নারীরা যখন ‘সংরক্ষিত’

Sebika
সেবিকা দেবনাথ

সেবিকা দেবনাথ: বাসে চড়া আমার জন্য নতুন কোন বিষয় নয়। কাজের প্রয়োজনে প্রায়ই আমার মতো অনেক মেয়েকে বাসে চড়তে হয়। সবার হয় কি না জানি না, তবে অনেক সময় বাসের হেলপার, কন্ডাক্টর কিংবা যাত্রীদের সাথে টুকটাক গোলমাল বেঁধে যায়। বেশ কয়েকদিন আগে সোনারাগাঁও হোটেলে সকালে আমার একটা  অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একটা বাসে উঠার সুযোগ পেলাম। ধাক্কাধাক্কি করে ইত্তেফাক মোড় থেকে আমরা তিনজন ‘মহিলা’ এক সাথে বাসে উঠলাম। উঠে দেখি চল্লিশোর্ধ দুইজন যাত্রী বাসের সংরক্ষিত ‘মহিলা’ সিটে বসে আছেন। তাদের পাশে বসা একজন তরুণী। ড্রাইভারের পেছনেও মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত যে চারটি সিট রয়েছে তাতেও বসে আছেন দুইজন পুরুষ যাত্রী। তাদের পোশাক -পরিচ্ছদ দেখে যে কেউ তাদের ভদ্রলোক বলবেন।

‘মহিলা’ সিটে বসে থাকা পুরুষ যাত্রীসহ দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন যাত্রী একসাথে হেলপারকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, ‘এই বেটা তুই মহিলা তুলছস কেন? মহিলা সিট আছে? ওগরে বসতে দিবি কই? গায়ের মধ্যে লাগলেই চিল্লাচিল্লি করবো। ওগরে পরের গাড়িতে আসতে কইতে পারস নাই’  ।কেউ  নিজেদের মধ্যে বলতে শুরু করলেন, ‘আরে ভাই মহিলারা এখন আর মহিলা নাই। ওরাই এখন বেশি ডিয়ারিং। কোনকিছু হলেই বলে ইভটিজ করছে’। হুজুর গোছের একজন পুরুষ যাত্রী বললেন, ‘বেপর্দাভাবে চলে বলেইতো দেখেন না….’। কথাটা শেষ করলেন না তিনি।

আমি বোঝার চেষ্টা করলাম অসমাপ্ত বাক্যের শেষে উনি কি বলতে চেয়েছেন। ‘বেপর্দা’ মানে কি? মাথাটা গরম হয়ে গেল। আমরা বাসে উঠার পরই হেলপার বললো, ‘ভাই লেডিস সিটগুলা ছাড়েন। মহিলাগুলারে বসতে দেন’। আমাদের তিনজনের মধ্য থেকে একজন বয়স্ক মহিলা বললেন, ‘ভাই এগুলাতো মহিলা সিট। আমাদের একটু বসতে দেন’। ‘মহিলা’ সিটে বসে থাকা কোন পুরুষ যাত্রীর কানে কথাগুলো ঢুকলো বলে মনে হলো না।

এসময় ‘মহিলা’ সিটে বসা একজন যাত্রী বললেন সেই কমন ডায়ালগটি। ‘আপনারা না সমান অধিকার চান, তাইলে আবার মহিলা পুরুষ কি? আপনারা যখন অন্য সিটে বসেন তখন তো আমরা বলি না এটা পুরুষদের সিট’। আর চুপ থাকতে পারলাম না। কি বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। রাগে গজগজ করতে করতে আমি ওই বয়স্ক মহিলাকে বললাম, ‘এই সিটগুলাতো শুধু মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত নয়। মহিলা, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য। যারা ওখানে বসে আছেন তারা যেহেতু মহিলা ও শিশু না, তাহলে তৃতীয় শ্রেণীর (প্রতিবন্ধী শব্দটি উচ্চারণ করলাম না)। ওদের বসতে দিন’।

আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজন যাত্রী বললেন, ‘আপা আপনি কথা বলছেন কেন? আপনারে তো কিছু বলা হয়নি’। তার এই কথা আমার রাগে যেন আগুনে ঘি দেয়ার মতো কাজ করলো।

আমি বললাম, ‘আমি কি আপনাকে কিছু বলেছি? আপনি কথা বলছেন কেন? মহিলারা বেপর্দা চলে। যারা বেপর্দা মহিলা দেখলে নিজেদের ঠিক রাখতে পারেন না তারা বাসে না উঠলেই হয়। নতুবা চোখে কালো চশমা পড়ুক’।

এসময় দেখলাম আমার গন্তব্যে এসে গাড়ি থামলো। ভাড়ার টাকা মিটিয়ে দিয়ে বাস থেকে নেমে পড়লাম। বাস থেকে নেমে মনে মনে ভাবতে লাগলাম, ‘যারা বাসে মহিলা তুলতে মানা করে তাদের চরিত্রে কি দোষ আছে? বাইরের মহিলা দেখলে কি তাদের মনে খারাপ বাসনা জাগে? তা না হলে কেন তারা এসব কথা বলে? শারিরিকভাবে ‘বেপর্দা’ ও ‘ধর্ষণ’ই কি সব? আমার দেশের এমন অসংখ্য পুরুষ আছেন যারা তাদের নিচু মানসিকতা, আচার-আচরণ দিয়ে প্রতিনিয়তই নারীদের ‘বেপর্দা’ ও ‘ধর্ষণ’ করছে। অনেক কিছু ভেবে ভেবে কোন কূল কিনারা পেলাম না। অ্যাসাইনমেন্টেও ঠিকমতো মন বসাতে পারলাম না।

বিকেলে অফিসে রিপোর্টারদের সাপ্তাহিক মিটিং ছিল। অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে ছুটলাম অফিসে। মিটিংয়ে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় আমাকে এ বিষয়ে সামগ্রিক চিত্র নিয়ে, কেন ওই অনাকাঙ্খিত ঘটনা বাড়ছে সব মিলিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করতে বললেন বার্তা সম্পাদক।

আমার এক সহকর্মী বলে উঠলেন, ‘ধর্ষণ বাড়ার পেছনে মেয়েরাও দায়ী। মেয়েরা যেসব ড্রেস পড়ছে তা আমাদের দেশের জন্য ঠিক না। ওদের ঠিকভাবে পোশাক পড়া উচিত’। আমার অন্য সহকর্মীদের অনেকেই এই কথার বিরোধিতা করলেন। আমিও করলাম। তবে আমার তখন মনে পড়ে গেল বাসের সেই অসমাপ্ত বাক্যটি ‘বেপর্দাভাবে চলে বলেই তো দেখেন না….’।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রতি মাসে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে মাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনগুলোতে দেখা যায় অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না শিশুরাও। যেসব শিশু ধর্ষণের শিকার হয় তারা কি ‘বেপর্দা’ হয়ে চলতো? ভারতের ‘দামিনী’ কিংবা বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের ‘ময়না’ কি ‘বেপর্দা’র কারণেই আজ ‘সাহসিকা’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে? আসলে যতই নারীর ক্ষমতায়ন আর অগ্রগতির কথা বলা হোক না কেন শুধু বাসে নয় প্রতিটি ক্ষেত্রে‍ এখনও নারীরা সংরক্ষিত।

 

শেয়ার করুন: