
তানিয়া মোর্শেদ: দেশের মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম নিয়ে কথা বলা, প্রশ্ন করা যাবে না! অন্য ধর্ম নিয়ে কথা বলা এমনকি বিদ্রুপও করা যাবে! অন্য ধর্ম, ধর্মস্থান, ধর্মীয় রীতিনীতি নিয়ে যা ইচ্ছে বললেও, উপাসনালয়, প্রতিমা, বুদ্ধ মূর্তি ভাংগলেও কিছুই হবে না! শুধু ইসলাম নিয়ে একটি কথাও নয়! সব একদম চুপ! ধর্মানুভূতি আছে শুধু মুসলমানদের, আর কারো নয়!
প্রায় সব ধর্মেই এক সময় একই অবস্থা ছিল। কম বা বেশী। তবে তা কয়েশ বৎসর আগে। ভারত উপমহাদেশে এখনো ধর্ম নিয়ে কথা বলা মানে সবচেয়ে বড় অপরাধ করা! মানুষ যুগে যুগে তার জিজ্ঞাসু মন নিয়ে প্রশ্ন করেছে, তর্ক করেছে, চিন্তা করেছে। মানুষের বিবেক যখন বুঝেছে এককালে ধর্মের সৃষ্টির সময় হয়ত যা পালন করা, বিশ্বাস করতো মানুষ তা এখন মানবিক নয় (মানবিক কখনোই ছিল না, মানুষ তখন ভাবতো না) এবং তা পালন করা যায় না তখন থেকে সে সব রীতিনীতি বন্ধ হয়েছে পালন করা। এখনো উইচ হান্টীং আর হয় কি ইউরোপের কোনো দেশে? সতীদাহ? একদল মানুষ বুঝেছেন এ অমানবিক, আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আইন করবার আগে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টাও হয়েছে, তবে ধর্ম এমনই একটি স্পর্শকাতর জিনিস যে শুধু সচেতনতা সৃষ্টি দিয়ে তা সম্ভব হতো না। বাল্য বিবাহ কি ধর্মে নিষিদ্ধ? আইন করে তা বন্ধ করতে হয়েছে। যদিও মেয়েদের বয়স কেন আবার ষোলতে নামানো হয়েছে তা এক বিস্ময়! যেখানে বলা হচ্ছে যে, কুড়ি বৎসরে আগে গর্ভধারণ অত্যন্ত ঝুঁকি পূর্ণ সেখানে কেন কুড়ি না করে উল্টো ষোলতে নামা?! ষোলতে একটি মেয়ে তো শারীরিক মানসিক ভাবে প্রস্তুতই নয়। সে তো প্রাপ্তবয়স্কই নয়! এ কাদের জন্য, কাদের খুশী করবার জন্য?!
শরিয়া আইনে নারীর যে স্থান তা কতটা অমানবিক তা বুঝবার জন্য কি নারী হয়ে জন্মাতে হয়?! ধর্ম নিয়ে কথা বলতে গেলেই তেড়ে আসে মানুষ! অথচ এরা কি একবারো ভাবে না “নারী” নামের তাদের স্বগোত্রীয়ের কথা? স্ত্রী শয্যাসংগী হতে না চাইলে পিটানোর কথা বলা আছে! একাধিক স্ত্রীর অনুমতি আছে! আছে বিধর্মীদের হত্যার কথা। মূর্তি ভাংগার কথা।
শেষের দুটো বাক্য বিষয়ে বলবেন, কোরানের লিট্যারাল মিনিং করো কেন? এসব তো কয়েক শ’ বৎসর আগে ঘটেছিল। বিবেকবান মানুষ যেমন বুঝছেন, এগুলো করতে নেই, বাকীরা কি তা বুঝছেন? যারা লিট্যারাল মিনিং করেন, স্ত্রীকে বিছানায় পাবার জন্য পিটানো যায়, তারা যদি এটাও ভাবেন বিধর্মীদের হত্যা করা যায়, তাহলে দোষটা কি শুধু তার?? সবার বিবেক তো এক নয়। কে টানবে সীমারেখা, কোনটা এখনকার আর কোনটা শুধুই ধর্ম সৃষ্টির সময়কার? আর যে দেশে কোনো কথাই বলা যাবে না সেদেশে কি ভাবে বোঝাবেন ধর্মান্ধ-মৌলবাদী পরের কথা একজন তথাকথিত “সাধারণ” ধার্মিককে? উন্নত সমাজ ব্যবস্থার দেশগুলো এসব বেশ আগে পার হয়েছে। তারাও এক সময় ধর্ম বিষয়ে কোনো প্রশ্ন শুনতো না।
ধীরে ধীরে মানুষ প্রশ্ন করা, ভাবা শুরু করেছে, যখন বেশ কিছু মানুষ ভেবেছে তখন আইন তৈরী হয়েছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের যেতে হবে আরো অনেক অনেক দূর। দুঃখজনক যে রাজনীতি এর মধ্যে জড়িয়ে আরো জটিল থেকে জটিলতর করেছে/করছে তা!
ধর্ম নিয়ে কিছু বললেই, হোক তা নারীদের অবস্থান, হোক তা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আইসিস বা অন্যান্যদের হাতে অমুলিমদের বা মুসলিমদের শিরঃচ্ছেদ, পাথর ছুঁড়ে নারী হত্যা, ধর্ষিতাকে উল্টো শাস্তি হিসাবে গণধর্ষণ, চূড়ান্ত অপরাধ! একই অপরাধ অন্যরা করলে কথা বলা, লেখা, মিছিল, প্রতিবাদ সব করা যাবে (অবশ্যই যাবে এবং করা উচিৎ)। কিন্তু যদি মুসলমানরা করে এবং ধর্মের দোহাই দেয় তখন কিছু বলা যাবে না। এবং কেন ধর্মের দোহাই দিচ্ছে (ধর্মগ্রন্থে তা আছে) বলেছেন কী খবর আছে! তথাকথিত শিক্ষিত ও ভদ্র হলে বুঝাতে কোমড় বেঁধে লাগবে, প্রশ্নকারী ভুল। ধর্মগ্রন্থের লিট্যারাল মিনিং কেন করছে? ধর্মকে স্পিরিচুয়ালিটির সাথে মিশিয়ে সুশীলদের মত ত্যানা প্যাঁচাবে!
কথা হচ্ছে ধর্মগ্রন্থে আছে, বিধর্মীদের হত্যা থেকে আরো অনেক কিছু। আছে যুদ্ধে পরাজিতদের নারীদের নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়াসহ আরো অনেক কিছুই। এখন ক’জন বুঝবে তা এখন চলবে না! মুসলমানদের বিরাট একটা অংশ কোরাণের সব মেনে সত্যিকারের মুসলমান হতে চায়। মানা মানে আক্ষরিক ভাবে মানা, “স্পিরিচুয়ালি” নয়! সেজন্য দেখা যাচ্ছে দিনে দিনে হিজাব, বোরখা, নেকাব পড়া নারীর সংখ্যা চরম ভাবে বেড়ে চলেছে। বেড়ে চলেছে জিহাদের নামে বিধর্মীদের হত্যা, বিধর্মীদের দেশে আক্রমণ।
এখানে বলবেন, এটার সাথে বিশ্ব রাজনীতি জড়িত। অবশ্যই জড়িত। কিন্তু মাটি যদি নিজে তৈরী না থাকে সেখানে কি জঙ্গীবাদের আদল দেওয়া সম্ভব?! সব দোষ, ষড়যন্ত্র পশ্চিমাদের যারা বিশ্বাস করেণ তারা নিজেদের কি ভাবে বোঝান যে, ধর্মগ্রন্থের লিট্যারাল মিনিং করতে নিষেধ নেই যেখানে, যেখানে কোরাণের সব নিয়ম মেনে চলা মানুষকে প্রকৃত মুসলমান, ভীষণ ভালো মানুষ হিসাবে দেখা হয় সেখানে পশ্চিমাদের কতটা কষ্ট করতে হয়? আর প্রকৃত মুসলমান, ভীষণ ভাল মানুষ এগুলো শিক্ষিত সমাজেই চালু বেশী। জিহাদী মানুষগুলোর অনেক বড় অংশ শিক্ষিত, অনেকে উচ্চশিক্ষিত।
অশিক্ষিত, দরিদ্রদের মগজ ধোলাই করা অনেক সহজ ধর্মের দোহাই দিয়ে তা সবারই বুঝবার কথা। কেন একটা বড় অংশ শিক্ষিত? বেকার সমস্যা, বর্ণবিদ্বেষ ইত্যাদি প্রসংগ আনবেন। বেকার নেই অন্য ধর্মের মানুষদের মধ্যে? বর্ণবাদের শিকার হন না অন্য ধর্মের মানুষরা? তারা কেন জিহাদ করছেন না? আবারো রাজনীতি আসবে। অবশ্যই আসবে। কিন্তু একক ভাবে বিশ্ব রাজনীতিকে দায়ী করে ধর্মের প্রশ্নবিদ্ধ অংশকে এড়িয়ে যাওয়া মানে কম্ফোর্ট জোনে বাস করা। নিজে মর্ডাণ মুসলিম (প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় পালন না করে) হয়ে ইসলামের মর্ডাণ লুক দেওয়া ইসলাম অনুমতি দেয় না।
যতই ভাবুন না কেন, ইসলামের অপব্যাখ্যা করছে জংগীরা, ইসলাম শান্তির ধর্ম, লিট্যারাল মিনিং করা যাবে না ইত্যাদি, তখনো কোথাও না কোথাও কারো শিরশ্ছেদ, কারো জীবনাশের ফতোয়া, কাউকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা, কাউকে ধর্ষণ, গণধর্ষণ, স্কুলের মেয়েদের অপহরণ করে যৌনদাসী বানানো সব চলছে। আর কিছু মানুষ তখন লিপ্ত আছে, ইসলাম কত শান্তির ধর্ম বা ইসলাম নারীকে সর্ব্বোচ্চ মর্যাদা দিয়েছে, বা নাস্তিক মানেই নিকৃষ্ট জীব, ধর্মের পথে থাকা মানেই তার মোর্যাল সবচেয়ে বেশী, ধর্মহীন মানুষ হচ্ছে সবচেয়ে অনৈতিক, ধর্ম হচ্ছে মানুষকে স্পিরিটুয়াল করে ইত্যাদি ইত্যাদি বকবকানি, ঠকঠকানি (টাইপিং) -এ ব্যস্ত! যার কোনো অর্থ নেই শিরঃচ্ছেদ হওয়া মানুষটির প্রিয়জনদের কাছে, নেই গণধর্ষিত হওয়া (শাস্তি হিসাবে) নারীর কাছে বা পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা নারীর প্রিয়জনদের কাছে। অনেক আগেই সময় হয়েছে ডিন্যায়াল ছেড়ে, কমফোর্ট জোন ছেড়ে সঠিক পথে আসার। যার শুরু প্রশ্ন করা দিয়ে।