাকে।

এবার সংকটটা আরো প্রকট হয়ে গেল। স্বামীর চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করাকেও কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। অসুস্থ স্বামীকে ঘরে ফেলে চাকরি করাটাকেও লোকে সন্দেহ করে। রাত-বিরেতে বাসার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হলে তো স্পাই লেগে যায় পিছু। অফিস থেকে ফেরার সময় নুন চাল তেল, বাচ্চাদের খাবারের পাশাপাশি স্বামীর ওষুধ পথ্য কিনে ঘরে ফিরেও শান্তি পায় না। শাশুড়ি ননদ মিলে স্বামীকে ফুসলিয়ে বিষিয়ে রেখে দেয় তার অজ্ঞাতে। পাড়াপড়শি দেবর ভাসুররা, এমনকি বাবাতুল্য অনেকেই কু-ইঙ্গিত করে সহায়তার হাত বাড়াতে এসে ফিরে যায়। তারাই শাশুড়ি ননদকে উসকিযে দেয়। অফিসে একটা নতুন কাপড় পরে গেলেও কলিগরা খোটা দেয়। ঘরে চুলটা আঁচড়াতে দেখলেই বিছানায় পড়ে থাকা স্বামীও বলে, এতো সেজে-গুজে বের হওয়া কেন? পাগল, পাগল লাগে তার নিজেকে। মরে যেতে মন চায় তার। সংসারের কেউ এতটুকু দায় নেয়ার না থাকলেও খোটা দেয়ার মানুষরা চারদিকে ওঁৎ পেতে থাকে।

এক সময় স্বামীর চিকিৎসার জন্য সর্বস্বান্ত হয়েও তাকে বাঁচানো গেল না। একদিন অফিস থেকে ফিরে এসে দেখেন স্বামী টয়লেটে পড়ে মরে আছেন। শাশুড়ি-ননদ কেউ খেয়ালই করেননি। কিন্তু এই মৃত্যুর জন্য বিজলীকে দায়ী করা হয়।

বিজলী বলে, সুন্দর শরীর খুব বেশী জ্বালায়। তাদের সন্দেহ করে সবাই, করে ঘৃণাও। যতই ভাল হোক না নেই মেয়ে, তার স্বস্তি নাই।

সাংবাদিক ও লেখক

শেয়ার করুন: