শিতাংশু গুহ: আমাদের দেশে মেয়েদের বয়স নাকি বলতে মানা। আর বিয়ের বয়স? ওটা ‘দেবা ন জানন্তি কুত মনুষ্যা!’ তবে দেশে আইন আছে, মেয়েদের ১৮-এর আগে বিয়ে দেয়া যাবে না। শহরে-গঞ্জে বা যারা লেখাপড়া করছেন, ১৮-এর আগে তাদের বিয়ে হয়ও না, সেটা আইনের জন্য নয়, এমনিতে বাবা-মা দেন না। গ্রামের কথা অবশ্য ভিন্ন, ১৮-এর আগে হাজারো নারীর বিয়ে হয়, আইনের তোয়াক্কা কেউ করে না।
বাংলাদেশ যেখানে আইন না মানাই ‘আইন, সেখানে মেয়েদের বিয়ের বয়স নিয়ে একটি আইন আছে, ধারণা করি গ্রামের মানুষ তা জানেই না। ওটা এমন একটি আইন যা নিয়ে কারো কখনো মাথাব্যথা ছিল না। এখনো আছে তা নয়। তবে অধুনা সরকার এ আইনটি পরিবর্তন করতে চাচ্ছে, এ জন্য অনেকের মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেছে।
ইউনিসেফের মতে, বাংলাদেশ বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে নাইজেরিয়ার পরেই অর্থাৎ সেকেন্ড। সরকার মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৫ করতে চায়। এ আইনের প্রভাব কি তা বলা মুশকিল, কিন্তু বিশ্বের কিছু নেতারা এক খোলা চিঠিতে ইতোমধ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন যাতে আইনটি পরিবর্তন করা না হয়। ঢাকার কাগজেও এটা ছাপা হয়েছে। ‘এলডারস’ নামে একটি সংগঠনের প্রধান সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনান এ আহ্বান জানিয়েছেন। রয়টার্স জানাচ্ছে, ‘এলডারস’-এর ওয়েবসাইটে ওই চিঠিটি আছে। নেলসন ম্যান্ডেলা এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং নোবেল বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু; সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বা আইরিশ প্রেসিডেন্ট রবিনসনের মতো বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিরা এর সঙ্গে যুক্ত। খোলা চিঠিতে ‘এলডারস’ বলেছে, এর ফলে মেয়েদের উন্নয়নে বিঘ্ন ঘটাবে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।
হঠাৎ করে সরকার মেয়েদের বিয়ের বয়স পাল্টানোর আইন করতে উদ্যোগী হলো কেন? এটা কি কোনো জরুরি ইস্যু? নাকি, ‘নাই কাজ তো খই ভাজ’। এ যুগে বিয়ের বয়স বাড়ানো যেতে পারে, কমানোর যুক্তি কি! আর বিয়ে তো হরদম হচ্ছে, আইন কেন? এর পেছনে মৌলবাদীদের কোনো এজেন্ডা নেই তো? কদিন আগে প্রায় পুরো বাংলাদেশ একদিন অন্ধকারে ছিল। ঢাকা থেকে একজন জানতে চাইলেন, ‘দাদা, এটা জামাতের কারসাজি নয়তো? বললাম, কেন? তিনি বললেন, মৌলবাদীরা একদিনে ৫শ বোমা ফাটাতে পারে, কাজেই ওরা একসঙ্গে পুরো বাংলাদেশও অন্ধকার করে দিতে পারে! যুক্তি অকাট্য। আসলেই ওরা পারে, বিয়ের বয়স কমানোর পেছনেও ওরা থাকলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ এ ডিজিটাল সরকার উল্টোদিকে হাঁটতে পারে না। ছোটবেলায় আমাদের ভয় দেখিয়ে বলা হতো, ‘ভূত পেছন দিকে হাঁটে’। বাংলাদেশ তো ভূত নয় যে পেছন দিকে হাঁটবে!
ব্যারিস্টার শফিক আইনমন্ত্রী থাকতে হিন্দু মেয়েদের বাপের সম্পত্তি দেয়ার লক্ষ্যে একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্যোগটি ভালো। ভারতে এ আইনটি আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ভারত নয়, তাই আইনটি হয়নি। কারণ সরকার জেনেছে, হিন্দুরা এর পক্ষে নয়। তাহলে কি হিন্দুরা চায় না তাদের মেয়েরা বাপের সম্পত্তি পাক? নারী নেত্রী রাখী দাশপুরকায়স্থ আমেরিকা এলে এ নিয়ে অনেকের সঙ্গে বসেছিলেন। তাকে যেটা বোঝানো হয়েছে, তাহলো সবাই এ আইনের পক্ষে, যদি না তাতে একটি ক্লজ থাকে যে, ‘অন্য ধর্মে বিয়ে হলে মেয়েটি তার সম্পত্তির ওপর অধিকার হারাবেন’। তাকে আরো যা বোঝানো হয়েছিল তাহলো, ‘নইলে তো রাজকন্যা ও রাজত্ব’ দুটিই যাবে। আসলে ব্যারিস্টার শফিক বা রাখিদি দুজনেই বামপন্থী, তাদের চিন্তাধারাও স্বচ্ছ, কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন। এ আইনটির কোনো মেরিট ছিল না; যেমন মেরিট নেই মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানো আইনের।
যুক্তরাষ্ট্রে মেয়েদের বিয়ের বয়স কত? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, পুরো আমেরিকায় প্রায় সব স্টেটে সেটা ১৮। তবে নাব্রাস্কা ও মিসিসিপিতে তা যথাক্রমে ১৯ ও ২১। অধিকাংশ স্টেট বাবা-মা ও বিচার বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে ১৬ বছরের মেয়েদের বিয়ের পক্ষে। যদিও কোনো মেয়ে অন্ত:সত্ত্বা হয়ে পড়লে কোনোরকম অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করতে বয়সের কোনো বাধা নেই। যে দেশে ছেলে-ছেলে বা মেয়ে-মেয়ে বিয়ে হচ্ছে, অথবা বিয়ের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্ক চলছে, সেখানে বিয়ের বয়স কোনো বিষয়ই নয়।
আমরা যারা বা আমাদের দেশে বিয়ে বলতে আমরা যারা বুঝি ‘দুটি সাবালক ছেলেমেয়ের’ মিলন, সেখানে সাবালিকার বয়স কমিয়ে নাবালিকা করার কোনো মানে হয় না। ‘এলডারস’ কি বলেছে তৎজ্জন্য নয়, আমাদের দেশের মানুষও সম্ভবত নাবালিকা বিয়ের বিপক্ষে। সুতরাং আইনটি বদলানোর কি কোনো প্রয়োজন আছে? অন্তত প্রয়োজনটা তো এমন জরুরি নয় যে, আইন করে দেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসিত্ব’ ঘুচিয়ে দিতে হবে!
শিতাংশু গুহ, কলাম লেখক, নিউইয়র্ক