
ইশরাত জাহান ঊর্মি: প্রতিদিন অফিস আসার পথে ফ্ল্যাট বাড়িগুলো দেখি। বারান্দায় তারে ঝোলে, একটা লুঙ্গী, দুটো কামিজ, ছোট ছোট জামা ছেলে শিশু বা মেয়ে শিশুর। কোন কোন বাসার তারে বিছানার চাদর। আমার বাসার চাদরগুলোর প্রিন্টের সাথে কমন পড়ে যায় কোন কোনটার। ঠোঁটের কোণে অজান্তেই একটু হাসি, মজা লাগে। কোন কোন বাড়ির গ্রীল থেকে ঝোলে পূরবীলতার ঝাড়, কোন বাড়ির বারান্দার গ্রীলের বাড়তি অংশে মাটির পটারিতে কাঁটালতা অথবা সবুজ ইনডোর প্ল্যান্ট। দেখতে দেখতে ভাবি, আচ্ছা এই বাসাগুলোয় যাদের বাস, তারা কি সুখী? এই বাড়িতে ডালে ফোঁড়ন দেয় অথবা মাছের ঝোল রাঁধে যে নারীটি তার স্বামী কি তাকে সম্মান করেন? অথবা এ বাড়ির যে পুরুষটি সারাদিন খাটেন সদাগরী অফিসে তার স্ত্রী কি বাড়ি ফিরলে ভালোবাসা মেশানো চায়ের কাপ হাতে তুলে দ্যায়? সপ্তাহ অন্তে তারা কোথায় বেড়াতে যায়? কেন এসব ভাবনা মাথায় আসে! এলেবেলে, অর্থহীন!
২.
আমি একাই কেন ছোবল খাই
হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির
একটি বারও স্মৃতির সাপ কি
তারে ছোবল দ্যায়?
৩.
সেদিন লীনা আপার বাসায় গেলে নীচে থাকতেই আপা বললেন, তুমি সিকিউরিটি কে বলো, লিফট চালু করতে, খবরদার হেঁটে উঠবা না। আমি চুপচাপ পাঁচতলায় উঠে গেলাম। কখনও কখনও প্রয়োজনেও কাউকে অনুরোধ বা বিরক্ত করতে ইচ্ছে করে না। আবার কখনও অপ্রয়োজনেও কত অধৈর্য্য হয়ে যাই, কেন?
৪.
কখনও কখনও ভোররাতে ঘুম ভেঙে এমন হাহাকার লাগে কেন? কেন? কেন? কি চাই আমি, তা কি আমার জানা আছে?
৫.
নহলীকে নিয়ে আমি আরও আরও মায়ের মতো আদিখ্যেতা করি না, ”ওলে আমার জান বাচ্চা” বলে গলে পড়ি না, মাঝে-মধ্যে মার-ধোরও করি যা ওর বাবা কখনই করে না। ওর বাবা ওকে আজ পর্যন্ত জোরে কদিন ধমক দিয়েছে হাতে গোনা যাবে। আচ্ছা আমি কি খূব খারাপ মা? নহলী কি বড় হয়ে আমাকে বুঝবে? আমি কি ওর কাছ থেকে কিছু আশা করি?
৬.
আমি খুব মিস করি, নিউজ প্রেজেন্টেশন। আমার মনে হয়, নিজের পছন্দমতো পেশা যদি কেউ আমাকে বেছে নিতে বলতো, আমি এটাই বেছে নিতাম। এবং এই কাজটার প্রতি কোনদিন বিরক্ত হতাম না। আমি জানি না, আমার আগে কেউ করেছে কি না ঢাকায়, আমি কতদিন রিপোর্টিং করে ট্রাইপডটা কোনরকমে নামিয়ে রেখে দৌড়ে গেছি মেকআপ রুমে, তারপর সমস্ত ক্লেশ ভুলে ক্যামেরার সামনে ঋজু, টানটান পড়ে গেছি নিউজ। কাজটা আমি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা আর পেশাদারিত্বের সাথে করতাম। এখন তো অধিকাংশ চ্যানেলেই রিপোর্টারদের দিয়ে পড়ানো্ হচ্ছে খবর। আচ্ছা তাদের মধ্যে কেউ কেউ কি কখনও আমার কথা মনে করতে পারেন? এ নিয়ে আমার যে একটু গোপন দু:খ আছে, তা কি কেউ বোঝে? এই রে! গোপন আর থাকলো কোথায়, দু:খ তো বলেই ফেললাম!
৭.
মানুষ যখন বড় হয় বা সোজা বাংলায় উপরে ওঠে, তখন কি সে আরও একা হয়ে যায়? আমি কিন্তু উপরে ওঠা মানুষদের চোখের কোণে একাকীত্ব দেখতে পাই। তারা মানে সেই উপরে ওঠা মানুষেরা একাকীত্বের ছায়া ঢাকতে কতরকম বন্ধু বানায়। গানের শিল্পী তাদের বন্ধু, সিনেমার হিরো-হিরোইন তাদের বন্ধু, আর্টিস্ট তাদের বন্ধু, কবি আর লেখক, নাটকের নট-নটী, রিকশাওয়ালা-শ্রমিক, প্রধানমন্ত্রী তাদের বন্ধু, শামীম ওসমান-আইভি রহমান তাদের বন্ধু… হায় তবু কেন চোখের কোণে আমি তাদের একাকীত্ব আবিষ্কার করি? না কি সবই আমার ভুল!
৮.
আজ এক বন্ধুর একটা স্ট্যাটাস পড়লাম,
“কখনও কারো বিশ্বাস ভঙ্গ করবেন না
হয়তো আপনি জিতবেন
কিন্তু এমন একজনকে হারাবেন যে আপনাকে বিশ্বাস করতো…”
৯.
কি জানি কেন এত গেঁথে গেল!
১০.
রাশীদের সেদিনের বলা কথাটা খুব ভাবছি, খুব খুব।
“ আপনি যা চেয়েছেন তা পেয়ে যাওয়াটাই বড় কথা নয়, কিভাবে পেলেন, পাওয়ার পর আপনার সাথে তা কী আচরণ করছে সেটা অনেক বেশি গুরত্বপূর্ণ”
কথাটা খুব সত্যি বলে ভাবছি। মনে হচ্ছে, এরকম পাওয়ার চেয়ে বরং না পাওয়া ভালো।মানুষ কখনও কখনও জিতে গিয়েও আদতে হেরে যায়। জীবনের এক বা একাধিক পরীক্ষায় মানুষকে শেষ পর্যন্ত ফেল করতেই হয়।
১১.
যারা আমার সাথে ভালোভাবে মিশেছে, আমাকে চিনেছে, তাদের সকলেই বলেন,
“ঊর্মি তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে।“
আমি ভাবি। কখনও হাসিও। তারা কি জানেন, আমার চরিত্রে কত অন্ধকার দিক আছে?
হায়! তুমি মোর পাও নাই, পাও নাই পরিচয়…