আমার সকল গান- ১

Shams
শারমিন শামস

শারমিন শামস্: আমার বিষন্নতা অস্থিরতায় পরিণত হয়, যখন আমি ঠিক করে রাখা কাজগুলো সময়মত সারতে পারি না। এক একটা করে দিন চলে যায়, কিনে রাখা বইগুলো পড়া হয় না। ল্যাপটপে ওয়ার্ড ফাইল খোলা- ‘লেখা’ নামে। আমার লিখতে বসা হয়না। আমি ঘর বাইরে সামলে নিজেকে নিজের কাছে নিয়ে ব্যস্ত হতে পারিনা। আমার মন অস্থির হয়। আমার কিছুই ভালো লাগে না।

একটা সময় ছিল, আমি নিজেকে নিয়ে, আমার স্বপ্নগুলো নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকতাম। জীবনের নিয়মে সবকিছু পাল্টায় ধীরে অথবা দ্রুত। আমি দেখেছি আশেপাশে, কাছের অথবা দূরের মানুষদের জীবন কেমন পাল্টে যায়। কখন পাল্টায়, কীভাবে পাল্টায় তারা নিজেরাই জানে না। ২৪ ঘণ্টার একটা আস্ত দিন কেমন কেটে যায় অফিসের দাসত্বে। এরপর সংসার, সন্তান, আত্মীয় পরিজন, দায়িত্ব, কর্তব্য পালন। বাকিটা কাটে নিকৃষ্ট অবকাঠামোর এই মহানগরীর যানজটে, জীবনযুদ্ধে। সব শেষে রাত নামে যখন, ঘুমকে কাছে ডাকতে ডাকতে কখন এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুকের গভীর থেকে, বেডরুমের হাওয়ায় ঘুরপাক খেতে খেতে অ্যাপার্টমেন্টের জানালার ফাঁক গলে সে বেরিয়ে পড়ে।

আমার সারাদিনের করতে না পারা কাজগুলোর প্রতি আমার দীর্ঘশ্বাসের বাতাস রাতের ঘুমের ভিতরে আমাকে অবিরাম খোঁচাতে খোঁচাতে, যন্ত্রণাবিদ্ধ করতে করতে ভোর এনে দেয় কখনো কখনো। হয়তো তারা বেডরুমের জানালা গলে বেরিয়ে যেতে পারেনি সেই রাতে। তারা অবিশ্রান্ত যন্ত্রণা দিতে দিতে বারবার ঘ্যানঘ্যানে স্বরে বলতেই থাকে, ‘আর কত? আর কত?’ আমি জেগে যাই বারবার। আর কত? তারপর ঘুমিয়ে পড়ি।

সকালে আবারো ব্যস্ততা। আবার পুরোনো সেই একঘেয়ে কাজের জন্য নতুন আরো একটা দিন। ফেইসবুকে স্ট্যাটাস লিখি। ‘আমি কী চাই?’ বেশ, এইটুকুই আমার আস্ফালন। আমি আটকে গেছি। কীসের জালে, কেমন করে আমার এই আটকে যাওয়া, আমার কি জানা আছে? ভীষন ইচ্ছে করছে, আবারো শুরু করি পড়াশুনা। ইচ্ছে করছে পাখা মেলে দেই। ইচ্ছে করছে লিখি যা মনে আসে, ভালো মন্দ। ইচ্ছে করছে ঘাসবনে যাই, কাশবনে ঘুরি। ইচ্ছে করছে সারা দুপুর পড়ি বিনয় মজুমদার।

‘সূর্যের চেয়েও বড় তারা আছে, তাহলেও তারাগুলি ছোট মনে হয়/ যে সকল তারা দূরে সেগুলিকে ছোট মনে হয়/ যে সকল তারা কাছে তাদের বৃহৎ মনে হয়/ রাত্রিবেলা আকাশের দিকে চেয়ে এইসব ভাবি।’

এইসব মনে হওয়ার ঝড় হঠাৎ উঠে হঠাৎই শান্ত হয়। সন্তানের জন্য খাবার তৈরি করে, তাকে খাইয়ে, নাইয়ে, সাজিয়ে তার দিকে চেয়ে থাকি। নিজেকে সুখী আর পরিপূর্ণ লাগে। তবু কোথায় যেন খচখচে এক তীব্র কাঁটা।

আমারও ইচ্ছে করছে সাগরে নাইতে, আমার স্বপ্নের ডালপালাগুলো মেলে দিতে দূরে আরো দূরে। কিন্তু আমি আটকে গেছি দাসত্বে। আমার স্বপ্নগুলো থমকে গেছে কোন মহাপ্রাচীরের সামনে এসে? এই প্রাচীর কি আমারই তৈরি? নিজের চাওয়া, নিজের স্বপ্নের পথে আমরাই কি নিজ হাতে তুলে ফেলি বিশাল দেয়াল?

আমি আমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি? ‘হ্যারে, তোদেরও কি এরকম?’ একি! ওরাও সেই চিরচেনা দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় ছড়িয়ে বলে, ‘হমম্, কী করতে চেয়েছিলাম, কী করছি। কিছুই করা হল না এ জীবনে।’ কেউ কেউ বলে, ‘ভালই লাগছে যা করছি, তবু মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে, নিজের জন্যও কিছু করি। কিন্তু অফিস থেকেই তো ফিরি রাতে। তারপর কত কাজ। আবার পরদিন অফিসের প্রস্তুতি। সংসারের হাজারো ঝুট ঝামেলা সামলে কখনই দাঁড়াই নিজের মুখোমুখি?’

নিজের কাছে ফিরে আসার সময় নেই আর। যেটুকু সময়, কেড়ে নিয়েছে তা ফেইসবুকে, ভাইবারে। মাঝে মাঝে রাগ করে দূরে সরিয়ে দিই। আবারো ফিরে আসি এইসব অর্থহীন আয়োজনের কাছে। বড় লোভনীয় লাগে। এক একটা করে দিন কেটে যায়। বাইরে পড়াশুনার সুযোগ খুঁজতে ইন্টারনেট ঘাটি। উপযুক্ত কিছু পেলে আশান্বিত হয়ে উঠি। মুহূর্তে মনে পড়ে মেয়ের মুখ। আটমাসের কচি আল্হাদি ছানা। ওকে ফেলে যাওয়া যেন অসম্ভব। আমি এলোমেলো ইন্টারনেট ঘেঁটে ফেইসবুকে ফিরে আসি।

আচ্ছা, এই দোটানা, এই নিজের সাথে দোলাচলের যুদ্ধ, এই গড়িমসি, এই বারবার ফিরে আসা- এ কি কেবল মেয়ে বলেই? নাতো। পরিচিত বহু ছেলেকেও দেখেছি এমন করে জীবনযাপনের জালে জড়িয়ে পড়তে। নিজে কী চাই, কী করতে চেয়েছি জীবনে- সব ভুলে যেতে। নিজেকেই হারিয়ে ফেলতে দশটা-পাঁচটায়। তবে হ্যা, পিছুটানের গুঁতো সামলাতে হয় মেয়েকেই বেশি। মেয়েদের সামলাতে হয় দশহাতে। দশভুজার মত তার দশখানা হাত নিজেরটা বাদে আর সব সামলায়। কেন হয় এমন? সমাজ, সংসার, পরিবার – সবকিছুর সাথে যুদ্ধ করে নিজের সাধের মহার্ঘ্য চাকরিখানা ধরে রেখেই ধণ্য অনেক মেয়ে। এরপর তার শক্তি হয়তো স্তিমিত হয়ে আসে। এরপর হয়তো সে ফুরিয়ে যায়। এরপর হয়তো সে বাধ্য হয় তার স্বপ্নখানার ডানা ছেটে দিতে। ছোট হয়ে আসে তার পৃথিবী। সে যে কত বড় স্বপ্ন দেখতে পারে, সেটাই সে ভুলে বসে থাকে।

চুলায় রান্না চড়ানো। সব সেরে বেরুতে হবে। রাস্তায় নেমে শ্বাস নিই। ফুটপাথে হেঁটে যাচ্ছে একটি মেয়ে। জিনস আর ফতুয়া পরা। হালকা পাতলা গড়ন। ক্রসবেল্টের একটা ব্যাগ কোনাকুনি ঝোলানো। ছোট ছোট চুল উড়ছে হাওয়ায়। কোন দিকে নজর নেই। মাথা উঁচু করে কী দৃঢ় দ্রুত পথ চলছে। ধক্ করে ওঠে বুকের ভেতর। ওটা আমি না? আরে আমিই তো। সেই কত বছর আগে যেন ফেলে এসেছি এই আমাকে? কোথায় ফেলে এলাম একে? কে বলেছে তাকে ফেলে যেতে? নিজের দিকে তাকাই।

পাল্টে গেছে আমার চলা, আমার শরীর মন, আমার পোশাক। আমিও পাল্টে গেছি। নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ফুরিয়ে যাচ্ছে কেন? আমি তো চাইনি। আমি তো বারবার স্বপ্ন দেখতে চাই স্বপ্ন ভঙ্গের পরও। আমি তো চাই ফিল্ম বানাতে। আমি তো চাই লিখতে। আমি তো চাই খুব একজন দক্ষ সংবাদকর্মী হতে। সব ক্যামন গুলিয়ে যায় ক্যানো? সব কিছুর সমন্বয় করে আমাকে যে এগুতে হবে সামনে- এর জন্য বল ভরসা কে দেবে আমাকে? কেউ না। আমি ছাড়া কেউ কি জানে মনের ভিতরে কোন পাখি গায়? কোন প্রজাপতি ডানা ঝাপটায় আমার মত করে? তবে তাকে আটকে রেখেছি কেন? খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিক সে।

আমি ঐ ছোট চুলের মেয়েটার মত, আমার পুরোনো স্বাপ্নিক আমাকে আবারো দেখতে চাই সংগ্রামের মাঠে। আমি বারবার যেন নিজের জন্য বেঁচে উঠতে পারি। নিজেকে ভালোবেসে বারবার নিজের জন্য ভাবতে পারি যেন। আমি জানি, নিজেকে ভালোবাসার পর, নিজেকে সময় দেবার পর, নিজের স্বপ্নকে যত্ন করে আদর করে গুছিয়ে চলার পরই কেবল আর সব কিছুই গুছিয়ে সুন্দর পরিপাটি করে করতে পারি আমি। অফিসে, বাড়িতে- সবখানে। নিজের ভালো লাগার জন্য একটা ভালো গান শোনার পর ভালো লাগে চুলায় ডেকচি চাপাতে। একটা বই পড়ার সুযোগ পেলে এরপর নিউজ রুমের একঘেয়ে ব্যস্ততাও খুব ভালো লাগে।

যখন নিজের স্বপ্নগুলো নিয়ে আরো সামনে আগাই, অনেকটা ছুঁয়ে ফেলি, তখন ইচ্ছে করে মেয়েকে নিয়েও অমন স্বপ্ন দেখি, ওকে নিয়ে আরো বড়, আরো সুন্দর স্বপ্ন দেখি। আমি তো এমনই। আমি স্বপ্নের মধ্যেই বাঁচি। স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতেই বেঁচে থাকতে চাই। বিষন্নতাকে ছুটি দিতে চাই।

আমি চাই জীবন হোক এমন যেন চিহ্নিত করতে পারি আমি কী চাই। এই জীবনে ঠিক কোন কাজটার জন্য জন্ম নিয়েছি আমি। হোক সে ছোট বা বড় কোন কাজ। আমি যেন সেই কাজের মধ্যেই নিজেকে বারবার আবিস্কার করি। তার আগে যেন কোনভাবেই নিঃশেষ না হয় আমার শক্তি, আমার উদ্দীপনা। বাস্তবতার চাপে আমি যেন নিজেকে ফুরিয়ে না ফেলি।

 

লেখক: সংবাদকর্মী

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.