আলোতে মুক্তির পথ অনেক দূর

Keka
কেকা

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা: রাত যত বাড়ছে, মনটা ক্রমেই বিষন্ন্ হচ্ছে । বারবার মনে হচ্ছে সেই মেয়েটি কি খেয়েছে ? নাকি অপমানে লজ্জায় আর শরীরের অসহ্য ব্যথায় একলা ঘরে পড়ে কাতরাচ্ছে আর কাঁদছে! অপেক্ষা করছে, স্বামীর। ভাবছে এই বুঝি স্বামী কাছে এসে আদর ভালোবাসায় কাছে টেনে নেবে। স্বামী আর তার স্বজনেরা মিলে তাকে যেভাবে অপমান করেছে, মারধর করে জীবনকে দু:সহ করেছে তার জন্য ক্ষমা চেয়ে মান ভাঙিয়েছে। পরম মমতায় মুখে তুলে দিয়েছে রাতের খাবার। তেমনটা আদৌ ঘটছে কিনা তা জানার বড্ড ইচ্ছা থাকলেও বাস্তবে তা ঘটেছে কিনা তা আর জানা হয়নি।

রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বা এর কিছু আগে। অফিস শেষে বাচ্চার ওষুধ ও চশমা (বাচ্চার চোখ উঠায় স্কুলের জন্য কালো চশমা) কিনে বাসায় ফিরতেই মোবাইল বেজে উঠল। বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে বলতেই ফোন ধরলাম। কিন্তু ফোনে কথা নয় শুনতে পেলাম আকুল-কান্নায় ব্যাকুল এক নারীকন্ঠ। হাপুস হয়ে কাঁদতে কাঁদতেই তার নাম জানিয়ে নারী নির্যাতন রোধে সহায়তাকারী যে কোন একটি সংস্থার নাম্বার চাইলেন সেই নারী । তাৎক্ষণিকভাবে তাকে কোন ফোন নম্বর দেবো, বা কি করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তাছাড়া বাচ্চারা কি মজা এনেছি তা পেতে এত বেশি হইচই করছিল যে, ওই নারীর কান্নার তীব্রতায় ঠিকমত কথা বলতে না পারায় বুঝতেও পারছিলাম না কিছু । পরে মনে হলো একটি নারী এই রাতে কি ধরনের সমস্যায় পড়েছে তাকে সাহায্য করা উচিত।

হঠাৎই কি মনে করে প্রথম আলোর বন্ধু মানসুরাকে ফোন করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তরের নারীদের সহায়তার ১০৯২১ নম্বরটি নিয়ে ঐ নারীকে জানালাম। নিজেও ঐ নম্বরে ফোন করে বিপন্ন্ এক নারীকে সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করলাম। কিন্তু আশ্চর্য ভিকটিমকেই ফোন করতে হবে। সংস্থার তরফে ফোন করার নিয়ম নেই জেনে আরো একবার চরমভাবে বিপন্ন বোধ করলাম।

আর তিনি ঐ নম্বরে ফোন করে হয়তো কোন সাড়া না পেয়ে আমাকেই ফোন করে তার অসহায়ত্ব ও নির্যাতনের কথা জানালেন। কথার বাচনে ভদ্র -শিক্ষিতের টান। সেই তিনি প্রচণ্ড ব্যথা আর কান্নার দমকে যা বলবেন তা জানার পর মনটা এত এত বিষন্ন হলো ! মায়ের অসুস্থতায় মার পাশে থাকার জন্য অার্জি জানিয়েছিল সেই নারী । আর ছোট বোনের বিয়েতে যাবার জন্য স্বামী ও তার পরিবারের কাছে অনুমতি না পাওয়াই শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। তারই জেরে স্বামীকে অফিস থেকে ডেকে এনে স্বামী আর সবাই মিলে আচ্ছা মতো পিটিয়েছে দুই বাচ্চার এই মাকে।

এত লজ্জা পেলাম…কুন্ঠিত হলাম….! আবারো আরো এক দফা আমাকে ফোন করলেন। বার বার তার একই আকুতি, তার মা’র অবস্থা খারাপ । মায়ের কাছে যাওয়া, আর ছোট বোনের বিয়েতে যেতে চাওয়ায় তাকে সবাই মিলে পিটিয়েছে। কথার ধরনে মনে হলো এরকম মারধর নতুন নয়, তবে আজকে তার সীমা ছাড়িয়েছে। দুই বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে পাশের রুমে বসে আছেন স্বামী আর তার পরিবারের সবাই। আর একলা ঘরে নির্যাতিত হয়ে লজ্জায়-দু:খে-অসহ্য ব্যথায় অসহায় সেই নারী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। বলছেন, আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, আর এদিক-সেদিক ফোন করছেন সাহায্যের আশায়। কবে কথন কোন একদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি আমার নম্বর পেয়েছিলেন সেই সুবাদেই আমাকে ফোন দিয়েছেন।

সাংবাদিতকার সুবাদে অনেক নির্যাতন-সহিংস ঘটনা দেখেছি, রিপোর্ট করেছি। স্বভাববশত এ্কটি ঘটনা বিভিন্ন এঙ্গেলে দেখা, বিশ্লেষণ করা, সন্দেহ করা স্বভাবজাত। এঘটনারও নানা বিশ্লেষণ করে আজকে এতোটা ধাক্কা খেলাম ! ! মনটা ভেঙ্গে গেলো। মনে হলো এখনো কত পথ বাকী , এদেশে নারীর সম্মান রক্ষা-অধিকার প্রতিষ্ঠায়, একান্ত ঘর, কাছের প্রিয়জন অনেকেই ন্যুনতমও পরীক্ষিত নয়।

বাচ্চাদের সামনে মায়ের এই হাল। বাচ্চাদের বয়স কত তা জানি না্, কিন্তু এই বাচ্চাদের মনোদেহিক স্বাস্থ্য, প্রতিক্রিয়া-মনোভাব-তাদের বেড়ে উঠা সবই যে অন্ধকারময় তা আর বলতে হয় ?

বুনো, গোয়ার, হিংস্র তালেবানদের কবল থেকে বেরিয়ে একটু অালোর জন্য মালালারা উপত্যকায় উপত্যকায় মুক্তির মিছিলে জড়ো হয়, সংগ্রাম করে, গুলিবিদ্ধ হয়, আাবার নোবেলও পায়, আর একই পৃথিবীর সবুজ সমতলে মনের কালিমায়-অশিক্ষায় আমরা স্বামীরা-মায়েরা-বাবারা-মেয়েরা-বোনেরা-ভাইয়েরা-(ননদ-দেবর) হিংস্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি অসহায় এক নারীর উপর । লজ্জা-লজ্জা আর অসহায়ত্বের কান্নায় বাকরুদ্ধ হই ! ! আজকের রাতটা কেন এত দীর্ঘ হায় !

লেখক: সাংবাদিক

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.