সবাই সচকিত হলে নিরাপদ হবে নগরী

Jasmine-Image
মাহফুজা জেসমিন

মাহফুজা জেসমিন: সপ্তাহব্যাপী জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের মাঝখানে গতকাল ছিলো আশুরার ছুটি। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। যানবাহন যা আছে তা অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে কম। তবে বাসে ভিড় নেই।

রাত সাড়ে নয়টা। মিনিবাসটিতে ১৫ থেকে ২০ জন যাত্রী। হেলপারকে জিজ্ঞেস করতেই বললো গুলিস্তান যাবে। রাতের পথচলাকে নিরাপদ করতেই ছয় বছরের মেয়ের হাত ধরে সন্তর্পণে বাসে উঠে বসলাম। আগাঁরগাও থেকে পুরানা পল্টন যেতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। অন্যদিন হয়তো এতো রাতে সিএনজি বা ট্যাক্সি ডাকতাম। কিন্তু গল্পে গল্পে ট্যাক্সি ডাকতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাছাড়া হরতালের আগের রাতটাতে সিএনজিকেও ভরসা করতে পারলাম না। ভিড় কম বলেই বাসে ওঠার সিদ্ধান্ত নেই।

প্রায় কোন রকম সিগনাল ছাড়াই কারওয়ান বাজার পৌঁছাই। হঠাৎ দেখি বাসের সব যাত্রী দাঁড়িয়ে। আমি পেছনের দিকে বসা ছিলাম। গাড়ির সামনের দিকটা খালি হতে দেখে ড্রাইভারের পেছনের মহিলা সিটটায় বসি। এতে মনে হলো কন্ট্রাকটর একটু বিরক্তই হলেন। আমি বললাম, নামতে সুবিধা হবে। কিন্তু তখনও আমি বুঝতে পারিনি, তখন সামনের সিটটায় না বসলে কত বড় বিপদেই না আমাকে পড়তে হতো।

হঠাৎ দেখলাম, সবাই নেমে যাচ্ছেন। আমরা ছাড়া আর দু’জন যাত্রী। তাদের নামতে বলছেন ড্রাইভার, কন্ট্রাকটর, হেলপার। কিন্তু গাড়ি থামাচ্ছেন না। আমি বললাম কেন? বললো, এ গাড়ি গুলিস্তান যাবে না। মিরপুর ফিরে যাবে। আমি বললাম, ঠিক আছে টাকা ফেরত দেন, গাড়ি থামান, নেমে যাই। কনট্রাকটর টাকা ফেরত দিচ্ছে না, ড্রাইভার গাড়ি থামাচ্ছে না। আর হেলপারকে যতই বলছি গাড়িটা থামাতে, সে থামাতে না বলে অপর যাত্রীর সাথে মারামারি শুরু করলো। আমি নামার জন্য গেটের দিকেও যেতে পারছি না। আমার মেয়েটা ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছিলাম আমিও। গিয়েছিলাম নাতি’র জন্মদিনের অনুষ্ঠানে। শাড়ি পরে বের হয়েছিলাম। এ মুহূর্তে মনে হলো, শাড়িটাই কাল।

গাড়িটাকে যতই থামাতে বলি গাড়িটা থামে না। মনে মনে ভয়টা প্রকট হচ্ছে–সেসময় অন্য যাত্রীটির মনে হয় বোধোদয় হলো যে আমাকে নামতে দেয়া উচিত। তিনি কন্ট্রাকটরের সাথে হাতাহাতি করতে করতেই আমাকে নামার পথ করে দিলেন। ততক্ষণে গাড়িটা স্টপেজ ছেড়ে সার্ক ফোয়ারার চত্বর ঘুরছে। আমার ভয় আরো প্রবল হলো। প্রাণপণে মেয়েকে নিয়ে গেট দিয়ে নামতে নামতেই  আমার চোখ ট্রাফিক পুলিশ খুঁজছে।

আমি পুলিশকে হাত দিয়ে কাছে আসতে ইশারা করলাম। আমি যখন নেমে পড়েছি, তখন পুলিশ আসলেন। কিন্তু গাড়িটা ততক্ষণ চলে গেছে! ট্রাফিক একটু দূরে থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, কেন ডাকছিলেন? আমি বললাম, ওই গাড়িটা ধরার জন্য। পুলিশ একবার গাড়ির চলে যাওয়া পথের দিকে উদাস চোখে তাকালেন। তারপর কিছু না বলেই যেমন ধীর পায়ে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এসেছিলেন, তেমনি ধীর পায়ে আগের জায়গাটিতে গিয়ে দাঁড়ালেন।

তখন আমি হতবিহ্বল। আমার মেয়েটাও। কোনরকমে আমার হাত ধরে রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডের ওপর দাঁড়ালো। আর আমি তখন সোনারগাঁও হোটেলের পশ্চিম পাশের রাস্তায় সারি বেধে দাঁড়িয়ে থাকা রিক্সাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছি রাস্তাটা পার হয়ে বাকি পথটুক কিসে যাবো। বাসে না রিক্সায়? অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে তবে রাস্তা পার হলাম। রাস্তাঘাট ফাঁকা বলেই হয়তো ট্রাফিক সিগন্যালের বালাই নেই। সেই পুলিশ সেখানেই দাঁড়িয়ে। আমার আর ইচ্ছে হলো না তার কাছে কোন সাহায্য চাওয়ার।

রাস্তা পার হয়ে আবার বাসেই উঠলাম। বাসে খালি সিট যা আছে তা একেবারে পেছনে। কিন্তু আমি আর পেছনে বসার সাহস পেলাম না। কষ্ট করে ইঞ্জিন কভারের সাথের সিটটার ওপর বসলাম। অন্য যাত্রীরা একটু হয়তো অবাক হলেন। আমার মেয়েও আর বসতে চাইলো না। সারাটা পথ গেটের কাছে শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে আমি পল্টন মোড়ে এসে নামলাম।

বাকি পথটুক আমি ভয়ানক এক অস্বস্তি নিয়ে কাটালাম। এমনকি বাসায় ফিরেও স্বাভাবিক হতে পারছি না। কিন্তু কাউকে কিছু বললাম না। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্তও আমি নিজেকে ঘটনা থেকে সরাতে পারছিলাম না। কিইনা হতে পারতো ওই বাসটি যদি মিনিটের জন্য না থামতো ওখানে। এই শহরতো বিপদে ভরা। এই এক কোটি মানুষের শহরে পথে-ঘাটে একজনের বিপদে আরেকজন পাশে দাঁড়াতে ভয় পায়। অনেক ভালোমানুষের মধ্যেও ঠগবাজি, জোচ্চুরি, অপরাধ, মাদক এগুলোর প্রভাব এতো প্রবল যে মানবতা বার বার পরাজিত হয় আত্মরক্ষার স্বার্থে।

কাল যদি আমি না নামতে পারতাম! এরপর আমি আর ভাবতে পারি না। কিন্তু আমি যদি জানি এই শহরে কোন বাস লাইসেন্স ছাড়া চলবে না, যেখানে-সেখানে রুট চেঞ্জ করতে পারবে না, কেউ যেখানে-সেখানে বাস থামাতে পারবে না, আর এসবের অমান্য করলে তার শাস্তি অনিবার্য, তাহলে হয়তো আমি অন্যদের নিশ্চিন্তে চলতে বলবো।

গত মাসজুড়ে আন্তর্জাতিক  মেয়েশিশু দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন এ্যাসাইনমেন্ট কাভার করতে গিয়ে নানাজনের অভিজ্ঞতা শুনে শিউরে উঠছিলাম। আর তাদের নিরাপত্তার জন্য সরকারের মন্ত্রী, নগরের মেয়র, আর মানবাধিকার কর্মীদের ক্যাম্পেইনের কথা শুনে শুনে আশ্বস্ত হয়েছি। কিন্তু তখন ভাবিনি সত্যিকার অর্থেই এরকম একটি পরিস্থিতিতে একটি মেয়ে কি করতে পারে? আমি নিজেও দুই যুগের বেশি সময় ধরে ঢাকায় এসেছি। প্রথম দিন থেকেই একা পথ চলা শুরু। অনেক পরিজন, সহপাঠি, বন্ধু, সহকর্মীভরা শহরেও বেশির ভাগ সময় পথের দায়িত্বটা নিজেই নিয়েছি।

এই শহরের একজন বহিরাগত হিসেবে যেদিন প্রথম এসেছিলাম সেদিনও ছিলো রিক্সা ধর্মঘট। অচেনা শহরে আসাদ গেইট নেমে রিকশা  পেয়ে হেঁটেই খুঁজে বের করেছিলাম রাজিয়া সুলতানা রোডে বড় ভাইয়ের বাসাটা। সেদিন ঠিক পথটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক ভেবেচিন্তে একজন পথচারিরই সাহায্য নিয়েছিলাম।

কিন্তু আজ সাহায্য চাওয়ার সুযোগ নেই। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে ভয় পায়। কোনটা সত্যিকারের বিপদ। কিন্তু যেকোনো ঘটনায় একপক্ষ তো অন্তত: ভিকটিম। একথাটা মনে রাখলে, আমাদের অবশ্যই কিছু না কিছু করার আছে। এজন্য সবার জন্য সবার সচকিত হওয়া দরকার।

মাঝরাতে একটি খালি বাসে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে…কথা বলার চেষ্টা করছে। কিংবা ধীরে চলা গাড়িতে দু’জন মানুষ দরজায় দাঁড়িয়ে মারামারি করছে। এরকম দৃশ্য কী কোন পথচারির চোখে পড়বে না? তখন পথচারির কি দায়িত্ব? কেন ট্রাফিক পুলিশ আরো বেশি দায়িত্বশীল হবেন না? কেন রাস্তায় চলতে চলতে একটা জটলা দেখলে আমরা কেবল ভিড় বাড়াই? কেন মারমুখো দু’জন মানুষকে ছাড়িয়ে নিয়ে আইনের কাছে তুলে দেয়ার সুযোগ আমাদের থাকে না? কেন পরিবহন খাতকে অপার স্বাধীনতা দিয়ে রাখা হবে- যাতে তারা যা খুশি তাই করতে পারে? আমি জানি এই ‘কেন’গুলো নতুন নয়। কিন্তু এই কেনগুলো বদলাতে হবে আমাদেরকেই। আমাদের সচকিত হতে হবে যেকোন অসমঞ্জস দৃশ্যপট কিংবা পরিস্থিতি কিংবা শব্দ শুনলেই। না হলে আমরা কেউ নিরাপদ নই।

গতকাল খুব মনে হয়েছিলো, আমি কেমন করে মানুষকে জানাবো যে, আমি বিপদে পড়েছি? তারপর বারবারই তথ্যমন্ত্রীর ‘বাঁশি তত্বে’র কথা মনে হচ্ছে।

গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীর স্প্রেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টারে এ্যাকশন এইড আয়োজিত ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী’ ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু নারীদের আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে অনেকগুলো উপায়ের কথাই বলেছিলেন। তার মধ্যে, পথ চলতি প্রত্যেক নারীর হাতে একটি করে ‘বাঁশি’ রাখারও পরামর্শ দেন।

তিনি ওই অনুষ্ঠানে বলেন, “ যদি আপনাদের হাতে একটি করে বাঁশি থাকে, পথে ঘাটে বিপদে পড়লে  সেই বাঁশিটি বাজিয়ে আপনারা সাহায্য চাইতে পারেন। যার কানেই বাঁশির শব্দ যাবে, তিনিই বুঝতে পারবেন কোন নারী বিপদে পড়েছেন”।

কারণে-অকারণে যে শহরে যন্ত্রচালিত যানবাহনগুলো হর্ণ বাজিয়ে চলে সে শহরে ট্রাফিক পুলিশের বাঁশিই কেউ মানে না। সেই শহরে নারীর নিরাপত্তার জন্য ‘বাঁশি তত্ব’ প্রথমত খুব কার্যকর না মনে হলেও, এ তত্বটা গ্রহণ করা মন্দ হবে না বোধ করি। যদি সব নারীর হাতে থাকে একটি বাঁশি। যে বাঁশিতে বাজবে বিপদের সুর। সে বাঁশিতে সচকিত হবে পথচারী। দায়িত্বশীল ব্যক্তি। সে বাঁশি তো সত্যিই নগরীকে নিরাপদ করে তুলতে পারে। (তবে সেই বাঁশি যাদের কাছে থাকবে তাদেরও রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে বাঁশি পরিচালনা কমিটির কাছ থেকে। নাহলে এ বিশেষ বাঁশি চলে যেতে পারে কৌশলী ছিনতাইকারীদের হাতে। )

লেখক: মাহফুজা জেসমিন, সিনিয়র রিপোর্টার, বাসস

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.