বন্ধুর সংসারে ঝড়

Reza bhai
ইশতিয়াক রেজা

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: সুখ সাজানো জীবন। অনেকের কাছেই এমন জীবন আরাধ্য। কতদিন ধরে গড়ে তোলা এই সংসারটিতে কোনদিন এমন অস্বস্তি আসবে তারা দু’জনতো ভাবেনি। আমরা যারা খুব ঘনিষ্ঠ, তারাও কোনদিন এমন দু:স্বপ্ন দেখিনি। কিন্তু হয়েছে।

বলছিলাম আমার বন্ধু শীলার কথা। সেই কলেজ জীবন থেকে আমাদের চেনা-জানা, বন্ধুত্ব। কলেজ শেষে আমরা ভর্তি হলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লেখাপড়ায় ভাল ছিল, কিন্তু কি কারণে যেন হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে না। তাই ভর্তি হলো ইডেন কলেজে।

আমাদের মন খারাপ হলো, তবে কি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি আমরা? এবং হলোও তাই প্রথম দিকটায়। দেখা নেই, কথা নেই। এখনকার মতো মোবাইল ফোন নেই, সামাজিক গণমাধ্যম নেই।

ক্যাম্পাসে আমার আড্ডা ছিল নানা রকম, নানা স্থানে। কলাভবন, হাকিম চত্বর, মধুর কেন্টিন, মল, টিএসসি, সায়েন্স এনেক্স, পুষ্টি ভবন, কার্জন হল। সহপাঠিদের সাথে কিছু সময়, তারা চলে যাওয়ার পর রাজনৈতিক বন্ধুদের সাথে, সাংবাদিকতা করি, তাই ক্যাম্পাস রিপোর্টারদের সাথে, সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে।

এই সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথেই ঘুরাফেরার সুবাদে একদিন শীলার দেখা পেলাম টিএসসিতে। সে এক আবৃত্তি সংগঠনের কর্মী, তাদের রিহার্সেল হয় টিএসসিতে। দু’জনেই চমকিত, আনন্দিত। দেয়ালে হেলান দিয়ে করিমের চা খেতে খেতে কত কথাই না হয় আমাদের। এরই মধ্যেই জানলাম আমাদের সিনিয়র জামি ভাইয়ের সাথে তার প্রণয়ের কথাও।

ইশতি….তোমার সাথে ওকে পরিচয় করিয়ে দিব, শীলা বলে। আমি বললাম, অবশ্যই। এবং হলোও তাই একদিন।

শীলা অসুন্দরী নয়, আবার ডানাকাটা পরীও নয়। কিন্তু জামি ভাই লম্বা চওড়া, তেজস্বী চেহারা আর বাজখাঁই গলা। ঢাকার বড় ধনীর দুলালদের একজন। কিন্তু খুবই সাধারণ তার চলাফেরা। প্রথম দিন থেকেই জামি ভাই আর আমি হয়ে গেলাম নতুন বন্ধু। রিহার্সেল না থাকলেও শীলা আসে জামি ভাইয়ের জন্য। টিএসসিতে জামি ভাইয়েরও বৈকালিক ঘুরাঘুরি শীলার জন্য। কোনদিন হয়তো শীলা আসেনি, জামি ভাই আমাকে পেয়ে গেলে বলছেন, ‘তোমার বন্ধুর কোন টাইম সেন্স নেই’।

কোনদিন শীলা আগে চলে এসেছে, জামি ভাই আসেননি। আমাকে দেখে বলছে, ‘দেখলি তোর জামি ভাই’র কাণ্ড, আমি কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি’। কখনো একা পেয়ে বলছি, ‘কিরে আমাকে তো কোন চান্সই দিলি না, ধুম করে একটা জোগাড় করে ফেললি’। শীলা বলে ‘তুইতো আছিসই, সারাজীবনই থাকবি’।

এসবের মাঝেই, আমাদের চেয়ে বেশ খানিকটা আগেই জামি ভাইয়ের বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ হলো। আর শেষ হতে না হতেই বহুজাতিক কোম্পানিতে যোগদান। তাদের ক্যাম্পাসে আসা কমে গেল। দেখা কমে গেল। ল্যান্ড ফোন কাছে ধারে থাকলে কথা হয়। এভাবে একসময় আমাদেরও ক্যাম্পাস জীবনের ইতি টানার সময় হলো, জীবনের আহবান ব্যতিব্যস্ত করে তুলল, ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্নে কেউ বিসিএস দেয়, কেউ ব্যাংক-এ যোগ দেয়, কারো শুনি কলেজে পড়াবার চাকুরী হয়েছে। আমার ক্যাম্পাস রিপোর্টারের চাকুরীটাই একসময় স্টাফ রিপোর্টার-এ পরিণত হয়।

অনেক কম যোগাযোগের মধ্যেই হঠাৎ একদিন রাত আটটার দিকে, আমার পত্রিকা অফিসে হাজির তারা দু’জন। জামি ভাই প্রথম বলে, ‘ইশতি আমরা বিয়ে করছি, তুমি কিন্তু থাকছ তোমার বন্ধুর পাশে’। আমি নতুন করে দু’জনকে দেখি, কতটা বদলেছে তারা। কেমন সুখ সুখ চেহারা তাদের। তারা চলে যাচ্ছে, আমি এগিয়ে দিচ্ছি। জামি ভাই থেকে কিছুটা পিছিয়ে এসে শীলা বলে, ‘তুই থাকবি প্রতিটি পর্বে’। হ্যা, আমি ছিলাম।

বিয়ের পরপর তারা চলে গেল দেশের বাইরে। যোগাযোগ বলতে মাঝে মাঝে অফিসের ঠিকানায় জামি ভাই’র চিঠি, তার নিচে শীলার দুই/তিন লাইন উপদেশমুলক কথাবার্তা যেমন, ‘ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করবি, দেশে যা গণ্ডগোল হয়, তোকে নিয়ে ভয় করে, সাবধানে থাকিস’। আমারও সংসার হলো, কিন্তু ওদের কাছে পেলাম না। ওরা বাইরে। যখন ফিরল, তখন বাংলাদেশে মোবাইলের যুগ শুরু। তাই যোগাযোগে আর কোন সমস্যা নেই। আবার শুরু। গেলাম একদিন, তাদের সংসার দেখতে। কি অসাধারণ সজ্জিত ঘরদোর। আর ফুটফুটে একটি মেয়ে সারা ঘরে খেলছে। সময় লাগেনি তার সাথেও খাতির হতে।

জামি ভাই যোগ দিলেন আবার নতুন এক বহুজাতিকে, শীলাও কাজ করতে শুরু করল একটি দূতাবাসে। বাসার কাছেই। মেয়ের স্কুলও পাশে। মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে, সে অফিসে যায়, দুপুরে লাঞ্চ আওয়ারে তাকে তুলে বাসায় কাজের লোকের কাছে রেখে আবার অফিস, বিকেল চারটায় ঘরে ফেরা।

আমাদের সবারই নিজস্ব জগৎ আছে, বন্ধু-বান্ধব আছে, সহকর্মী আছে, আত্মীয়-স্বজন আছে। কিন্তু আমাদের তিনজনের সম্পর্কটা একদম এক্সক্লুসিভ হয়েই রইলো। আর কারো স্থান নেই এখানে। একান্ত আপনজনদেরও। আমাদের আড্ডা আমাদের মতো করে। শীলা ডাকে, বাসায় আয়, ছুটে যাই.. জামি ভাই দরজা খুলে বলেন, এসো।

কখনো কখনো এমন হয়েছে, শীলা ডাইনিং-এ খাবার সাজাচ্ছে, মেয়েটি খেলছে আমার কাছে, এটা-সেটা বলছে, জামি ভাই রেডি হয়ে আসছেন, আমি শীলার কাছে যাই, দেখি তার ঘামে ভেজা ফর্সা পিঠে চুল লেপ্টে আছে, খুব কাছে গিয়ে বলি.. ‘লাভ ইউ’। ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘আমি জানি তো, তোর জামি ভাইও জানে তুই আমাকে ভালবাসিস’…। আমরা হেসে উঠি, জামি ভাই বের হয়ে এসে বলেন, ‘আমি জানি তোমরা কি বলছিলে’। এমন সব খুনসুটির মাঝেই মেয়েটি বড় হয়ে গেল, একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলো।

এমন মধুর যে সম্পর্ক, আজ কোথায় যেন ছেদ পড়েছে তাতে। অনেকদিন ব্যস্ত থাকায় যাওয়া হয়নি, কথাও কম হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় হঠাৎ শীলার ডাক, একটু বাসায় আয়। যেতে একটু দেরি হলো.. দরজা শীলা নিজেই খুললো। সোফায় বসলাম। বুঝলাম, আর সব দিনের মতো নয় আজ পরিস্থিতি। এমন পরিবেশ আমি কোনদিন দেখিনি। শীলা বসে আছে একটা চেয়ারে, আমার থেকে খানিকটা দূরে। গম্ভীর মুখে এলেন জামি ভাই। এসেই বললেন, ‘বল তোমার বন্ধুকে, কি হয়েছে, কোন কিছুরই তো খোঁজ রাখনা, সব শেষ হয়ে গেল’। অনেক উত্তেজিত কথাবার্তা বলে তিনি চলে গেলেন তার শয়ন কক্ষে।

ধীরে ধীরে শীলার কাছ থেকে যা শুনলাম তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না কখনোই। ওদের একমাত্র মেয়েটি, বাসায় নেই। কোন ছেলেকে ভালবেসে পালিয়েছে। কোন কিছু বলছে না, শুধু একবার ফোন করে বলেছে, ভাল আছে। এমন পরিবারে, এমন মা-বাবা যার আছে, সে এমনটা করতে পারে? আমি কোনভাবে অংক মেলাতে পারি না। থানা-পুলিশ করা হয়েছে, কিন্তু খোঁজ মিলছে না দু’দিন ধরে। জামি ভাই, বারবার শীলার দোষ দিচ্ছেন। মা হয়ে সে মেয়ের কোন খোঁজই রাখেনি, এজন্যই আজ এ পরিস্থিতি। শীলা কাউকে কিছু বলতে পারছে না। তার আছে শুধু কান্না।

আমাকে বলছে, ‘আমি সারাজীবন মেয়েটিকে আগলে থাকলাম, জামিতো বাইরে বাইরেই থাকলো, তবুও আজ আমার দোষ? আর মেয়েটিও পারলো এমনটা করতে? কাউকে ভালবাসে সেকথা তো আমাকে বলতে পারতো’?

শীলা বলে, ‘জামি আমায় দুষছে, ওর পরিবারও বলছে কেমন মা, মেয়েকে বুঝতে পারে না, দেখে রাখতে পারে না’।

রাত অনেক, মধ্যরাত ছুঁই ছুঁই, আমি উঠি। এগিয়ে যাই দরজার কাছে। শীলা উঠে আসে, আমাকে কাছে টেনে বলে, ‘আমার সংসারটা ভেঙ্গে যাচ্ছে, মেয়েটাকে উদ্ধার কর ইশতি, আমার জীবনটা বাঁচা’। জানিনা কতটা করতে পারবো, তবুও কথা দিই।

নেমে আসি, গাড়িতে উঠি, মাঝরাতে নীরব ঢাকায় গাড়ী চলছে।

আমি ভাবছি, ‘সংসারে সন্তানের কিছু হলে তার দায়টা আসলে কার? শুধুই মায়ের? এভাবেই কি ভাবে প্রতিটি পরিবার…………….? কোন কোন সন্তানও কেন এমন হয়? তাদের চিন্তা, তাদের পরিকল্পনা, ভালো-মন্দ কোনো কিছুই বাবা-মা’র  সাথে শেয়ার করতে চায় না কেন’? যে শীলার সারাটা সময় আবর্তিত হয়েছে মেয়েকে ঘিরে, সেই মেয়ে কেন এতটুকু জানালনা মা’কে তার ভাবনার কথা?

সর্বশেষ: ফিরে এসেছে মেয়েটি.. দারুণভাবে প্রতারিত হয়েছে তার বন্ধুর কাছে। শুনে আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে যাই…..বুঝতে পারি কতটা ঝড় বয়ে গেছে এই মেয়েটির উপর দিয়ে, ‘শীলাকে বলি, জামি ভাইকে বলি.. কোন প্রশ্ন নয়, কোন রাগ নয়, কোন অভিযোগ নয়, মেয়েটিকে কমফোর্ট দিন এখন, উষ্ণতা দিন’।

লেখক: সাংবাদিক

শেয়ার করুন: