সুখপাখীর দেখা মেলে না কখনো

Farhana Rahman
ফারহানা রহমান

ফারহানা রহমান: ভরদুপুরে কল বেলের শব্দে প্রচণ্ড বিরক্ত হয় তৃষ্ণা। দরজা খুলেই দেখে রেণু মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। রেণু ওর দূর সম্পর্কের বোন হয় । রেণুর বাবা বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পর্যায়ের মানুষ। মা অত্যন্ত নামযশ সম্পূর্ণ মহিলা ডাক্তার। ওরা দুবোন। ছোটবেলা থেকেই ওদের মা নানীর কাছে মেয়েগুলোকে ফেনারগন খাইয়ে খাইয়ে রেখে এফ সি  পি এস, এফ আর সি এস পাস করে আজ বিখ্যাত গাইনোকলজিস্ট হয়েছে, এধরনের নানা কিসিমের কথা প্রচলিত আছে পরিবারে । কোন এক অজানা কারণে তিনি নিজে কিন্তু মেয়েদের উচ্চ শিক্ষার বিপক্ষে। মেয়েদেরকেও তিনি অল্প বয়সে এসএসসি পাস করার পর পরই বিয়ে দিয়ে দেন। নাম যশ প্রতিপত্তির তো কোন অভাব নেই, তাই মনের মত জামাই কিনতেও কোন বেগ পেতে হয়নি।

তৃষ্ণা ও রেণুর মধ্যে বলতে গেলে ভালই সম্পর্ক। দুজনের স্বামী সরকারী কর্মকর্তা। যদিও রেণুর স্বামী অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা। তারপরও একই পোস্টিং প্লেসে থাকায় সম্পর্ক গভীরতর হয়েছে। ফোনে প্রায় কথা হয়। মাঝে মাঝে বাসায় আসা-যাওয়াও আছে। হঠাৎ অসময়ে এলোমেলো বিধ্বস্ত অবস্থায় রেণুকে দেখে তৃষ্ণা অপ্রস্তুত বোধ করে।

ভিতরে আয়, বলে রেণুকে লিভিং রুমে বসতে বলে। ভরপেট ভাত খেয়ে মাত্র একটু ভাতঘুম দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল ও,  এরই মাঝে আবার কি জ্বালায় পড়লাম!  মনে মনে ভাবে তৃষ্ণা।

একটু বস! আমি দুমিনিটের মধ্যে আসছি বলে বেডরুমে যায় ম্যাক্সিটা বদলে সালওয়ার কামিজ পরবে বলে। ভাবে এই সুযোগে চা-টাও বানিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু রেণু ওর পিছন পিছন বেড রুমে চলে আসে।

চা খাবো না। কথা আছে তোমার সাথে, একটু বসো।

এতক্ষণে ওর চেহারার তীব্র বিষণ্ণতা খেয়াল করে তৃষ্ণা। দেখে মনে হচ্ছে কোন কিছু নিয়ে গভীর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। অপরূপা না হলেও ওর গায়ের রং একসময় ছিল দুধে আলতা। ওর চেয়ে বয়সে কম করেও ৬/৭ বছরের ছোট রেণুর টলটলে স্নিগ্ধ চেহারা দেখে খুব মুগ্ধ হতো তৃষ্ণা। ক্রেতাদুরস্ত রেণুকে সেজেগুজে ফিটফাট হয়ে থাকা অবস্থায় দেখতেই তৃষ্ণা অভ্যস্ত। মেকআপহীন অবস্থায় অপরিচিত মনে হয়। কেমন কালচে মেসটার ছোপ ছোপ পরেছে সারা মুখে, চোয়াল উঁচু হয়ে হাড় বেড়িয়ে আছে। রুক্ষ চোখ মুখ। কুঁচকানো চেহারায় স্পষ্ট হতাশা আর রাজ্যের বিরক্তি। চোখের এমন শূন্য দৃষ্টি দেখে ভীত হয়ে জানতে চায় তৃষ্ণা, কি হয়েছে তোর?

রাজার সাথে শামীমের খুব খারাপ সম্পর্ক আছে।

কি? বিস্মিত হয় ও! তুই কি করে বুঝলি?

অনেকদিন থেকেই মনে হচ্ছিল। কালকে রাতে হাতেনাতে ধরা পড়েছে।

রাজা হচ্ছে রেণুর বাসার কাজের ছেলে। ওর বেয়াদবি, কথা না শোনা, যখন তখন টিভি দেখা, জোরে জোরে বাংলা সিনেমার গান শোনা ও গাওয়া, রেণুর বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলা এসবই বহুদিন থেকেই শুনে আসছে তৃষ্ণা। ওর ভ্যানভ্যানানি শুনে কতবার বলেছে, ছেলেটাকে দুগালে দুটো চড় দিয়ে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার কথা, কিন্তু রেণু শুধু বলতো, ‘ শামীম ওকে ছেড়ে দেওয়ার কথা শুনতেই পারে না।’ এব্যাপারটা নিয়ে ওদের মধ্যে প্রায়ই প্রচণ্ড ঝগড়া বিবাদ হয়। ওর স্বামীর এই কাজের ছেলের প্রতি প্রীতি রেণুর মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়। নানা ফন্দী ফিকির করেও ও এই রাজা ছেলেটাকে বদলাতে পারে না কেন, সেটাই ওর বোধগম্য হয়না কিছুতেই।

ওর হোমরাচোমরা উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা স্বামীর জুতো পরানো আর খোলা, সেই সাথে চকচকে বুট জুতো ব্রাশ করার কাজের জন্য তো অন্তত একটা কাজের ছেলে না হলেই নয়। কিন্তু এই বেয়াদব ছেলেটাকেই কেন উনার রাখতে হবে সেটা বুঝতে পারে না তৃষ্ণা। তাই ছেলেটার নানা কীর্তিকলাপের কথা শুনেও আগেও বেশ কয়েকবার বলেছে ওকে বাদ দিয়ে অন্য কোন কাজের ছেলে রাখতে, কিন্তু প্রতিবার রেণু একই উত্তর দিয়েছে। শামীম রাজাকে ছাড়বে না। কিন্তু এর পিছনে অন্য আর কোন বিশেষ কারণ থাকতে পারে সেটা তৃষ্ণার কল্পনার বাইরে ছিল।

নানা পার্টি প্রোগ্রামে তৃষ্ণার সাথে রেণুর দেখা হয়। অফিসারদের র‍্যাংক অনুযায়ী বসার আলাদা আলাদা ব্যবস্থা করা থাকে। রেণুকে ওর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা স্বামীর সাথে মেকিভাবে গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে প্রায়ই ঈর্ষান্বিত বোধ করতো তৃষ্ণা। বাবার অঢেল সম্পদের জোরে সবদিক থেকে কম যোগ্যতা সত্ত্বেও রেণুর চেয়ে অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন  পাত্রের সাথে বিয়ে হওয়াকে কখনো মেনে নিতে পারেনি তৃষ্ণা। রেণুর দামী ফার্নিচার দিয়ে সাজানো সুসজ্জিত বাড়ি, দামী গাড়ী, দামী দামী শাড়ি গহনা, চাকচিক্যময় জীবন দেখে কত জ্বলে পুড়ে মরেছে তৃষ্ণা একসময়। পার্টিতে দেখা  হলে কাছে গিয়ে কথা বলতে গেলেও বেশ মুড নিয়ে কথা বলতো ও তৃষ্ণার সাথে।  মনে মনে কেমন এক বিকৃত সুখ বোধ করে আজ তৃষ্ণা।

আহারে, নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস ও পারেতে সর্ব সুখ আমার বিশ্বাস।

 

শেয়ার করুন: