শরিফুল হাসান: আমি সেদিন চমকে উঠেছিলাম। ঘটনাটা ২০০২ সালের পূজার সময়। আমরা জহরুল হক হলের প্রথমবর্ষের বন্ধুরা দলবেঁধে পূজা দেখতে গেছি ঢাকেশ্বরীতে। প্রচণ্ড ভীড়। হঠাৎ করে দেখলাম আমাদের বন্ধুদের দলে থাকা একজন ভীড়ের মধ্যে একটা মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে। ঘেন্নায় আমার গাটা রি রি করে উঠলো। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি এই কাজ কীভাবে করলা? সে হাসতে হাসতে বলে মজা করার জন্য।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কোনদিন আর সেই ছেলেটির সঙ্গে মিশিনি। তবে শুনেছি সেই মেধাবী ছাত্রটি মাদক নিতে নিতে শেষ হয়ে গেছে।
প্রথমবর্ষে থাকাকালেই আমি সাংবাদিকতা করি। বিকেলের পরই আমি পত্রিকা অফিসে চলে আসতাম। রাতে হলে গিয়ে বন্ধুদের কাছে গল্প শুনতাম-সন্ধ্যায় নাকি বিভিন্ন হলের প্রথমবর্ষের ছেলেরা মিলে কলাভবনে বহিরাগতদের লাঞ্ছিত করেছে। অতি সাহসী কেউ কেউ নাকি এই ফাঁকে মেয়েদের গায়েও হাত দিয়েছে। একই কাজ তারা করতো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে। আমি শুনতাম আর গা গা রি করতো। আমি ভাবতাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এতো বিকৃত রুচির হয় কী করে? এরা কী বাড়ি থেকে কিছুই শিখে আসেনি? আমি প্রতিবাদ করতে গেলে তারা একই কথা বলতো এটা মজার জন্য। এই দলে একজন ছিলো যে প্রতিটা ঘটনায় নেতৃত্ব দিতো। শুনেছিলাম বায়তুল মোকারমের সামেন কোন একদিন নাকি তাকে হকাররা পিটিয়েছিল।
কথাগুলো বলছি ৫ নভেম্বর শহিদুল্লাহ হলের সামনে যা ঘটেছে তাই নিয়ে। আমি জানি কেবলমাত্র আমাদের ব্যাচে নয় প্রতিব্যাচেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া হাজার সাতেক ছেলেমেয়েদর মধ্যে অন্তত একশ থাকে যারা বিকৃত রুচির। এদের বেশিরভাগই আবার যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই দলের রাজনীতি করে। এদের কাজ হলো ক্যাম্পাসে বহিরাগতেদর সঙ্গে অশোভন আচরণ, মেয়েদের কটুক্তি করা, পারলে গায়ে হাত দেয়া। দেশের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া একজন ছাত্র যদি এই কাজ করে তাহলে দেশটা কোথায় যাবে? কেউ কেউ হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন, বহিরাগতরা এসে ক্যাম্পাসে অশালীন আচরণ করে, তার কী হবে?
সেক্ষেত্রে আমার বক্তব্য হলো- সেটা দেখার জন্য তো প্রশাসন আছে। প্রশাসনকে জানান। আর যদি আপনি মনে করেন আপনার চোখের সামনে কোন অশ্লীল কাজ হচ্ছে, প্রতিবাদ করা দরকার-তাহলে খুব সুন্দর করে ছেলেটিকবে ডেকে সেই কথা বলুন। দেখবেন সে চলে যাবে। এরপরেও না গেলে প্রক্টরকে জানান। কিন্তু দয়া করে আপনি বীর সাজতে গিয়ে কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে মজা করতে গিয়ে কিছু করবেন না।
আমি সবসময় বলি পুরুষ মানেই পশু এবং খুব কম পুরুষই মানুষ হতে পারে। আর যে পুরুষ মানুষ হয়েছে সে কখনো কোনদিন কোন মেয়েকে কটুক্তি করতে পারে না, কারো গায়ে হাত দিতে পারে না। আচ্ছা যারা এসব করে তারা কেন একবারও ভাবতে পারে না আমার বোন বা মেয়েও তো কোনদিন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে এবং তারাও একই ঘটনার স্বীকার হতে পারে! আমরা ছেলেরা যদি কেবল এটা ভাবি যে এই মেয়েটা আমার বোন হতে পারতো কিংবা আমার স্ত্রী তাহলেই আর কখনো কোন ছেলের পক্ষে এমন করা সম্ভব হতো না। যেসব ছেলেরা এসব করেন একটু বিবেকমান হন প্লিজ। আমরা সব ছেলেরা ভালো হলে এই দেশে আর কখনো কোন মেয়েকে কষ্ট পেতে হবে না। নতুন একটা বাংলাদেশ পাবো আমরা।
আরেকটা কথা-যারা এসব কাজ করে বেশিরভাগ সময়েই তারা প্রথমবর্ষের ছাত্র। হলের ছাত্রনেতারা প্রথমবর্ষের ছেলেদের এমন একটা ধারনা দিয়ে দেন-যে তারা ক্যাম্পাসে যা খুশি করতে পারে। সিনিয়র ছাত্রনেতাদের কাছে অনুরোধ-দয়া করে প্রথমবর্ষের ছাত্রদের বলবেন-কারো গায়ে হাত তুলবে না। কেবল ছাত্রনেতা নয়, আমি মনে করে হলে বা ক্যাম্পাসে থাকা সিনিয়রদেরও এ ব্যাপারে ছাত্রদের ধারণা দেয়া উচিত। একইসঙ্গে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকদের উচিত প্রথমবর্ষের ছাত্রদের বিবেক জাগ্রত করা এবং বলা, এ ধরনের অপরাধ করলে তোমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার হতে পারো।
সবাইকে জানাতে চাই-শহিদুল্লাহ হলের সামনে যেসব ছেলে সেদিন ইমতিয়াজ আলম বেগ ও তাদের স্বজনদের লাঞ্ছিত করেছিলো সেই চারজনকে ইতিমধ্যেই আইডেনটিফাই করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আশা করি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। আমি মনে করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে যারা এসব অপকর্ম করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমুর্তি নষ্ট করে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করে দেয়া উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিও পড়েছি। এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সারাদেশে ঘুরে বেড়াই। রাস্তাঘাটে কোন সুন্দর মেয়ে দেখলে আমিও তাকাই। কিন্তু কোনভাবেই মেয়েটা যেন বুঝতে না পারে আমি তাকে বিরক্ত করছি বা অশোভনভাবে তাকাচ্ছি। অহঙ্কার করে বলতে পারি, আজ পর্যন্ত কোনদিন কোন মেয়েকে কটুক্তি করিনি। এ জীবনে কোনদিন করবোও না। তারপরেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র হিসেবে আমি ইমতিয়াজ আলম বেগসহ তাদের সবার কাছে ক্ষমা চাইছি যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কোন না কোনভাবে, কখনো না কখনো কষ্ট পেয়েছেন। প্লিজ আপনারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভুল বুঝবেন না।
সবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব ছাত্র এবং ছেলেদের জন্য আমার একটাই কথা-অন্যায়ের প্রতিবাদ করুন। সেজন্য দরকার হলে মারামারি করুন। কিন্তু বিনা কারণে অন্যকে আক্রমণ করবেন না। মেয়েদের কটুক্তি করবেন না। কেবলমাত্র মজা করার জন্য বহিরাগত উচ্ছেদের নামে কাউকে লাঞ্ছিত করবেন না। প্লিজ নিজেকে সংযত করুন। চলুন সবাই মিলে আমরা আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমুর্তি সমুন্নত রাখি। চলুন আমরা সবাই মানুষ হই। মানুষ হওয়ার চেষ্টা করি।
লেখক: সাংবাদিক