উইমেন চ্যাপ্টার: দুই সন্তান নিয়ে জয়শ্রী জামান ‘একা’ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নিশ্চয়ই তিনি খুব আনন্দে, তা ধেই ধেই করে সেই সিদ্ধান্ত নেননি। দুটি সন্তানের দায়িত্ব নেয়া, তাদেরকে সার্বক্ষণিক নজরে রাখা, পড়ালেখার দেখভাল করা, খাওয়ানো-পরানো সবই একা নিজের কাঁধে নেয়া চাট্টিখানি কথা না। দুই বাচ্চার বাবা বলেছেন, তিনি খরচ দিয়েছেন। ভাল কথা, এটা তার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু খরচই তো সব নয়। যখন বাচ্চারা অসুস্থ হয়েছে, তখন রাত জেগে ওদের শিয়রে মাকেই বসে থাকতে হয়েছে, হয়তো পরের দিন সেই ঘুমক্লান্ত শরীর নিয়েই ছুটতে হয়েছে কাজে, সেইসব দায়িত্বের কাছে ওই ‘খরচ’ দিয়ে দেওয়াটা নিতান্তই হাস্যকর যুক্তি।
গত ছয় বছরের ছাড়াছাড়ি জীবনে জয়শ্রীর জীবনে অন্য কোনো পুরুষ এসেছে কিনা, বা তার কোন বন্ধু, ছেলেবন্ধু ছিল কিনা জানা নেই। থাকলেও তো ক্ষতি নেই। বরং থাকাটাই স্বাভাবিক। আফটার অল জয়শ্রী একজন রক্তমাংসের মানুষ, সবকিছুর পরও তার নিজস্ব একটা জীবন আছে। যদি তার কোনো সম্পর্ক কারও সঙ্গে হয়েও থাকে, সেটাও তো অন্যায় বা পাপ নয়, তাহলে কেন এ নিয়ে লেখালেখি। সেটা নিয়ে রসালো গল্প ফাঁদার তো কোনো কারণ পাওয়া যায় না।
তার ‘একদা’ স্বামী কিন্তু ছয় বছর আগেই দুই সন্তান ফেলে আরেকটা বিয়ে করেছিলেন। সেই ‘একদা’ স্বামী আলিমুল হক ফেসবুকে লেখা এক চিঠিতে দাবি করেছেন, তিনি নিয়মিত খরচ দিয়ে যেতেন বাচ্চাদের। তাকে নিয়ে পত্রিকাগুলো যা লিখছে, তা ডাহা মিথ্যা বলেও তিনি দাবি করেছেন। তবে জয়শ্রীর চরিত্র/জীবনাচরণ নিয়ে পত্রিকাগুলো যা লিখছে, সে ব্যাপারে তিনি বলেছেন, এ ব্যাপারে তার ‘নতুন করে কিছু বলার নেই। রিপোর্টাররাই অনুসন্ধান করে বের করেছেন’। তিনি জয়শ্রী সম্পর্কে আরও খারাপ ইঙ্গিত করতেও ছাড়েননি।
আলিমুল যথার্থ ‘স্বামী’র দায়িত্বই পালন করেছেন। তারই দুই সন্তানের মা সম্পর্কে এমন মন্তব্য করতে তিনি পিছপা হলেন না। আর কখন তিনি এ নিয়ে লিখছেন, যখন মাত্র দুদিন আগেই তাদের নাবালক দুই ছেলেমেয়ে ‘আত্মহত্যা’ করেছে। সন্তানের শোকে মা যখন কাতর, যখন ইনজেকশন দিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হচ্ছে, ঠিক তখনই বাবা হয়ে একজন মানুষ অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায়, বেশ যত্ন করে এমন একটি লেখা লিখতে পারলেন। সাধুবাদ দিতে হয় বৈকি!
তবে একজন আলিমুলকেই বা দোষ দিই কিভাবে? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিটি প্রতিনিধিই একেকজন আলিমুল। আলিমুলের ওই লেখায় মন্তব্যকারীদের মন্তব্য দেখেই তা ঠাহর করা যায়, তারা তাকেই সমর্থন জানাচ্ছেন। সেইসাথে জয়শ্রীকে গালিগালাজও করছেন। গণমাধ্যমও সন্তানদের আত্মহত্যার পিছনের গূঢ় কারণ অনুসন্ধান করা বাদ দিয়ে মায়ের চরিত্র হননে উঠেপড়ে লেগেছে।
এতো বছর ধরে সন্তান দুটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, লেখাপড়া করানোর জন্য যে মা এতো ত্যাগ স্বীকার করে গেলেন, তার কোন মূল্যই নেই কারও কাছে। তিনি চাকরির জন্যে যেভাবে লড়াই করে গেছেন, যেভাবে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন, সেগুলোর কথা তেমনভাবে ‘হাইলাইট’ হচ্ছে না, যতটা হচ্ছে তার ব্যক্তিগত জীবন। কিন্তু জয়শ্রীর কাছের মানুষমাত্রেই জানেন, কেমন তিনি।
মেয়েদের একা থাকার এটা একটা বড় বিড়ম্বনা। একলা মেয়ে, সে অবিবাহিত হলে একরকম, আর বিবাহিত হলে তো বিষয়টা আরও রসালো গল্পে পরিণত হয়।
দুটো বাচ্চা একসাথে মারা গেল। যে মা এই বাচ্চাদের নিয়েই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, যাদের নিয়ে ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্ন দেখেছিল, তার এখনকার ‘থাকাটা’ কেমন হবে, সেটা না ভেবে, লোকজন, গণমাধ্যম, এমনকি সন্তানদের ‘বাবা’ও গল্প বলতে ছাড়ছেন না। আর আমজনতা সেই গল্প গিলছে। সাংবাদিক দম্পতি রুনি-সাগর খুন হওয়ার পরও একই গণমাধ্যমগুলো সাগরকে নিয়ে কোনো অলীক কাহিনী ছাপায়নি, রুনিকে নিয়ে দিনের পর দিন গল্প ফেঁদে গেছে। একপর্যায়ে সেইসব গল্পের প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে হয়েছে নারী সাংবাদিকদের।
জয়শ্রীর বুক শূন্য হয়ে গেছে আজ। মা মাত্রই জানেন, সন্তান হারানোর কষ্ট কাকে বলে! আমরা আরেক সাংবাদিক নাজনীন আক্তার তন্বীকে দেখছি। একটি বছর হয়ে গেল সে তার মেয়েকে হারিয়েছে। এক মূহূর্তের জন্যও কি সে পেরেছে তাকে ভুলতে? অথচ তারই সন্তানের বাবা তো এই এক বছরে অনেক আবেগ-ভালবাসা দেখালেও ঠিকই অন্য বন্দরে নৌকা ভিড়িয়েছে। সে প্রকাশ্যেই এক ঘোষণা দিয়ে সেকথা জানাতেও দ্বিধা করেনি। বলেছে, সে সুখের সন্ধান পেয়েছে নতুন জায়গায়। কই, তখন তো গণমাধ্যমের কোনো সহকর্মীকেই তার কথার প্রতিবাদ করতে দেখলাম না, বা সমালোচনা করতে দেখলাম না!
মেয়েগুলো আসলে বোকা-গাধা। প্রজনন ক্ষমতা যে একটা মেয়েকে কতটা পিছনে টেনে রাখে, এটা যেদিন থেকে মেয়েরা বুঝতে শিখবে, যেদিন থেকে তারা মা হওয়া বন্ধ করবে, সেদিনই মূলত প্রথম চপেটাঘাত আসবে এই সভ্যতার মুখে। এবং এটাই হওয়া উচিত। যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই মুক্তির সময় ঘনিয়ে আসবে।
কিন্তু এই ‘মাতৃত্বেই মেয়েদের সৌন্দর্য’ এই ধারণা থেকে মেয়েরা মুক্তি পাবে কবে?