সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: আড্ডাটা জমেছিল পানশালায়। এ জাতীয় জায়গার, এরকম আড্ডার কি মূল্য আদৌ আছে? কিন্তু মনে হলো আছে। না হয় আরেক দফা সুপ্রীতির উইমেন চ্যাপ্টারেই অনলাইন বিতর্কটা হোক। বা না হোক।
আড্ডা চলছে, খানা-পিনা চলছে। হঠাৎ একজন নারী বললেন, সময়টা এখন বিশ্বাসহীনতার। আমরা ক্রমেই এই অবিশ্বাসের অন্ধ-গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছি।
সবার চোখ তার দিকে। তার যুক্তি হলো সারাক্ষণ কি দিশেহারা আতঙ্ক, অবিশ্বাস আর সন্দেহ নিয়ে নিত্যসহচর পুরুষকে পাশে নিয়ে বাঁচা যায়? পরিচিতজন, নিকটতম আত্মীয় কেউতো আমাদের ছাড়তে চাইছে না, ধর্ষণের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। তাহলে আগামী দিনে নারী-পুরুষ সম্পর্কের ধারণাই কি পাল্টে যাবে? তিনি বলতে থাকলেন এক সাথে আনেক কাহিনী কোথায় বন্ধু-বন্ধুকে, মামা-ভাগ্নিকে, এমনকি শ্বশুর-পুত্রবধূকে লাঞ্ছিত করেছে।
আলোচনার এই পর্বে হঠাৎ হাতের গ্লাসটি টেবিলে একটু শব্দ করে রেখেই একজন পুরুষ আড্ডাবাজ বলে উঠলেন, সমস্যা হলো সামাজিক উৎসব থেকে শুরু করে সাধারণ কাজকর্মে, সর্বত্রই নারীবাদিরা আজ পুরুষতন্ত্রের ভূত দেখতে পাচ্ছেন।
তার কথার প্রতিবাদ আসলো দু’দিক থেকেই। যুক্তি হলো সমস্যাটি প্রকট আকার নিচ্ছে। তাকে আড়াল করা যায় না। কারণ, সমাজে আগে যেমন ছিল, এখন আরো পোক্ত হয়েছে ধারণাটি যে, নারীমাত্রই যৌনতার প্রতিরূপ। তাইতো নারীর সঙ্গে নারকীয়তা বাড়ে, খবরের শিরোনাম হতে থাকে মর্মান্তিক সব ধর্ষণের ঘটনা।
আমরা কথায় কথায় বলি জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, তাকে বাদ দিয়ে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনাই সম্ভব না। আমাদের দীর্ঘ ইতিহাস আছে দুই নেত্রীর শাসন। কিন্তু নিগ্রহের ভয়ানক সামাজিক প্রবণতা থামে না। এর দহনে ক্ষয়ে যেতে থাকে কন্যা-জায়া-জননীদের সব শক্তি, সঞ্চিত সব অঙ্গীকার। তারা কুঁকড়ে যেতে থাকে ভীষণভাবে।

সাংবাদিকতার জীবনে কত রিপোর্ট করলাম কত ধর্ষণের। আমার রিপোর্টাররাও কত রাত জেগে, কত পরিশ্রম করে, কতটা দক্ষতার সাথে বের আনে কত সব নিগ্রহের খবর। কিন্তু আইন আর সামাজিক ধারণার বলি হয় সবকিছু। মেয়ে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করলে তার কথার যাবতীয় সত্যতা প্রমাণের দায়তো গিয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত তার ওপরই। আর থানা প্রাঙ্গন থেকে, আদালত চত্বর আর নিজের পরিবার পরিজনে, সবার কণ্ঠেই উচ্চারিত হতে থাকে ‘বাজে’ ‘খারাপ’ ‘নষ্ট’ এ জাতীয় বিশেষণগুলো।
আমরা পুরুষরা, এমনকি মেয়েরাও ক্ষেত্রবিশেষে মেয়েদের লজ্জিত দেখতে ভালবাসি। মনে করি এটাই স্বাভাবিক। তাই শত সহস্র ধর্ষণের অপরাধ কত অনায়াসেই না হারিয়ে যায় ধর্ষিতার লজ্জায়। সমাজের এই দুঃসহ প্রশ্রয় আরো মাথাচারা দিয়ে উঠে যখন দেখি কোন এক সচিব বলেন, জিন্স-প্যান্ট আর, টি-শার্ট, পলো শার্ট পড়া মেয়েদের রাতের বেলায় রাজধানীতে নিরাপত্তা দেয়া সম্ভব নয়। সমাজের এমন নিরাবরণ প্রকৃতি তো প্রকারান্তরে সেইসব পুরুষকেই উৎসাহিত করে। তারা ভাবে কখন সুযোগ মিলবে তাদের সেই মাহেন্দ্রক্ষণের।
বড় সরকারি কর্তার এমন বাণী সবাইকে বারবার মনে করিয়ে দেয় নারীর কেবল আছে শরীরটুকু আর তাকে ঘিরে পুরুষের থাকবে আদিমতার উল্লাস। ভোগের এমন উৎসবে তাই কেউ বাদ যায় না তা সে হোক সপ্রতিভ স্মার্ট তরুণী, বাস যাত্রী, পোশাক কারখানার কর্মী বা নিরীহ গৃহবধূ।
বয়সতো কোন বাধাই নয়, পাঁচ বছর বা তার কম হলেও। কারও নিস্তার নেই। আর তাই পরিবারগুলো স্বস্তি খোঁজে তাদের মেয়েদের শুধু শাসনে।
আড্ডায় এবার প্রশ্ন উঠে, তাহলে সমাধান কোথায়? কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে যিনি বয়স্ক, তিনি বলেন, মেয়েরা ‘ভয়কে জয় কর’, নয়তো আরও ‘ভয়’-এর দিন তোমার সামনে।
লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন