আমরা যারা একলা থাকি-৩৬

imp 1উইমেন চ্যাপ্টার: কি নিয়ে লিখি, পুরুষ বন্ধু-সহকর্মীরা বলে, আমাদের কথা লিখো না কেন? আর সমাজের নানান অবস্থানের মেয়েরা বলে, আমাদের কথাও লেখ। জীবন তো একটা গল্প বা উপন্যাসের মতোনই। পাতা যত উল্টাবে, গল্প ততোই দীর্ঘায়িত হয়। তাহলে কি পাতা উল্টানো বন্ধ থাকবে? না, পাতায় পাতায়ই তো চমক। কখনও উত্থান, কখনও পতন। তবে আমি বসে ভাবি, একেকটা গল্প হৃদয় খুঁড়ে, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিয়ে যায়, এসব লিখে লাভ কী?

অনেকদিন ধরে ভেবেছি, একলা থাকা নারী বা পুরুষকে সমাজ মেনে নিতে চায় না কেন? ওরাই বা কেন এতো কুণ্ঠিত হয়ে থাকে? বাঁচতে পারে না দাপট নিয়ে? সমাজকে তোয়াক্কা না করলেই বা কী? কিন্তু সবাই পারে না। যারা পারে, তাদেরকে সমাজ একভাবে ‘শাসন’ করতে না পেরে অন্যভাবে শাসন করতে চায়ই চায়। এখানে সমাজ মানে গুটিকয় মানুষ। ওরা নিজেদের পরাক্রমশালী ভাবে, কারণ আমরা তাদের সেই সুযোগটা করে দিয়েছি। লাগাও উত্তম-মধ্যম, দু’একটা কেস ঘটাতে পারলেই কেল্লা ফতে। হয়তো তসলিমা নাসরিনের ভাগ্যও বরণ করে নিতে হতে পারে। কিন্তু ভয় কেন মেয়ে?

গতকাল সাবরিনা নামের একটি মেয়ের গল্প শুনছিলাম। যে গল্পটা করলো, সেও একজন একলা থাকা পুরুষ। সে নিজেই বললো, একলা হওয়ার পর থেকে সে কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে যায় না, বিয়েতে তো যায়ই না। কারণ কি? কারণ সে নিজেই। নিজেকে সে দুর্ভাগা (পক্ষান্তরে অলক্ষী) ভাবে, যদি নতুন জীবন শুরু করতে যাওয়াদের ওপর তার জীবনের কু-প্রভাব পড়ে? আমি শুনে হাসবো না কাঁদবো, বুঝে উঠতে পারি না। হায়রে মানুষ, এখনও তুই ‘মানুষ রতন’ চিনলি না! বলছিলাম সাবরিনার কথা।

তো, সাবরিনা এসেছে লন্ডনের সেই অফিসে। বাড়িতে তার ছোট ভাইয়ের বিয়ে। আর সে পরিবারের বড় এবং ডিভোর্সি। কাজেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এখানে-সেখানে ঘুরে টাইম পাস করছে। সে যখন বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে, বাড়ির কেউই, এমনকি মা-ও কোন আপত্তি তোলেননি। ভাবখানা এমন যে, তুমি এই সময়টাতে বাড়িতে না থাকাই মঙ্গল। নতুন মানুষজন আসবে, তাদের অনন্ত কৌতূহলের উত্তরও দিতে হবে না, কেউ যদি তাকে কুলক্ষণা ভাবে, সেই অবকাশও রইলো না। তাই সাবরিনা কাল গোটা লন্ডন ঘুরে বেড়িয়েছে।

