উইমেন চ্যাপ্টার: সম্প্রতি এক বন্ধু একটা অনুষ্ঠানে সমবেতদের সাথে কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, এই সময়ে একলা থাকাটা যেন ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে, মানুষের মাঝ থেকে সহনশীলতা চলে গেছে, একে-অন্যকে বুঝতে চায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই বন্ধুটি তার দুই মেয়েকে নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছে। বিয়ের কথা বললেই ওরা বলে আগে ক্যারিয়ার, তারপর বিয়ে। এতে করে বন্ধুর ঘুম হারাম। বলে, এতো এতো ছেলেবন্ধুর সাথে ঘুরে, কী যে হয় শেষপর্যন্ত!
আমি বলি, টেনশন করো না তো! ওরা সময় হলেই বেছে নেবে কাউকে, নইলে নেবে না। একাই থাকবে। একথা শুনে বন্ধুর চোখ ছানাবড়া। রাম, রাম বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আসলে একা থাকাটা অভিশাপ, নাকি আশীর্বাদ, আমরা নিজেরাও বুঝতে পারি না।
কিছুক্ষণ আগে এক বন্ধু ফেসবুকে লিখলো, “আজকে সকালে ভাইয়ের অফিসে গিয়েছিলাম। ভাইয়ের কাছে এলেন তার পরিচিত একজন শিল্পপতি এবং উনার স্ত্রী। আমার ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, বেশ গর্বের সাথেই বোনের কাজ সম্পর্কে বলল সে। তিনি জানতে চাইলেন না কি কাজ, কেমন কাজ, জিজ্ঞ্যেস করলেন কোথায় থাকি, এবং দ্বিতীয় প্রশ্ন ‘ স্বামী কি করেন?’ একজন মানুষ হিসাবে সমাজে আমার যে অস্তিত্ব এবং অবদান তা শুধু নারী হবার কারণেই সাধারণভাবে মানুষের কাছে উজ্জ্বল হয়ে দেখা দেয় না এবং এবারি প্রথম নয় বহুবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছি এবং হচ্ছি আমরা নারীরা। স্বামী স্ত্রী পরস্পরের জীবনের অংশ, অবশ্যই মূল্যবান অংশ, কিন্তু স্বামীটি যেমন অপরিহার্য হিসেবে প্রতিভাত হন, স্ত্রীটিও যদি হতেন! প্রথম পরিচয়েই আমি কেন কাউকে জিজ্ঞ্যেস করি না , ভাই আপনার স্ত্রী কি করেন? এখন থেকে করবো! কাউকে না কাউকেতো কোথাও থেকে শুরু করতে হয়”!
সেখানে একজন মন্তব্য করেছেন, “এবং বেশিরভাগই যখন বলবে যে চাকরি করে না। তখন চোখ কপালে (আক্ষরিক অর্থেই) তুলে বলবা, কী বলেন? চাকরি করে না? নাকি আপনি করতে দেন না?”
আমরা যারা একলা থাকি, তারা এই প্রশ্নের মুখোমুখি হই প্রতিনিয়ত। এইতো কিছুদিন আগেই রক্তীয়দের কাছে দীর্ঘ বছর পর বেড়াতে গিয়েছিলাম, সবাই দেখা শেষ হওয়া মাত্রই প্রশ্ন করেছেন, ‘তোর স্বামীটা কি করে রে?’ আমি বলি, ‘এটা আবার কেমন প্রশ্ন? তোমার বোনটা যে এতোকিছু করছে, সেটাও জিজ্ঞাসা করলে পারতে যে, তুই কি করিস! আসলে এই ‘করার’ বিষয়টা আমাদের এই উপমহাদেশে পুরুষদের জন্যই মনে হয় তোলা আছে।
একবার একজন বড় আপার বাসায় বেশ যাতায়াত ছিল। তার দুই মেয়ে, দুজনই স্কুলে পড়ে। ওরা সাংবাদিকতার নামে তখন ‘নেশাগ্রস্ত’ বলা চলে। সবকিছুইতেই উদাহরণ টেনে বলে, বড় হয়ে অমুকের মতো হবে, তমুকের মতো হবো। কিন্তু একদিন আমার সামনেই সেই বড় আপাটা উত্তর দেয়, ‘সাংবাদিকদের সংসার টেকে না, তাছাড়া মেয়েদের অতবড় হতেও নেই’। আমি পুরাই বেকুব হয়ে গেলাম। মনে মনে বুঝে নিলাম যে, আমার যাওয়া-আসাটাই আসলে কাঙ্খিত নয় তাদের কাছে। সেই থেকে যাওয়া বাদ দিলাম। আজ অনেক বছর হয়ে গেছে, আমার জানাও হয় না, তারা কই আছে, কি করছে! সম্পর্কগুলো মনে হয় এভাবেও শেষ হয়ে যায়।
সম্পর্ক শেষ হওয়ার কথা বলতে খুব বেশি দূরে যেতে হয় না। আমারই খুব কাছের এক বড়বোন মনে মনে আমার খুব প্রশংসা করে এই বলে যে, সব চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমি আজ কতদূর চলে এসেছি। সে যা পারেনি জীবনে, আমি তাই করেছি। যখন, যেখানে খুশি চলে যাচ্ছি। কিন্তু সবার সামনে সে এই কথাগুলো জোর দিয়ে বলতে পারে না। যখন পুরুষকুল বা প্রতিকূলের যাত্রীরা আমার নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়, তখন সেই বড়বোন পেঁচার মতোন মুখ করে সব সয়ে যায়, কোনো প্রতিবাদ সে করতে পারে না। ভাবে যে, প্রতিবাদ করলে তার জায়গাটিও যদি নড়বড়ে হয়ে যায়! কী আশ্চর্য এই জীবন। তবুও তাকে ভালবাসি আমি, তার অপারগতাগুলো ক্ষমা করে দিয়েই।
এখানে বন্ধুদের কথাই বেশি বলা হচ্ছে। এমন বন্ধুও আছে, যারা একা আছে বলে মরমে মরে যাচ্ছে, যেন জীবন তাদের কাছে অভিশাপ আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছু না। কোনো অনুষ্ঠানে যায় না, আড্ডা দেয় না, জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য নিয়েও রসকষহীন শুকনো জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। আমি তাদেরকে বলি, তোরা মর, অনলাইনের ভাষায় এটাও বলি, তোরা মুড়ি খা। জীবনটা বাবা একদিনের না, তবে একবারের। একে হেলাফেলা করে কাটিয়ে দেয়া খুবই অনুচিত। যাপন করো এমনভাবে, যেন আজই তোমার শেষদিন। তুমি তো জানো না, কাল সূর্যোদয় তুমি দেখবে কিনা! কিন্তু তার মানেও এই নয় যে, যা ইচ্ছে তাই করবে। একটা মার্জিন তো অবশ্যই আছে। সেটা মেনে চলেও জীবন কাটিয়ে দেয়া যায় দিব্যি।
সংসারের স্বপ্ন আমার অনেকদিনের। একটু একটু করে সংসার সাজাই, মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে সাজানো সংসারটাকে রঙীন করে তুলি। এক বন্ধু আছে, খুবই অগোছালো জীবনযাপন করে। তার কথায়, ঘর সাজিয়ে কী হবে! যদি কেউ নাই দেখলো! মানে? কে দেখবে? বলি, আমরা আছি না, তুমি নিজে দেখবে! বলতে বলতে একদিন সে সত্যিই ঘর সাজায়, নিজেও সাজে।
বিদেশে থাকা এক বন্ধু কোনো বিয়ে বা আনন্দের অনুষ্ঠানে যায় না। জিজ্ঞাসা করতেই বলে, আমি তো অপয়া, ঘর টেকেনি, যদি আমার কারণে সেই আনন্দ মাটি হয়ে যায়! আমি আকাশ থেকে পড়ি। কীসব শাবানা-ববিতা মার্কা কথা! কোন যুগে বাস করছি আমরা! অনেক বুঝাই তাকে। অবশেষে তাকে একটা বিয়েতে পাঠানো গেছে সম্প্রতি।
একা থাকাটা উপভোগ করতে সবাই জানে না, আবার এই একাকীত্ব কাটাতে মানুষ যখন দোকা হতে মরীয়া হয়ে উঠে, তখন তাদের দেখেও আমার করুণা হয় বৈকি! ভাবি, জ্বলন্ত কড়াই থেকে এবার উনুনে ঝাঁপ দিলে না তো!