শুভ মেহেদী: আমাদের দেশের মতো দেশে যেখানে আসলে জন্ম নেয়াটাই অপরাধ সেখানে নারী হয়ে জন্ম নেয়াটা মনে হয় পাপের উপর মহাপাপ এর পর্যায়ে পড়ে। গত কিছুদিন ধরে তসলিমা নাসরিনকে নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে তুমুল আলোচনা, সমালোচনা চলছে ৭১ টিভি তে তার সাক্ষাতকার প্রচার করার পর থেকে।
আমি তসলিমা নাসরিনের খুব বড় একটা ভক্ত না, তবুও তার বই মিস করিনা কখনো। কিন্তু সম্প্রতি কিছু ঘটনা প্রত্যক্ষ করে এখন অন্তত একটি বিষয়ে আমি তসলিমা নাসরিনের সাথে একমত, আর সেই বিষয়টা হোল আমাদের দেশে নারীদের অবস্থান নিয়ে।
একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করেও যে আমরা এখনও অষ্টাদশ শতাব্দীর ধারণা পোষণ করি তা এখন আরও বদ্ধমূল হয়েছে আমার মনে সম্প্রতি আমার পরিচিত খুব কাছের একজন নারীর জীবনের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দেখে।
আজকে আমি শুধুই উনার কথা লিখবো। আর এই লেখাটাই হোল নারীদের বিরুদ্ধে হতে চলা সকল অবিচারের প্রতি আমার চপেটাঘাত।
আমার পরিচিত কাছের সেই নারীর বয়স এখন চল্লিশ এর উপরে। তাঁর বিয়ে হয়েছে আট বছর আগে। যেহেতু ওনার প্রচলিত বয়সের চেয়ে একটু বেশী বয়সে বিয়ে হয়েছে(কারণ বাবা, মা না থাকলে যা হয় আর কি) তাই বরের ব্যাপারে ওনাকে অনেক বেশী ছাড় দিতে হয়েছিলো। স্বামীর বয়সটাও তাই একটু বেশিই ছিল। উনার স্বামীর আগে একটি বিয়ে হয়েছিলো এবং উনার প্রথম স্ত্রী বাবুর্চি দ্বারা ধর্ষিত হওয়ার পর মানসিকভাবে ভারসাম্য হারিয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁদের কোন সন্তানও ছিলো না বলে আমার পরিচিত ঐ নারী তাঁকে বর হিসেবে সম্মতিও জানিয়েছিলেন। উনার স্বামীদের পরিবার বেশ ধনী এবং আধুনিক।
কিন্তু স্বামীর বাসায় গিয়েই একটা ধাক্কা খেলেন কারণ আজীবন যে ধরনের জীবন যাপন করেছেন তার বিপরীত ধারায় উনাকে মানিয়ে নিতে চরম হিমশিম খেতে হয়েছিলো। স্বামী খুব পরহেজগার এবং তাবলীগ করা কাঠ মোল্লা টাইপের হওয়ায় ওনার স্বামী ঘরে কোন টিভি রাখেননি এবং উনাকে দেখার অনুমতিও দেননি। বিয়ের দ্বিতীয় দিন থেকে শর্ত ছিল বাবার বাড়ীর কেউ তাঁদের বাসায় আসতে পারবেন না এবং স্বামী অনুমতি না দিলে কারো সাথে দেখা করাও বারণ। বাসায় কোন খাবার টেবিলও রাখেননি এবং স্ত্রী কে মাদুর বিছিয়ে খেতে বলতেন, কারণ সেটা নাকি ইসলামিক নিয়ম।
প্রতিদিন স্বামী খাবার সময় ৭/৮ জন করে তাবলীগ জামাত এর লোক নিয়ে আসতেন বাসায় এবং স্ত্রী এর কাজ ছিল প্রতিদিন সবাইকে রান্না করে খাওয়ানো। এবং স্ত্রীকে কখনো একটির বেশী তরকারি রান্না এবং খাওয়া নিয়ম করে দিয়েছিলেন কারণ নইলে অপব্যয় হবে এবং এটা ইসলামে নিষেধ। এতো কিছু সত্ত্বেও উনি নিরবে সংসার করে গিয়েছেন গত আটটি বছর ধরে। কিন্তু একটা কথা আছে না বিপদ যখন হয় তখন চারিদিক থেকেই আসে। তাই ঐ নারীর কপালটাও এমনভাবে পুড়বে তা ধারনারও বাইরে ছিল উনার পরিবারের। আট বছরে উনি পাঁচবার গর্ভবতী হয়েছেন এবং পাঁচবারই গর্ভপাত ঘটেছে।
যাই হোক সম্প্রতি উনি উনার স্বামীর পরিবারের সাথে দেখা করতে দুজন মিলে আমেরিকায় ঘুরতে যান সাথে অবশ্য উদ্দেশ্য ছিল সন্তানের জন্য চিকিৎসা এবং উনাদের পেতে যাওয়া আমেরিকান নাগরিকত্ব গ্রহণ করা। তাই ৪৫ দিন আগে উনারা সেখানে গিয়েছেন। কিন্তু ঐ নারী কল্পনাও করতে পারেননি এই আপাত দৃষ্টিতে নির্দোষ ঘুরতে যাওয়ার পেছনে আছে একটি করুণ কাহিনীর নীরব এবং নিখুঁত পরিকল্পনা।
ওখানে যাওয়ার পর পরই উনি টের পেলেন কিছু একটা ঘটতে চলেছে এবং ব্যাপারটা আঁচ করার পর পরই শুরু হয় উনার ওপর পরিবারের তুমুল নির্যাতন। উনার বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেলো, বন্ধ হোল কথা বলা, ফোন করা, এবং শেষ পর্যন্ত সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেলো আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে। কিন্তু হটাৎ ৪৫ দিন পর ঐ নারী তার এক আত্মীয়কে শুধু একবার ফোনে বলতে পেরেছিলেন এই বলে যে, ‘আমার খুব বিপদ’। আর এরপর আর কোন কথা বলতে পারেননি।
অতঃপর আত্মীয় স্বজনের তুমুল চেষ্টায় আমেরিকায় অবস্থানকারী একজন আত্মীয় উনার সাথে যোগাযোগ করে কিছু কথা বলতে পেরেছিলেন এবং ঘটনাটি ছিল এরকম, স্বামীরা সকল ভাইবোন মিলে ওনাকে নির্যাতন করে একটি কাজ আদায় করার চেষ্টায় রত ছিলেন। আর সেটা হোল উনার কাছ থেকে তালাক আদায়।
উনার দোষ? দোষ একটাই, স্বামীকে সন্তান দিতে পারছেন না এবং উনার এখন বয়স অনেক বেশী হয়ে গেছে তাই উনার স্বামী চাইছেন এবার কচি একটি মেয়েকে বিয়ে করবেন। উনার সমস্ত গয়না, টাকা পয়সা স্বামী নিয়ে নিলেন এবং উনাকে বাধ্য করছেন নাগরিকত্ব না নিয়ে জোর করে বাংলাদেশে এনে এয়ারপোর্ট থেকেই বিদায় হয়ে যাওয়া, নইলে ওনার জীবন সংশয়।
ঐ নারী এতোটাই ভীত সন্ত্রস্ত যে ওখানে ভয়ে আইন প্রয়োগকারীর সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ করছেন না পাছে ওনাকে চিরতরে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। ঐ নারী এখন শুধুই চাচ্ছেন দেশে উনার ভাই-বোনদের কাছে ফিরে আসতে একটু নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। উনার সংসার করার সাধও মিটে গিয়েছে। এখন উনি চাইছেন একটু নিরাপদ আশ্রয়, আর কিছুই চান না। পেতে যাওয়া নাগরিকত্বও গ্রহণ করতে পারছেন না ঐ মানুষগুলোর চরম নির্যাতন এবং বন্দী অবস্থায় থাকার কারণে।
আমি যখন এই লেখা লিখছি তখন উনি নিউইয়র্ক এর বিমান বন্দরে ঢাকা গামী ফ্লাইট এর অপেক্ষায়, এবং অপেক্ষা ঢাকা বিমান বন্দরে নেমেই নিজের আশ্রয়ের খোঁজে ভাইবোনদের কাছে ফিরে আসা।
আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিত এবং ভালো পরিবারের মেয়েদের যদি এমন করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে, তবে বাকি নিম্ন শিক্ষিত পরিবারের নারীদের ভাগ্যে কেমন হতে পারে তা ভাবতেও আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ছি। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একজন নারীকে বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে এবং সন্তান দিতে না পারার অপরাধে যদি সবকিছু হারাতে হয়, তবে কি লাভ এইসব শিক্ষা, দীক্ষা এবং সভ্যতা দিয়ে!
বরং আদিম যুগ টাই শ্রেয় ছিল যেখানে অন্তত সমাজের দোহাই দিয়ে কেউ কোন অনাচার করতো না। তখন হয়তো এইসব অমানবিক ঘটনা গুলো মেনে নিতেও বিবেকের কাছে মানবতা বর্গা দিতে হতোনা।