নারীর চরিত্র বনাম শুচিবায়ুগ্রস্ত পুরুষের ‘ভাল মেয়ে’ তৈরির কারখানা

Mitu
শামীমা মিতু

শামীমা মিতু: কি আছে মেয়েদের শরীরে?  গঠনগত দিক দিয়ে দু একটি পার্থক্য ছাড়া নারী-পুরুষ উভয়ের শরীরে পার্থক্য নেই তো তেমন। আর এই দু একটি পার্থক্যেই এতো কাণ্ড! পুরুষের, সমাজের সবচেয়ে চিন্তার বিষয় যেন নারী শরীর! ছেলেরা পাতার পর পাতা মেয়েদের শরীরের বর্ণনা দিলে দোষ হয় না, মেয়েরা যদি‘ দেহ মন সঁপেছি তারে’ লিখে বসে, পুরুষতন্ত্রের ভাল মেয়ে তৈরির কারখানায় হরতাল শুরু হয়ে যায়।

কি আলাদা বৈশিষ্ট্য আছে মেয়েদের চরিত্রে? কোনো মেয়ে খুন হলে সবার আগে তদন্ত চলে ‘সে কার কার সাথে শুয়েছিল।‘ কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে খোঁজ পড়ে ‘পোশাকে তার শরীর কতটুকু প্রদর্শিত হয়েছিল।‘  কোনো মেয়ে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হলে রব ওঠে ‘তার চরিত্র নষ্ট ছিল।‘ শুধু তাই নয়, মোড়ের দোকানদার রহিম আলীর মুরগি যদি ডিম না পাড়ে, দোষ কিন্তু এলাকার যুবতি মেয়েগুলোর!

সম্প্রতি ঢাকার একটি হোস্টেলের মেয়েরা ইভটিজিং এর শিকার হলে কর্তৃপক্ষ মেয়েদের শাসায় ‘মেয়েরা কেন প্যান্ট শার্ট পরে’ বলে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধান নগরের পুলিশও ইভ-টিজিং ঠেকাতে মেয়েদের ‘শালীন পোশাক পরা বা ভিড় ট্রেন-বাসে না-ওঠার পরামর্শ দেয়। বিধান নগরের পুলিশ কমিশনার তাদের ওয়েবসাইটে ইভ-টিজিং ঠেকানোর জন্য যে একগুচ্ছ রাস্তা বাতলেছিল, তার প্রথমেই ছিল ‘শালীন পোশাক’ পরুন।

মেয়েদের উত্যক্ত করার ঘটনা পুলিশ ঠেকাতে পারবে না – আর দোষটা চাপানো হবে মেয়েদের পোশাক-আশাকের ওপর, এটা কেমন কথা? ওই নির্দেশিকায় পুলিশ শুধু মেয়েদের শালীন পোশাক পরতেই বলেনি, তার সঙ্গে বেশি রাতে বাড়ি না-ফেরা কিংবা ভিড় বাস-ট্রেনে না-ওঠারও পরামর্শ দিয়েছিল। অবশ্য বিতর্কের মুখে তড়িঘড়ি সেই পরামর্শ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল।

আচ্ছা, শালীন পোশাক কি জিনিস? ইরানের শালীনতা যদি হয় বোরকা, তাহলে বাংলাদেশের শালিনতাও কি বোরকা হবে? কিন্তু এদেশেরই কোনো আদিবাসি নারীর শালীনতা যখন হয় অন্তর্বাস, তখন আমাদের শালীন পোশাক কি হবে? আর সে পোশাক নির্ধারণ করে দেবে কে?

মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ২০১১ সালে কানাডার এক পুলিশ মন্তব্য করেছিল, রাস্তাঘাটে মেয়েদের নিরাপদ থাকতে গেলে…. Women should avoid dressing like slut. এই মন্তব্য, আর তার পিছনে থাকা মানসিকতার প্রতিবাদে খোলামেলা পোশাক, যা কিনা ‘বেশ্যাদের মতো’, তা-ই পরেই মিছিলে হেঁটেছিল মেয়েরা। ২০১১ সালের এপ্রিলে টরেন্টোতে, তারপর ধীরে ধীরে সারা পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় ‘স্লাট ওয়াক’।

যে সমাজ নারীকে অশালীন পোশাক পরিধানের ‘দোষ’ দিয়ে ধর্ষণের জন্য দায়ী করে, সেই সমাজের প্রতি একটি নিটোল চপেটাঘাত যেন এই মিছিল। ‘ভালো মেয়ে’ ‘মন্দ মেয়ে’ বেড়াজালে মেয়েদের ইমেজ বন্দি করে রাখার সমাজের যে ধারণাগত বিভ্রম, এ যে কেবলই ছবি, মানে পুরুষতন্ত্রের পোষা ছক, এ মিছিল হয়তো এরও প্রতিবাদ। এর সঙ্গে ছিল নারীদের চরিত্র নিয়ে শুচিবায়ুগ্রস্ত বাঙালির চিরকালের কূটকচালী করা পুরুষদের জন্য আগাম সাবধানবাণী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মিছিলে বড় ব্যানারে লেখা ছিল ‘হাঁটো দুঃশ্চরিত্র’।

দলবেঁধে সব মেয়েরা এভাবে যদি দুঃশ্চরিত্র হয়ে যায়, কেমন হয়? যে সমাজে মেয়েদের পান থেকে চুন খসলেই দুঃশ্চরিত্র, নষ্টা উপাধি মেলে, সেখানে পুরুষের বাতলে দেয়া ‘ভালো মেয়ে হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে’ নামাটা কি লজ্জার নয়?  তারপরও এই ভাল মেয়ের ইমেজই কি সার্বজনীন? স্থান-কাল-পাত্র বিশেষে সে ইমেজ তো সর্বক্ষণ পাল্টাচ্ছে।

গ্রামের স্কুলে চাকরি করা একটা মেয়ে তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছিল। শাড়ি না পরে এমনিতে সালওয়ার কামিজ পরা নিয়ে কটাক্ষ তো ছিলই, তার সাথে যোগ হলো  তার পিঠে ব্যাগ প্যাক নেওয়া নিয়ে, যা নাকি বড় মেয়েদের ঠিক মানায় না। যাব্বাবা! ভ্যানিটি ব্যাগ না নিয়ে ব্যাগপ্যাক নিলেও মেয়েদের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়!

মেয়েদের ইমেজ তা হলে কী? ইমেজ কি তা হলে এটাই যে তারা সামাজিক সব চিরাচরিত নিয়ম, তা যতই মেয়েদের স্টেরিয়োটাইপ ইমেজে বন্দি করুক, বর্ণে বর্ণে মেনে চলবে? জায়গার হেরফেরে পিঠে ব্যাগ নেওয়াও যখন একটা মেয়ের ইমেজ খারাপ হয়ে যায়। তা হলে কি জায়গা পাল্টে গেলে ইমেজও পাল্টে ফেলব? না-কি সত্যি সত্যি শিক্ষিত হলে চেষ্টা করব মেয়েদের ওপর আরোপ করা স্টেরিয়োটাইপ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে?

একটা সময় ছিল যখন পারিবারিক অনুশাসন ভেঙে নাচ বা অভিনয় এই জাতীয় শিল্পে তথাকথিত ‘ভদ্র’ পরিবারের মেয়েদের আসার সুযোগ ছিল না। সেই সময় অনেকের ধারণা ছিল যে ভাল বাড়ির মেয়েরা নাচে না। সেই ইতিহাস ভেঙে মেয়েরা বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু এখনও বহু পুরনো মানসিকতা দানা বেঁধে রয়েছে আমাদের অনেকের অন্দর মহলেই। সামান্য ধাক্কায়, তাই মাঝে মাঝে সে খোলস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।

আসলে পিতৃতান্ত্রিক কাঠামো আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে, ভাল মেয়ে হল সেই মেয়ে, যার পোশাক হবে পুরুষের শর্তে, পৌরুষের শর্তে, যার শরীর হবে পুরুষের শর্তে, পৌরুষের শর্তে। একারণে সৈয়দ শামসুল হক ‘খেলা রাম খেলে যা’ লিখলে তা হয়ে ওঠে আধুনিক উপন্যাস, আর তসলিমা নাসরীন ‘আমার মেয়েবেলা’ লিখলে তা হয়ে যায় মন্দ মেয়ের উপাখ্যান।

পাদটীকা- অষ্টাদশ শতকে লেখা রাধিকাসান্তনম নামের এক কাব্যকে ঘিরে ১৯১০ সাল নাগাদ ধুন্ধুমার শুরু হয়েছিল দক্ষিণ ভারতে। দোষের মধ্যে লেখক মধুপালানি ছিলেন মহিলা আর রাধার কৃষ্ণকামনা ছিল এই কাব্যের শৃঙ্গাররসের আসল কথা। তাই সেই সময়ের কিছু পণ্ডিত ‘মুড্ডুপালানিকে বেশ্যা উপাধি দিয়ে ছাড়েন। তার সম্পর্কে লেখা হয়- ‘ও যা লিখেছে, তা কোনও মেয়ের লেখা তো দূরের কথা, পড়া, এমনকি ভাবাও হলো এক প্রকার অ-সতীপনা।’

এই টালমাটালের কারণে, ভিক্টোরিয়ান মরালিটি-পীড়িত ইংরেজ সরকার সেই ‘সনাতন ভারতীয় কাব্য’টি নিষিদ্ধ করে দেয়।

শেয়ার করুন: