তিনবছরেও আলোর মুখ দেখেনি ফতোয়ার আপিল আদেশ

Sharia n women 2ঝর্ণা মনি: ২০০১ থেকে ২০১১। আপিল নিষ্পত্তি হতে সময় লেগেছে এক দশক। নিষ্পত্তিকৃত আপিল-আদেশ প্রকাশ হয়নি তিন বছরেও। আপিল বিভাগীয় আদেশ কবে আলোর মুখ দেখবে- বলতে পারছেন না কেউ। ফলে ফতোয়ার ভাগ্য নির্ধারণ নিয়ে হতাশ নারী সমাজ।

২০০১ সালে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সব ধরনের ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। ওই রায়ের কিছু অংশ বহাল রেখে ২০১১ সালের ১২ মে, ফতোয়া বৈধ, তবে এর মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক বা কোনো ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে না বলে রায় দেন সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে বলা হয়, ধর্মীয় বিষয়ে ফতোয়া দেয়া যেতে পারে, তবে যথাযথ শিক্ষিত ব্যক্তি তা দিতে পারবেন। আর ফতোয়া গ্রহণের বিষয়টি হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত। কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ না করলে তাকে কোনো ধরনের শাস্তি দেয়া যাবে না। কারও অধিকার ক্ষুণœ হয় এমন কোনো ফতোয়া দেয়া যাবে না। তবে আদেশের তিন বছর পূর্ণ হলেও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়নি। কবে প্রকাশ পাবে তা জানেন না কেউ।

এদিকে ফতোয়া দেয়া নিয়ে যথাযথ দিক-নির্দেশনা না থাকায় স্বল্পজ্ঞানসম্পন্ন আরবি শিক্ষিত ব্যক্তিরা ফতোয়া দিয়ে চলেছেন বলে অভিযোগ করেছেন নারী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মীরা। তাদের মতে, কোরআন-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যার শিকার হচ্ছেন সমাজের দরিদ্র, নিরীহ মানুষ। এর মাধ্যমে দেশে নির্যাতনের হার বেড়ে গেছে। অথচ আপিল বিভাগের আদেশে কোন কোন ব্যক্তি ফতোয়া দেয়ার যোগ্যতা রাখেন তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আদেশের পূর্ণাঙ্গ কপি না পাওয়ায় নির্দেশনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন অভিজ্ঞ মুফতি এবং আলেম সমাজ। ফলে দেশে ফতোয়ার নির্মম বলি হচ্ছেন অসহায়, দরিদ্র বিশেষ করে নারীরা। নর-নারী।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ফতোয়ার শিকার হয়েছেন মোট ২৭৯ নারী। এর মধ্যে ২০০৬ সালে ৩৯ জন, ২০০৭ সালে ৩৫ জন, ২০০৮ সালে ২০ জন, ২০০৯ সালে ৩৫ জন ২০১০ সালে ২২ জন, ২০১১ সালে ৫৯ জন, ২০১২ সালে ৪৮ জন এবং ২০১৩ সালে ২১ জন ফতোয়ার শিকার হন।

এ বিষয়ে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া ফতোয়া দন্ডবিধির ৫০৮ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই বিধির অন্যান্য ধারা অনুযায়ী ফতোয়া কার্যকরের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। তবে অজ্ঞতার কারণে ফতোয়া বন্ধ করা যাচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের ছাতকছড়া গ্রামের নূরজাহানকে পাথর ছোড়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর দেশে ফতোয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। তখন যেনতেন ব্যক্তির ফতোয়া প্রদান বন্ধের দাবি জানান দেশের প্রগতিশীল সমাজ। এরপর ২০০০ সালের ২ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকে ফতোয়া সংক্রান্ত একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার কীর্তিপুর ইউনিয়নের আতিথা গ্রামের এক গৃহবধূকে ফতোয়ার মাধ্যমে হিল্লা বিয়ে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। বিষয়টি দৃষ্টিতে এলে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০১ সালের ১ জানুয়ারি বিচারপতি গোলাম রাব্বানী এবং বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার হাইকোর্ট বেঞ্চ সব ধরনের ফতোয়াকে ‘অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত’ বলে আদেশ দেন।

আদেশে বলা হয়, একমাত্র আদালতই মুসলিম বা অন্য কোনো আইন অনুযায়ী আইন সংক্রান্ত কোনো মতামত দিতে পারেন। কেউ ফতোয়া দিলে তা ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য হবে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে মুফতি মো. তৈয়ব এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আপিল করেন। এরপর আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও নারী নেত্রী মালেকা বেগমসহ অন্যরা আপিলে পক্ষভুক্ত হন। ১০ বছর পর অর্থাৎ ২০১১ সালের ১ মার্চ আপিলের শুনানি শুরু হয়। ওই বছরের ১২ মে ফতোয়াকে বৈধ তবে শাস্তি অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন আপিল বিভাগ।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.