
ফারহানা রহমান: আমাদের সমাজে নারীর পুরো জীবনকালের কোন পর্বই কখনই অনুকূল নয়। জন্ম থেকে শুরু করে, যতদিন বেঁচে থাকা, ততদিনই কোন না কোন দায়িত্ব পালন করেই যেতে হয় নারীকে। সেখানে নিজের বলে কিছু আর থাকে না। নিজেকে দেখার, নিজেকে চেনার, নিজেকে ভালবাসার বিষয়টি তো সুদূর পরাহত।
হাতে গোনা কিছু পরিবার ছাড়া নারীর জন্মকেই সানন্দে মেনে নিতে পারে না এমন মানুষের অভাব নেই এ সমাজে।
শিশুকাল থেকেই নানা নিষেধাজ্ঞার বেড়িতে বাঁধা হয় নারীদের জীবন। পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে খেলাধুলা করা, গাছে ওঠা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, হৈ হুল্লোড় করা, বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা দেওয়া, সব ব্যাপারেই নারীদের উপর নানান ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকে।
একটি মেয়ে সাবালিকা হওয়ার পর পরই অপেক্ষাকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর একমাত্র চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কি করে যৌতুকের টাকা জোগাড় করে মেয়েটাকে পাত্রস্থ করবে। আর এর পরপরই এদের উপর সন্তান উৎপাদনের জন্য চাপ দেওয়া হতে থাকে। এক সন্তান নয় দুই তিন বা তারও অধিক সন্তান জন্ম দিতে না পারলে এরা নিরাপত্তাহীনতায় ভূগতে থাকে। আর যতদিন না একটা ছেলে সন্তানের জন্ম দেয় ততদিন তো তার আর নিস্তার নেই। এসব দরিদ্র নারীকুল সন্তান জন্ম দেওয়া ও তাদের লালন পালন করা, আবার সেইসব সন্তানদের বিয়ে দেওয়া আর নাতি-নাতনি পালনের মাধ্যমেই অতি সহজেই অল্প বয়সেই বার্ধক্যের জীবন মেনে নেয়। জীবনের বিশালত্ব সম্পর্কে এদের কোন ধারণাই হয় না ।
অন্যদিকে দরিদ্র পরিবারের খুব কম পুরুষকেই সংসারের সকল দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে দেখা যায়। এ শ্রেণীর বেশীর ভাগ পুরুষকেই দেখা যায় নামে মাত্র সাংসারিক খরচ দেওয়ার পরই তারা ব্যস্ত হয়ে পরে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডাবাজি, তাস খেলা, জুয়া খেলা ইত্যাদি কাজে সময় কাটাতে।
সেইদিক থেকে শিক্ষিত পরিবারের মেয়েদের জীবন অধিকতর সুবিধাজনক স্থানে। স্কুল কলেজের নানা বিচিত্র ঘটনা আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে কাটানো উচ্ছল বাঁধ ভাঙ্গা গতিময় সময়গুলো এদের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সুখস্মৃতি হয়ে থাকে অনেকের জীবনে। তবে সব চাইতে সৌভাগ্যবতী সেইসব নারী, যারা নির্বিঘ্নে স্কুল কলেজ আর সেইসাথে ইউনিভার্সিটির জীবনটাও উপভোগ করতে পারে কোন রকম পিছুটান না রেখেই।
তবে দরিদ্রই বলুন আর ধনীই বলুন, বেশীরভাগ পরিবারেই নারীর মেয়েবেলা বা নারীবেলা বা একজন শুধু নারী হিসেবে কাটানোর সময়কাল অল্পেই শেষ হয়ে যায়।
ধনী পরিবারগুলোতেও অধিকাংশ মেয়ের জীবনকাল একান্তভাবেই সংসার স্বামী-সন্তানদের সুখ-সাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই কেটে যায়। তখন তাঁর ভুমিকা হয় কারো স্ত্রী বা কারো মা অথবা কারো বউ মা হিসেবে দায়িত্ব পালন। অনেকের আবার এর সাথে যোগ হয় কর্মজীবন। তাদের জীবন হয়ে ওঠে আরও ঝক্কি ঝামেলাময়। সংসার স্বামী সন্তান সামলাও, কর্মস্থল সামলাও, আত্মীয় স্বজন সামলাও, সামাজিকতা কর। এই করতে করতেই সময় কেটে যায়, নিজের বলে তখন আর এক মুহূর্ত সময়ও থাকে না।
আর মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দেয় যখন সাজানো সংসারটা ভেঙ্গে যায়, স্বামী-স্ত্রীর পক্ষে যখন একই ছাদের নিচে বাস করা যখন অসম্ভব হয়ে ওঠে। সন্তান সংসার আর কর্মস্থলের সমস্ত ঝামেলা যখন একা এক নারীর উপর এসেই বর্তায়, তখনই সে হয়ে ওঠে সমাজের চক্ষুশূল। এদের জীবন যাপনের উপর সমাজের এক অলিখিত অধিকার জন্ম নেয় যা তাদের জীবনকে সমূহ যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সামাজিক এই ঘেরাটোপের মধ্যেই বন্দি হয়ে জীবন কাটিয়ে দেয় বেশীরভাগ নারী।
সেই তুলনায় পুরুষদের জীবন অধিক আনন্দদায়ক হতে পারে। পুরুষরা বিবাহিত জীবন আর কর্মজীবন সামাল দিয়েও বন্ধু -বান্ধবকে সময় দিতে পারে। সেইসাথে ক্লাবে সময় দেওয়া বা নানারকম পার্টিতে বা মিটিংয়ে সময় দেওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়। ফলে তুলনামূলকভাবে অধিক কাল পর্যন্ত তাদের পুরুষ কাল ধরে রাখা সম্ভবপর হয়।