উইমেন চ্যাপ্টার: গৃহস্থালি কাজে সম্পৃক্ত নারীদের এখন থেকে গৃহিনী না বলে গৃহ-ব্যবস্থাপক বলার দাবি জানিয়েছেন বক্তারা। তাদের মতে, নারীর গৃহস্থালি কাজকে মূল্যায়ন করা হলে নারীর প্রতি বৈষম্য, সহিংসতা অনেকাংশে কমে আসবে।
শনিবার ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডাব্লিউবিবি) ট্রাস্ট এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় আলোচকবৃন্দ উপরোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন।
তারা বলেন, গৃহস্থালি কাজের মাধ্যমে পরিবারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন নারী। এমনকি যেসব নারী পারিশ্রমিক বা সম্মানির বিনিময়ে বাইরে কাজ করেন তারাও পরিবারের যাবতীয় কাজের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। নারীর এ অবদানকে জিডিপিতে অন্তর্ভূক্ত করে গৃহস্থালি কাজকে সম্মান জানানো এবং পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে যুক্তদের গৃহিনীর পরিবর্তে গৃহ ব্যবস্থাপক হিসাবে পরিচয় তুলে ধরার জন্য আহবান জানান তারা।
সংস্থার সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় আলোচনা করেন উবিনীগ-এর নির্বাহী পরিচালক ও তামাক বিরোধী নারী জোট এর আহবায়ক ফরিদা আখতার, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ ও গবেষক জুলিয়া আহমেদ, কানাডাভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন হেলথ ব্রিজ এর আঞ্চলিক পরিচালক দেবরা ইফরমসন, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট জেষ্ঠ্য প্রকল্প কর্মকর্তা নাজনীন কবির, কারিতাস বাংলাদেশ এর কর্মকর্তা জুলিয়েট লিপিকা সরকার প্রমুখ। এতে সভাপতিত্ব করেন সংস্থার পরিচালক এডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম।
ফরিদা আখতার বলেন, নারীকে গৃহিনী হিসাবে তুলে না ধরে গৃহ ব্যবস্থাপক হিসাবে তুলে ধরতে হবে। যেসব নারী গৃহে কাজ করেন, তাদেরও অনেকের ধারণা ‘তারা কিছুই করে না’। এ ধারণা বদলাতে হবে। নারীর গৃহস্থালি কাজকে যেহেতু জাতীয় নারী নীতিতে স্বীকার করা হয়েছে-তাই এ লক্ষ্যে সরকারি পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। নারী গৃহস্থালি কাজের গুরুত্ব ও গৃহস্থালি কাজের মাধ্যমে পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অবদানকে গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন। আমরা চাই, রাষ্ট্র যেন নারীর গৃহস্থালি কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে নারী উন্নয়নে ইতিবাচকভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
নাজনীন কবির বলেন, পরিবারের সবার জন্য খাবার তৈরি, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা, শিশু ও বৃদ্ধদের সেবা প্রদান, পাঠদান, শিশুদের বিদ্যালয়ে আনা-নেয়াসহ গৃহস্থালিনির্ভর ৪৫ রকমের কাজে প্রতিদিন গড়ে ১৬ঘন্টা সময় ব্যয় করেন নারী। সময় ও কাজ হিসাবে নারীর গৃহস্থালি কাজের অর্থমূল্য রয়েছে। সারাদেশে নারীদের অবদানকে ১৬ঘন্টার সময়কে ৮ঘন্টার অর্থমূল্যে মাঝারি মানের সরকারি কর্মকর্তার সঙ্গে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১২ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীদের গৃহস্থালি কাজে যে অবদান রাখছে তার আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ২২৭.৯৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার (১৮২৩৪.৮১ বিলিয়ন টাকা) থেকে ২৫৮.৮২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। যা বাংলাদেশের জিডিপির দ্বিগুণেরও বেশি। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের জিডিপি’র পরিমাণ ছিল ১১৮.৭ বিলিয়ন ডলার।
জুলিয়া আহমেদ বলেন, নারীর গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন যদি জিডিপিতে অন্তর্ভূক্ত করার মাধ্যমে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়, তবে নারীর প্রতি পরিবার-সমাজ ও রাষ্ট্রের নারীর প্রতি নেতিবাচক ধারণার পরিবর্তন হবে। এবং নারীর গৃহস্থালি কাজের মূল্যায়ন সম্ভব হলে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রে নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসবে। দেবরা ইফরমসন বলেন, নারী বাইরে কাজ করবে, অর্থ উপার্জন করবেÑতবেই তাকে গুরুত্ব দেয়া হবে- এ ধরণের চিন্তা নেতিবাচক। কারণ, সন্তান গর্ভধারণ ও শিশু সন্তানের লালনপালনের মত গুরুত্বপূর্ণ কাজ অন্য কোনটি হতে পারে না। একজন শিশুসন্তান যদি ভাল ও দক্ষ মানুষ হন, তবে তিনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে ভূমিকা রাখতে পারেন। এবং একজন সন্তানের দক্ষতা গড়ে উঠে যদি মা তার পরিচর্যা ঠিকমত করার সুযোগ পান।
সৈয়দ মাহবুবুল আলম বলেন, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ গৃহস্থালি কাজে নারীদের যে অবদান জাতীয় অর্থনীতিতে তার গুরুত্ব ও অবদান খুঁজে বের করার জন্য ২০০৬ সালে প্রথম গবেষণা করে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। ফলে ‘নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’-তে নারীর গৃহস্থালি কাজের গুরুত্ব অনুধাবন করার কথা বলা হয়। এ ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। নারীর অবদানকে জিডিপিতে অন্তর্ভূক্ত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে।
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন উবিনীগ এর পরিচালক সীমা দাস সীমু, ডাব্লিউবিবি ট্রাস্ট এর পরিচালক গাউস পিয়ারী মুক্তি, প্রকল্প সমন্বয়ক আমিনুল ইসলাম সুজন ও ন্যাশনাল এডভোকেসি অফিসার সৈয়দা অনন্যা রহমান।