উইমেন চ্যাপ্টার: আমরা যারা একলা থাকি, আমাদের কী সুবিধা জানেন? সুবিধা হলো, আমরা যখন খুশি বাসা থেকে বের হতে পারি, যখন খুশি ফিরতে পারি, কারও চোখ আমাদের পিছু পিছু ঘুরে না, কেউ ‘না’ বলে না কোনকিছুতে। যখন খুশি ঘুমাতেও পারি। কিন্তু এখানেও একটা ‘কিন্তু’ আছে বিরাট বড়।
একজনের নিষেধ হয়তো মানতে হয় না আমাদের, কিন্তু শত নিষেধ যে পায়ে পায়ে থাকে, তা পেরুনো মুশকিল। সমাজের নিষেধ, মানুষের চোখের-অবিশ্বাসী মনের এই নিষেধ যে কাটাতে পারে, সেই পায় সত্যিকার স্বাধীনতার সুখ। যে দেশটিতে আমরা থাকি, বলা ভাল, যে উপমহাদেশটিতে আমরা থাকি, যে সংস্কৃতিতে থাকি, তাতে ওইসব চোখ কেবলই ঘুরে-ফিরে বেড়ায় আমাদের একাকি মেয়েদের চারপাশে। ওদের যেন আর কোন কাজ নেই।
কেন একা থাকি, কেন ভাল থাকি, কেন এরকম পোশাক পরি, কেন আনন্দে থাকি, সবই জানতে চায় ওইসব মানুষের মন। অনেক কৌতূহল তাদের, আমাদেরকে ঘিরে। এই কৌতূহল একসময় গলায় কাঁটার মতোও বিঁধে, নিজেদের জীবনের যত ব্যর্থতা, যত অ-সুখ, সব ঢেলে দিয়ে তারা চায় আমাদের জীবনটাও বিষিয়ে দিতে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিভাবে যেন তারা সফলকামও হয়ে যায়। আমরা প্রশ্রয় দেই বলেই হয়তোবা।
এসব মানুষকে জীবন থেকে ‘মাইনাস’ করে দিলে কীইবা আসে যায়! কার কী ক্ষতি তাতে, লাভ বৈ তো ক্ষতি নেই।
তবে এই সুবিধা আবার সবার জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে। জানাশোনা অনেকেই আছেন, যারা মরমে মরে আছেন, যারা একা থাকেন, এটাকে একধরনের অসুস্থতা ধরেই নিয়েছেন, যেন তার মারণঘাতী ক্যান্সার বা কুষ্ঠ রোগ হয়েছে। একা থাকাটাই যেন আজন্ম পাপ। তাদের কথা আলাদা। অর্থনৈতিক মুক্তি মেয়েদের অনেক সাহসী করে তোলে, যারা সেই মুক্তির স্বাদ থেকে বঞ্চিত, তারা জীবনভরই গলগ্রহ হয়ে থাকেন, স্বামী থাকলে স্বামীর, নয়তো অন্য কারও।
তবে এই স্বাধীনচেতা ভাবের অসুবিধা যে নেই, তা বলবো না। অনেকে ধরে নেন, এই মেয়েটি একা, তাকে যখন খুশি ফোন করা যায়, যখন খুশি তার সাথে আড্ডা দেয়া যায়। অনেকের ভাষায়, মেয়েটি ‘খালি আছে’।
ভুলে যায়, মেয়েটির একটি আলাদা সত্ত্বা আছে, যা কিনা তাকে আপন-পর চেনাতে সাহায্য করে, ভাল-মন্দ বুঝিয়ে দেয়। কোন ফোনের কী ভাষা, সেটাও সে বুঝতে পারে।
সেদিন এক বন্ধুর এক স্ট্যাটাসের পর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। গণমাধ্যমের একজন বেশ হোমরাচোমরা গোছের একজন নারী কেলেংকারিতে মহা ওস্তাদ। তিনি নিজেকে ‘স্বঘোষিত প্লে-বয়’ হিসেবেই জাহির করেন। তার পার্টিতে অনেক ‘ললনার’ উপস্থিতি দেখা যায়, যারা নিজেদের মেলে ধরতেই সদা সজাগ। তো, সেই প্লে-বয় সিনিয়র সাংবাদিক অনেক বছর আগে রাত-বিরেতে ফোন দিতেন। তেমন কোন কথা নেই, কি করছি, ঘুমাচ্ছি কিনা, ঘুম আসছে না কেন, এসব অবান্তর প্রশ্ন। একদিন-দুদিন যাওয়ার পর বিষয়টা খটকা লাগে। মানে কী? রাত একটা, চারটা নেই, যেকোনো সময় ফোন বাজে। একদিন বলেই ফেলি, অমুক ভাই, আপনি এতো রাতে? হেসে বললেন, ‘২৪ ঘন্টার চ্যানেলে কাজ করতে পারবা কিনা, তা পরীক্ষা করছি’।
হাসবো না, কাঁদবো, বুঝে উঠতে পারি না। তবে আমার এই প্রশ্নের পর উনি আর ফোন করেননি রাতে। তবে এসএমএস আসতো। আর আসতো পার্টির দাওয়াত। দু’একবার সেসব পার্টিতে যাওয়ার পর ওই ললনাদের কলকাকলি দেখে আর যাইনি কোনদিন। এটা আসলে আমার জায়গা না। আমি অতি সাধারণ মানুষ।
আরেকটি ঘটনা অতি সাম্প্রতিক। একজন নারী এবং দুজন পুরুষ এতে জড়িত। আমাকে নিয়ে তাদের কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু ওই নারী আমাকে চেনে ফেসবুক থেকেই। ওইটুকুই চেনা। সে কিনা আমার খুব কাছের একজন মানুষের কাছে এমন একটি গল্প ফেঁদে বসলো আমার সম্পর্কে, ভাবতেও অবাক লাগে। কথাটা শোনার পর সারারাত ভেবেছি, এই গল্পের উৎস কি? কেনই বা এই গল্প ফাঁদা? আমার ফেসবুকে এমন কোনকিছু নেই, যাতে করে এসব গল্প তৈরি হয়। আর আমার সবকিছুই ওপেন, এখানে লুকানো-ছুপানোরও কিছু নেই। তাহলে গল্পটা এলো কোথা থেকে? গল্পটা একজন মৃত বা জীবিত মানুষকে নিয়ে। যে মানুষটা মৃত, তাকে দিব্যি জীবিত বানিয়ে চালান করে দিয়েছেন সেই মহান তিনজন। আবার এমনও হতে পারে, কোনো কাল্পনিক জীবিত মানুষকে নিয়ে টানাটানি করছেন তারা। যাদের কোনো অস্তিত্ব আমার জীবনে নেই। মিথ্যার জায়গা তো নেই-ই।
তাহলে? তাদের এতো সময়, এতো সুখের আধার আসে কোথা থেকে? গল্পটা শোনার পর থেকে সঞ্জীবদার (সঞ্জীব চৌধুরী) ওই গানটাই মনে ভাসছে, চোখটা এতো পোড়ায় কেন, ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও………। সমুদ্র বিশাল। তার বিশাল জলরাশি দিয়ে পবিত্র করে দিয়ে যাক এসব ক্ষুদ্র মানুষের ভিতরটুকু। এই কামনা ছাড়া আর কীইবা করতে পারি। শুধুই ‘পিটি ফিল’ করা ছাড়া আর কিছু করার নেই আমার।
জীবন অনেক বড়, সেখানে এসব দু’একটা নরকের কীট তো থাকেই। তাদের উপেক্ষা করতে পারলে জীবন অনেক সুন্দর হয়ে উঠে। এই উপেক্ষাটাই সবসময় করা সম্ভব হয় না, তখন কষ্ট পাই, শুধুই কষ্ট। নিজের জন্য কষ্ট বাড়ে, ওদের নিচতা দেখেও কষ্ট বাড়ে।
তাদের উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলতে চাই, নিজেদের নিচতা, ক্ষুদ্রতা, শিক্ষাহীনতা, আর নিজেদের জীবনের ব্যর্থতা বা সুস্থ যৌন জীবনের অভাব অন্যের ওপর দিয়ে গড়াবেন না প্লিজ।
একা থাকি, একা চলি, একার রোজগারে সংসার চালাই, ছেলেমেয়ে বড় করি, মানুষ করতে হিমশিম খাই, সেখানে অন্য কারও কোনো অধিকার নেই কিছু বলার। যারা বলছে, তাদের শুধু এইটুকুই বলবো, জাস্ট শাট আপ। (চলবে)