‘তোমরা শার্ট-প্যান্ট পরো কেন’?

Probhash da
প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন: পত্রিকায় খবর এসেছে, মোহাম্মদপুর জাকির হোসেন রোডে মোহনা ভিআইপি ছাত্রী হোস্টেলে সোমবার রাত ১১টায় স্থানীয় বখাটেরা হামলা চালিয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ কোনো গা করেনি।

পুলিশ গা করবে কেন, ঐ হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়ক রাবেয়া মনে করেন, এই হামলা যৌক্তিক। তিনি উল্টো ছাত্রীদের ওপর চড়াও হয়েছেন, ‘তোমাদের চলাফেরায় সমস্যা আছে। হামলা তো হবে। তোমরা শার্ট প্যান্ট পরো কেন?’

মেয়েরা শার্ট প্যান্ট পড়লেই বখাটেরা হামলা করতে পারে, যে হোস্টেলের তত্ত্বাবধায়ক এমন মানসিকতার, সে হোস্টেলের ছাত্রীদের নিরাপত্তা কোথায়? আর এই যদি হয় ছাত্রী হোস্টেলের নিরাপত্তার হাল, তাহলে ঢাকায় হাজার হাজার ছাত্রী, কর্মজীবী নারী বা সিঙ্গেল মায়েরা কই যাবে?

ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দেয়ার পর অনেকে মেয়েদের পোশাক নিয়ে নানা মন্তব্য করেন। অনেকে শালীনতার কথা বলেছেন। ঠিক তাই। আমিও তাই মনে করি। আমি বলছি না সব মেয়েদের শার্ট প্যান্ট পরতে হবে বা শাড়ি-বোরকা পরতে হবে। কোনোটাতেই আমি গোড়া নই। আমার কথা হলো, পোশাক পরবে যার যার পছন্দে, ছেলে হোক আর মেয়ে। তবে পোশাকটা অবশ্যই শালীন হতে হবে, আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। এই যেমন ইদানিং অনেক ছেলে কোমরের অনেক নিচে প্যান্ট পরে। আমার ভালো লাগে না, ভয় হয়, কখন জানি খুলে পড়ে যায়। তবে আমি কাউকে ওভাবে প্যান্ট পরতে বারণ করিনি। কারণ আমার পছন্দ না হলেও, এটা তো তার পছন্দ।

তবে কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছেন, কারো পোশাক পছন্দ না হলে যেন, আমি সেটা মুখের ওপর বলে দেই। কারণ কথা আছে, ‘আপনা রুচি খানা, পরকা রুচি পরনা’। এটা জানি, তবু আমি অন্তত কারো পোশাক পরার স্বাধীনতায়ও হস্তক্ষেপ করতে চাই না।

পোশাকটা আসলে যতটা না ফ্যাশনের, তারচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের। মানুষ পোশাক পরে স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে মিলিয়ে। গরমের দিনে কেউ দামী জ্যাকেট বা স্যুট-টাই পরে ঘুরে বেরালে সবাই বাঁকা চোখে তাকাবেন। যেমন আমার প্রিয় পোশাক জিন্স-টি-শার্ট আর সাথে কেডস। তবে টক শো’তে বসার সময় টি-শার্টটা বদলে নেই। ঢাকা ক্লাবে যেতে হলেও পোশাক বদলে যেতে হয়।

তবে বাংলাদেশে ছেলেদের পোশাক তেমন আলোচনা হয় না, যতটা আলোচনা হয় মেয়েদের পোশাক নিয়ে।

বাংলাদেশের মেয়েদের পোশাক নিয়ে খুব আপত্তিকর তেমন কিছু আমার চোখে পড়েনি। কেউ কেউ গুলশান-বনানীর কথা বলেন। ঐসব এলাকায় আমার খুব একটা যাওয়া হয় না। তাই জানিও না, গুলশান-বনানী এলাকার মেয়েরা কতটা ‘আপত্তিকর’ পোশাক পরেন। তবে আমার মনে হয় না, গুলশান-বনানী মানে উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েরা ‘আপত্তিকর’ পোশাক পরেন। ব্যতিক্রম সব জায়গায় আছে, সেটা হতে পারে গুলশান, হতে পারে গুলিস্তান। ব্যতিক্রমকে উদাহরণ করে মেয়েদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ আনা ঠিক হবে না।

বাংলাদেশের কোনো মেয়েকে আমি কখনো বিকিনি পরে বিচে যেতে দেখিনি। হাফ প্যান্ট পরে কাউকে রাস্তায় ঘুরতে দেখিনি। অথচ পাশ্চাত্যে মেয়েদের অনেকেই অবলীলায় এ ধরনের পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। তাই বলে তো সেখানকার মেয়েরা পথে-ঘাটে ধর্ষিত হয় না। এমন তো নয় যে সেখানকার পুরুষরা অক্ষম। তার মানে ধর্ষনের সঙ্গে পোশাকের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা এক ধরনের অসুস্থতা।

বাংলাদেশে তো বিকিনি বা স্বল্প পোশাকের ব্যাপারে কারো কোনো আপত্তি বা আইনী বাধা নেই। তারপরও তারা পরছে না কেন? কারণ বাংলাদেশের মেয়েরা সীমাটা জানেন।

পোশাকের প্রসঙ্গে কেউ কেউ ধর্মকেও টেনেছেন। আমি মনে করি না পোশাকের সাথে ধর্মের কোনো সখ্য বা বিরোধ আছে। ধর্মের দোহাই দিয়ে যদি আমরা মেয়েদের চার দেয়ালে বন্দী করে রাখি, ক্ষতি তো আমাদেরই। মেয়েদের চার দেয়ালে বন্দী করে রেখে দেশের অগ্রগতি অব্যাহত রাখা যাবে না। বা মেয়েরা যদি সারা শরীর ঢেকে জীবন্ত মমির মত ঘোরাফেরা করে, সেটাই কি শোভন হবে?

বাংলাদেশের মেয়েরা গাড়ি চালায় অনেক আগে থেকেই। এখন বাংলাদেশে অনেক পেশাদার গাড়িচালক আছে। ইদানিং মেয়েরা ট্রেন চালাচ্ছে, বিমান চালাচ্ছে, এমনকি উঠে গেছে জাহাজেও। এখন ধর্মের দোহাই দিয়ে তো আশা করতে পারবো না, কোনো মেয়ে বারো হাত শাড়ি আর তেরো হাত বোরখা পরে বিমান চালাবে। ধর্ম সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য, আটকে রাখার জন্য নয়।

অন্য পেশার কথা জানি না, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে কর্মরত নারী সাংবাদিকরা এসাইনমেন্টে গেলে ট্রাইপড বহন করতে হয়। ইদানিং লাইভ করার জন্য বড়-সড় ব্যাকপ্যাকও বহন করতে হয়। তাই আমার সেই সহকর্মী শাড়ি-বোরখা পরে অফিসে এলে আমি তাকে এসাইনমেন্টেই যেতে দেবো না।

ঢাকায় মাঝে মধ্যে উলঙ্গ নারী বা পুরুষের দেখা মেলে। আমরা তাদের পাগল বলি। তার মানে সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ, তিনি নারী হোন আর পুরুষ, শালীন পোশাক পরেই ঘর থেকে বের হবেন। শালীনতাটাই পোশাকের মূল কথা।

সমস্যাটা আসলে পোশাকে নয়, দৃষ্টিভঙ্গিতে। এর আগে ভিকারুননিসার শিক্ষক পরিমল জয়ধরের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায়ও ছাত্রীর ‘পোশাক’ আলোচনায় এসেছিল। যেন মেয়েরা জিন্সের প্যান্ট পরলেই ছেলেদের ধর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়।

শালীন পোশাক পরে কোনো সুশ্রী মেয়ে হেঁটে গেলে আমি অবশ্যই ফিরে তাকাই, ভালো লাগে। তার মানে তো এই নয়, আমার দৃষ্টিতে কোনো পাপ আছে। দারুণ পোশাক পরা কোনো হ্যান্ডসাম পুরুষকে হেঁটে যেতে দেখলেও তো কখনো কখনো চোখ আটকে যায়। জিন্স পরা মেয়ে দেখলেই ধর্ষণ করতে ইচ্ছা করে, এমন অসুস্থ পুরুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কম, অনেক কম। এখন এই অসুস্থ পুরুষদের কামনা থেকে বাঁচাতে আমরা যদি দেশের সব মেয়েকে বোরখায় বন্দী করে ফেলি, সেটা তো কাজের কথা হতে পারে না। জুতা আবিস্কারের মত রাজার পায়ে যাতে ধুলা না লাগে, তা করতে গিয়ে কি আমরা জগত ধুলা-কাদাময় করে ফেলবো। তার চেয়ে ভালো সেই অল্পসংখ্যক ধর্ষকামী ও বখাটেদের হয় নিজ বাসায়, নইলে হাসপাতালে, নইলে কারাগারে রাখা হোক।

শুরু করেছিলাম, ছাত্রী হোস্টেলের প্রসঙ্গ দিয়ে। এই প্রসঙ্গে দুটি কথা বলেই শেষ করছি। ঢাকায় শুধু যে কর্মজীবী সিঙ্গেল নারীদের সমস্যা তাই নয়, ব্যাচেলরদেরও বাসা ভাড়া পেতে সমস্যা হয়। যেন ব্যাচেলররা এসেই বাড়িওয়ালার মেয়ে বা বউয়ের সাথে প্রেম করতে শুরু করবে, যেন বিবাহিত পুরুষেরা প্রেম করে না। নিজের মেয়ে-বউয়ের ওপর আস্থা নেই, এমন বাড়িওয়ালাই ব্যাচেলরদের বাড়ি ভাড়া দিতে চান না।

দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে, নারী-পুরুষ সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নারী-পুরুষ সবার জন্য একটা নিরাপদ সমাজ গড়ে তোলা প্রয়োজন, যেখানে সবাই নিশ্চিন্তে যার যার কাজ করতে পারবে।

প্রভাষ আমিন: সাংবাদিক

[email protected]

২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

শেয়ার করুন: