জাত গেল, জাত গেল বলে…..

Snigdhaফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা: নমঃশূদ্র, ছোট জাত, নিম্নবর্ণ …. জাত গেল জাত গেল বলে !! নমঃশূদ্র, ছোট জাত, নিম্নবর্ণের হিন্দু হয়ে থাকতা যদি ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজী তোমার অঞ্চলে লুটপাট করতে না আসতো!!

নমঃশূদ্র, ছোট জাত, নিম্নবর্ণের হিন্দু !! মানুষ কি আগে থেকে তার জন্মস্থান নির্ণয় করতে পারে? আপনার বাবা-মার এক্স আর ওয়াই ক্রোমোজম কখন মিলবে আর আপনার ভ্রুণের জন্ম হবে, তা কি আপনার বাবা-মাই নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে? এই পৃথিবীতে এমন কেউ কি আছেন যিনি বলতে পারেন এই শুক্রাণু আর ডিম্বানু ঠিক অমন সময়ে মিললে যে সন্তান এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হবে সে নিম্নবর্ণের হবে না।

আপনি কি জানেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু, ছোট জাত, নমঃশূদ্র কাদের বলা হয়? মানুষ কবে থেকে উচ্চবর্ণের আর নিম্নবর্ণের ভেদাভেদ শুরু করলো? একটাই পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষের দুটো করে হাত- পা, চোখ, মুখ সমান থাকা সত্ত্বেও একদল উচ্চবর্ণের আর আরেক দল নিম্নবর্ণের কেন? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার প্রকার শ্রেণীতে ভাগ করে করে কারা? – আপনার আমার মতই মানুষেরা এই শ্রেণী বিভেদ গড়ে তুলি। শূদ্র জাতির কর্মক্ষেত্র কারা আলাদা করে দিল ? আর কেনই বা তারা তাদের কর্মক্ষেত্র শত চেষ্ঠায়ও বদলাতে পারে না? কারা বলে তুই নিচুজাত, তোর নিচু জাত হয়েই থাকতে হবে? আপনার আমার মতো কিছু মানুষেরা তা করে। নিজেদের সুবিধার্থে, সমাজে আধিপত্য বিরাজে তারা এই জাত-পাতের সৃষ্টি করে আজ তারা রাজাধিরাজ। দাস-প্রথা, বর্ণপ্রথা সব কিছু তারই অংশ।

কর্ম দিয়ে নির্বাচন হয় কে উঁচু জাতের আর আপনার আমার ভাষায় নিচু জাতের। একবার ভেবেছেন কখনো এই নিচু জাতের মানুষগুলো না থাকলে আপনার মতো উঁচু জাতের মানুষগুলোর কি হতো? ধরুন, জাতিভেদে একজন মানুষ মেথর, আপনার আমার বর্জ্য ফেলাই তার কাজ। সে না থাকলে আপনার নিজেকেই তার কর্মগুলো সম্পাদন করতে হতো। ভাবুন, আপনার দামী পায়খানাটি নষ্ট হয়ে গেছে। আশেপাশে এমন পেশার কেউ নেই। আপনি নিজে মলমূত্র ত্যাগ করে পায়খানাটি নষ্ট করে ফেলেছেন। আর আপনার নিজেকে তা পরিষ্কার করে, মেরামত করতে হচ্ছে। তখন কোথায় থাকবে আপনার জাত-পাত? নাকি জন্মসূত্রে উচ্চবর্ণের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেই আপনি এসব ভেদাভেদ মুক্ত হয়েছেন? ব্যাটা মুচি যদি জুতা না সেলাই করতো আপনার কোমল সুন্দর পায়ের কি দশাই না হতো?

ঠিক কবে থেকে ভেদাভেদ শুরু হলো মনে আছে কারো? প্রতিটি মানুষকে তার কাজ আলাদা করে দেওয়া হলো। ব্রাহ্মণ গেল পূজায়, ক্ষত্রিয়রা যুদ্ধকর্মে, বৈশ্যরা কৃষিকাজে আর শূদ্রদের নির্ধারিত করা হলো আপনার আমার পরিত্যাক্ত কাজগুলোর জন্য। হ্যা, ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে, কিন্তু তাতে কি রক্ষা পেয়েছে জাতিভেদ প্রথা। এখনও তো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মেথরের ছেলে-মেয়ে মেথরই হয়। গিয়েছেন কখনো মেথরপট্টিতে। দেখেছেন, জীবন নিয়ে ওদের কত ক্ষেদ। যে জীবন তারা নিজের ইচ্ছেয় বেছে নেয়নি, সেই জীবন তাদের কত অসহায় করে তোলে।

খুব বড়াই করে বলছেন আপনারা জাতিভেদ প্রথায় বিশ্বাস করেন না, আপনারা মুসলমান। যান আপনার প্রিয় নবীর দেশে যেখানে আপনার দেশের মানুষগুলোকে তারা নিম্নজাতি হিসেবেই দেখে। মিসকীন উপাধি দেয়, তাদের ফুট ফরমাস খাটার জন্য আপনার দেশের মানুষকেই নির্ধারিত করে। তাদের রাস্তা পরিষ্কার আর বাড়ির গৃহকর্মীর পেশায় আপনি লিপ্ত। ঘরের কাজের পাশে এইসব গৃহকর্মীদের মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ যৌণকর্মী বানাতে সর্বদা প্রস্তুত। এতো গেল জাতিভেদ না মানা স্বর্ণ আর তেলের রাজ্য সৌদি আর মধ্যপ্রাচ্যের কথা। নিজের দেশের দিকে তাকান। হ্যা, অনেক কম ভেদাভেদ প্রথা। কিন্তু, এখনো বড় পর্দার যে দৃশ্য দেখে আমরা হাসাহাসি করি,- ”আমি এক গরীব রিকশাওয়ালার মেয়ে”- তা দিয়েই আমাদের মানসিকতার পরিমাপ করা যায়। আপনি আপনার সমাজের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ। দেবেন আপনার কন্যা বা পুত্রের বিয়ে রিকশাওয়ালার ছেলে-মেয়ের সঙ্গে?

হাসবেন না, চিন্তা করে দেখুন, দেবেন না। যে মেথর রোজ আপনার বাড়ীর সামনের রাস্তা ঝাঁড়ু দিয়ে যায়, তাকে কোনদিন ঘরের ভেতর আসতে দেন, ঘরে এনে তাকে এক গ্লাস জল খেতে দিয়ে বলেন, আহারে বাছা তোমার কারনে আমি পরিচ্ছন্ন থাকি, তোমাকে পরিচ্ছন্ন রাখা আমার দায়িত্ব। না আমরা তা করি না। আমরা নিজ দায়িত্বে যুগে যুগে মেথর কে মেথর কর্মে রেখে যাই। কারন, তারা না থাকলে আমাকেই তার কর্মগুলো সম্পাদন করতে হবে। একবার আমাদের বাড়ির সামনে, বাংলা মদ খেয়ে তিনজন মেথর ম্যানহোলে কাজ করতে গিয়ে ডুবে যায়। জীবিত উদ্ধার হয় রামপুরার বনশ্রীর পাশের জলাশয় থেকে, এই কাজটা তাদের পক্ষেই করা সম্ভব। আপনি আর আমি হলে সেখানেই অক্কা পেতাম। সবাই বাউল আব্দুল করিম হতে পারে না। যে নিজের সুখের জীবন বিসর্জন করে মেথরপট্টিতে গিয়ে জীবন কাটাতে পারে।

খুব ছেলেবেলায় আমার এক দুঃসম্পর্কের ভাই বিয়ে করবে বলে পাত্রী খোঁজা হচ্ছিল। আমাদের বাড়িওয়ালার নাতনীর জন্য আমার বাবা প্রস্তাব দিতে গেলে, আত্মীয়দের তরফ থেকে না করা হয়। কারণ কি জানেন? বলা হয় আমার গায়ের সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ্, অন্ন উৎপাদন আমাদের কাজ, জোলার (তাতী) ঘরের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ হয় না। বাবা বললেন,- এটা ১৯৯০ এখনও এসব মানলে চলবে? বাবাকে জোরে শোরে ধমক দিয়ে বলা হলো,- আপনি আপনার মেয়ের বিয়ে দিয়েন জোলার সঙ্গে, আমাদেরকে আমাদের বংশমর্যাদা রক্ষা করতে দিন। সেই ছোট্ট আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,- আব্বু জোলা কাকে বলে? আমার মাথার টনক তখনই নড়ে! আর আপনি বলেন নিম্নজাতের হিন্দু হয়েই থাকতেন !!

আমি মনে মনে ভাবি, হায়রে খাদ্য উৎপাদন করা গৃহস্থরা; যদি এই তাঁতীরা কাপড় না বুনতো, তাহলে আপনারা তো আদম-হাওয়া হয়েই ঘুরে বেড়াতেন। তাঁতীকে তার কর্ম সম্পাদনের দায়িত্ব দিয়ে আপনারা উচ্চ বংশ হয়ে গেলেন? হায়রে সমাজ, হায়রে জাতি, আহারে জাতিভেদ প্রথা !!

সম্ভ্রান্ত মুসলিমরা কি জাত-পাত কম দেখে? চৌধুরী, খাঁ, মোল্লা এসব কি এমনি এমনি নির্ধারিত হয়? আপনার কর্মক্ষেত্রে দিকে তাকান না, কি দেখতে পান? ধরুন আপনি একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন। আপনি একটি এমবিএ করেছেন আর আপনার ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন করা সহকর্মীরা আপনাকে কটাক্ষ করে হাসাহাসি করে আর বলে তাদের পেশার চেয়ে মহান পেশা আর কিছু নাই। আমরা এমনই, যখন যেভাবে সুযোগ পাই অন্যকে পদদলিত করে আনন্দিত হই। নিম্নবর্ণের স্রষ্টা আসলে আপনি, আমি, আমরা সবাই।

না,আপনাদের বোঝানো যাবে না, কারণ আপনারা বুঝবেন না। আমি ম্যাথ, ইংরেজী, জার্মান, বিজ্ঞান পড়ে আমার নিম্নমেধা খরচ করেই চলছি। আমি শিখতে পারছিনা, জ্ঞান আহরণ শেষ হচ্ছে না, কত কি শেখার আছে !! আর আপনি সেই জ্ঞান একটি বিশেষ গ্রন্থ পড়েই অর্জন শেষ করেছেন। তাও যদি নিজেদের বিশের গ্রন্থটি মনযোগ দিয়ে পড়ে দেখতেন নারী হিসেবে শস্যক্ষেত্র হওয়া ছাড়া আর কোন বিশেষ কাজ আপনার জন্য নির্ধারিত আছে কি?

ও হ্যাঁ, আপনি তো রূপা গাঙ্গুলী কিংবা চম্পা অভিনীত পদ্মা নদীর মাঝি দেখেন না। ঠিক আছে, আপনি ”স্টোনিং অন সুরাইয়াই” দেখেন, যেখানে রমনীরা আপনার মতই হিজাব করে তাদের কি হয়? একজন নারী হিসেবে আপনিও মানুষের শ্রেণীতে নিম্নবর্ণের মানুষ।

আজ আর কথা না বাড়াই, লালনের ভাষায় বলি,

আসবার কালে কি জাত ছিলে
এসে তুমি কি জাত নিলে
কি জাত হবা যাবার কালে
সে কথা ভেবে বলো না…

জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না না না….

শেয়ার করুন: