
ইশরাত জাহান ঊর্মি: আমার দেখা প্রথম সিনেমা চন্দ্রনাথ। শরতচন্দ্র চট্টপাধ্যায় এর গল্প। ডিরেক্টর কে মনে নাই। রাজবাড়ীর বসুন্ধরা সিনেমা হল। বড় মামী, মামীর ভাইয়ের বউ আরও কার কার সাথে যেন আমরা একদল আন্ডাবাচ্চা। সাদা-কালো সিনেমা, শুধু মনে পড়ে ব্লাউজ ছাড়া টানা টানা চোখের নায়িকার তুলো ওড়ানোর দৃশ্য। পরে জেনেছি ঐ নায়িকার নাম দোয়েল। পরিচালক কে? চাষী নজরুল ইসলাম? মনে করতে পারছি না।
অর্ধেক সিনেমা দেখে খুব করুণ স্বরে বলেছিলাম, মামী আর দেখবো না, বাসায় চল। বড় মামী হলেন ব্যাক্তিত্ব আর মিষ্টি স্বভাবের অদ্ভুত মিশ্রণ। কারো সংগে কোনদিন উঁচু গলায় কথা বলেননি একসময়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক। তবু তাঁকে কী ভয় আর সমীহই না করতাম আমরা। মামী হেসে বললেন, তাই কি হয়? টিকেট কাটা হয়েছে, এখন সিনেমা শেষ না হলে তো বের হতে দেবে না আম্মু…
আমি খুবই ব্যাজার হয়ে বসে রইলাম। এ কি গেঁড়ো। আমি যেন আটকে পড়া পাখী। আমার বয়স তখন কত সাত কি আট। তখন কি জানতাম বন্দি নয় সিনেমা আসলে কত মুক্তির কথা বলে!
ঢাকায় এসে সিনেমা দেখতে শুরু করি বড় পর্দায়। ব্রিটিশ কাউন্সিল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, রাশিয়ান কালচারাল সেন্টার, ইন্ডিয়ান কালচারাল সেন্টার, পাবলিক লাইব্রেরি, জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তন।
আমি খুব সাধারণ সিনেমা দর্শক। যা ভালো লাগে তাই দেখি। সিনেমার মন্তাজ, দৃশ্যকল্প, সিনেমাটোগ্রাফি…ইত্যাদি ইত্যাদি আর ব্যাকরণ দিয়ে সিনেমার রসকে জবাই করতে পারি না। সবকিছুই মস্তিষ্ক দিয়ে দেখার মতো অত জ্ঞান আমার নেই, দেখি হৃদয় দিয়ে। তাই সিনেমার অদ্ভুত আলোড়নের জগতে আমাকে যখন প্রবেশ আর প্রোথিত করে তুষার-আমার বন্ধু, তখন থেকে শুধু দেখতেই থাকি। বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্রের নড়বড়ে চেয়ার আর পুরোন সোঁদা গন্ধের ভবন। প্রজেক্টর অপ্রতুল। কিন্তু কি বিশালতা! নতুন এক বিশ্বের সন্ধান পেলাম আমি। বিশ্বের সেরা আর বাছাই করা সিনেমাগুলো দেখছি তখন। দেখছি আর ভাবছি আর বদলে যাচ্ছি আর ছটফট করছি।
কিন্তু আজ আমি বলবো, আমার ভাষা আর নীরবতা বুঝতে পারা তিন বাঙালী পরিচালকের কথা। কোনদিন তাঁদের সাথে আমার দেখা হয়নি শারীরিকভাবে। আর দেখা হওয়ার কোন আশাও নাই। তারা এখন আক্ষেপের অতীত, অপেক্ষার অতীত। তাদের একজন সত্যজিত রায়।
আমাকে ভাবায় সত্যজিত রায়।
চারুলতা
মহানগর
অপুর সংসার
অরণ্যের দিনরাত্রি
শাখা-প্রশাখা, কাঞ্চনজঙ্ঘা।
আচ্ছা মহানগর-এ মাধবী কেন ছেড়ে দিলেন চাকরী এমন অনিশ্চয়তার মধ্যেও? অরণ্যের দিন-রাত্রির শর্মিলা ঠাকুরের চোখের কোণে কিসের বেদনা? শাখা-প্রশাখায়- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কেন চুপচাপ বেটোফেন শুনতেন একা একা? আমাকে ভাবায়, আমাকে ভাবায় সত্যজিত রায়। খুব মনে পড়ে চারুলতার চারুকে। ঝড়ের মধ্যে স্পর্ধার ঝড় হয়ে আসা ঠাকুরপো।
অপর্ণা সেন এর পরমা আর পারমিতার একদিন আবারও দাঁড় করিয়ে দেয় স্পর্ধিত সত্যের মুখোমুখি-কেউ-ই কারো সম্পত্তি নয়, নারী-সে এক বিস্ময়, যে নিজেকে আবিস্কার করতে করতেই জীবন পার করে দ্যায়, একটামাত্র জীবন নারী পারে না তার নিজের মতো করে যাপন করতে। দ্যা ব্রিজেস অব মেডিসন কান্ট্রির পঞ্চাশোর্ধ মেরিল স্ট্রিপ, পরমা-মাধবী, পারমিতা-ঋতুপর্ণা সেন,পারমিতার শাশুড়ী-অপর্না সেন…সবার মধ্যেই নিজেকে খুঁজে পাওয়া বারবার।
হাল আমলে আমার ভাষা এবং নীরবতা সবচেয়ে বেশি বুঝতে এবং বলতে পারতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ।
উনিশে এপ্রিল
দহন
অন্তরমহল
চোখের বালি
তিতলি
বান্ধব
আবহমান
মানুষের সম্পর্কের গলি-ঘুপচি খুব করে ভাবায় আমাকে। উনিশে এপ্রিলে অপর্ণা সেন আর তাঁর বন্ধু দীপংকর দে’র সম্পর্কটা কি? খ্যাতিমান নৃত্যশিল্পী অপর্ণা সেন তাকে রীতিমতো প্রাইভেট সেক্রেটারির মতো “ইউজ” করে। তার নাম থাকে সোমনাথ। বাড়ির সব ঝামেলা অপর্ণার সাথে আইনগত কোন সম্পর্ক না থাকা সোমনাথই সামলায়। কিন্তু আসলেই কি সোমনাথ অপর্ণার শুধু্ই সেক্রেটারি? ছোট্ট একটা সংলাপেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে সোমনাথ অপর্নার কী? খাওয়ার টেবিলে অপর্ণা সোমনাথকে বলে,
: অত আলু খেও না, এদিকে রোজ বলবে, মোটা হয়ে যাচ্ছি…
বুঝতে পারি, সোমনাথ কতটা যত্নের সেলিব্রেটি এই নৃত্যশিল্পীর কাছে।
আবহমান-এ কি সম্পর্ক সৌমিত্র’র সাথে অনন্যার? আমি ধরতে পারি না। তবে এই সিনেমায় সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র আমার মনে হয়েছে মমতা শংকরের চরিত্রটিকে। যে চরিত্রটি আমাকে ক্ষমা করতে শেখায় । শেখায়, মানুষের সম্পর্ক কতই না বিচিত্র আর বহুমুখী হতে পারে! মমতা যখন বুঝতে পারেন তাঁর স্বামীর সাথে তাঁরই হাতে গড়া অভিনেত্রী অনন্যার একটা কোন সম্পর্ক আছে, তখন কোন ঝগড়া-ঝাঁটি নয় বরং আরও নিস্তব্ধ হয়ে যান তিনি। বলেন,
আমি এই সংসার ছেড়ে চলে যাবো? কেন? আমারও স্যাক্রিফাইস আছে এই সংসারের জন্য। আমি কেন যাবো?
আর সৌমিত্র বলেন, আর যাই কর, চলে যেওনা।
মানুষের সম্পর্ক কতই না বিচিত্র আর বহুমুখী হতে পারে! শেখান ঋতুপর্ণ।
ঋতুপর্ণ ঘোষ মারা গেলে আমি শূণ্যতা অনুভব করি। মনে হয় কে আর অতটা গভীরভাবে বুঝবে আমার ভাষা। কিন্তু আসলেই প্রকৃতি কাউকে বুঝি অপূর্ণ রাখে না। প্রতিদিনই কত নতুন নতুন পরিচালক আর তাদের ভাবনার সাথে পরিচিত হচ্ছি। পূর্ণ হচ্ছি, পূরিত হচ্ছি।
শুধু একটাই কষ্ট সারাক্ষণ ভেতরে ভেতরে গুমরায়। বড় পর্দায় সিনেমা দেখতে যেতে পারি না সময় আর স্থানাভাবে। কবে আবার সময় হবে তাও বুঝি না। শুধু বুঝি, সিনেমার আকাশেই আমার মুক্তি।
এই আকাশে আমার মুক্তি,আলোয় আলোয়…