আমি গল্পটা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, কোলাহল শেষে এই বাড়িটাতেই তো ফিরে যাবে সাবরিনা। এমন অজস্র-অসংখ্য সাবরিনারা এভাবেই ফেরত যায় বাড়িতে, মায়ের কাছে, ভাই-বোনের কাছে। তারাও ‘কিছুই হয়নি’ এমন ভাব নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে জীবন চালিয়ে যায়। কিন্তু একটিদিনের জন্য হলেও সাবরিনার মনে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, সেই খবর জানা হয় না কারও। জানবে, যখন সেই ক্ষত একদিন গ্যাংগ্রিনের আকার নেবে। সমাজের এসব ছোট ছোট ক্ষত একদিন মহামারীতে রূপ নেয়, সমাজ তা জানতেও পারে না। ভাবে যে, মূল্যবোধ আর নৈতিকতার অধ:পতন ঘটেছে। কিন্তু যে মানুষগুলো পরোক্ষভাবে এই অধ:পতন ঘটায়, তারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। জানি না, স্বর্গ-নরক আছে কিনা, জানি না মরণের পরে কোনো বিচার আদৌ আছে কিনা, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব ‘ক্ষত’ সৃষ্টিকারী মানুষগুলোর অসহায়-কাতর, পাপবিষ্ট মুখটা দেখে যেতে চাই এই জীবনেই।

সাবরিনার প্রসঙ্গ জানতে গিয়ে মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে আমাদের বাড়িতেও বিয়ের আসর বসেছিল। বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হচ্ছে। কিন্তু কোনো মাঙ্গলিক আচারেই আমাকে রাখা হয়নি। বিয়েতেও বলা হয়নি প্রথমে। পরে নেহায়েতই খারাপ দেখায়, সেজন্যই নেয়া। বুঝতে পারছিলাম না বলে সব জায়গায় আমার অবস্থান কারও কারও দৃষ্টিকটু ঠেকছিল। আড়ালে-আবডালে আমাকে নিয়ে কানাঘুষা চলছিল। আমার ছেলের নজর এড়ায়নি তা। সে আমাকে পাশে ডেকে নিয়ে বলায় সম্বিত ফিরে পাই। সরে যাই সব যজ্ঞ থেকে। শুধুমাত্র যাওয়ার আনুষ্ঠানিকতাটুকু সেরে চলে এসেছিলাম সেবার। আর যাওয়া হয়নি। এমনকি আমার মায়ের শ্মশানেও না। এরপর থেকে ওইবাড়িতে আমার যাওয়াই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। হতে পারে, উপচে পড়া সো-কলড সুখের সংসারে আমাকে অনাহুত রাখতে পারলেই তাদের মঙ্গল, কে জানে?

সাবরিনার গল্পটা যিনি করছিলেন, তিনি নিজেও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন সামাজিকতার বন্ধন থেকে। সব শুনে একটা কথাই বললাম, তোমরা যারা বিদেশে থাকো, তোমরা আসলে পশ্চিমা দেশেই থাকো শুধু, পারিবারিক শিক্ষার অপরিপক্কতাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারো না। নইলে এতো এতো বছর বিদেশে থেকেও কেন সেখানে এমন আচরণগুলোর চর্চা হবে?

তবে এইটুকুই বুঝি, বন্ধুদের একা থাকার গল্পগুলো পড়ে বুঝি যে, বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকি না কেন আমরা, গল্পগুলো আমাদের একই। কষ্টের রংগুলোও একই হয়। কেউ কেউ একসময় সেই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ পাই, কেউ পাই না। যখন খুব কাছের কোনো বন্ধু বলে, নাহ, সংসারটা আর টেকানো গেল না। একসময়ের পরম বন্ধু স্বামী হওয়ার পর যখন নির্জন জায়গায় গিয়ে অফার দেয় অন্য কারও সাথে সেক্স করতে এবং সে এটা দেখে উপভোগ করবে বলে, তখন লা-জওয়াব হয়ে যাই সেই গল্পে। এ যে গল্পকেও হার মানানো আরেক গল্প।

বন্ধুর মলিন মুখটা ভেসে উঠে। ইচ্ছে করে, কোথাও চলে যাই, দূরে কোথাও। একটা বিশাল বাড়ি হবে অনেক জায়গা জুড়ে। সেখানে থাকবো আমরা এই মানুষগুলো। একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে ইচ্ছে হলে কাঁদবো, ইচ্ছে হলে হাসবো। একা কোথায়, অনেকে অনেকে মিলে আমরা সব একাকার হয়ে যাবো। (চলবে)

 

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.