
লীনা দিলরুবা: রাজধানী থেকে টানা তিন ঘন্টার জার্নি করেও ক্লান্তি লাগেনি। মাথায় ঘুরছে কখন পৌঁছুবো কাঙ্খিত জায়গায়। জানা ছিল বাড়ির নামটি-অবকাশ। ঠিকানাও জানা।
শহরে পৌঁছে অবসর পর্যন্ত পৌঁছুতে ডান-বাম করে করে যতো এগোই সারাপথে চোখে পড়ে ছিমছাম নীরব একটা পরিবেশ। একসময় হাজির হই অবকাশ এর দোরগোড়ায়। পাড়ার মতোই অবিকল একরকম অবকাশও। ঠান্ডা, ঝিম মারা পরিবেশ এখানেও। বাড়ির প্রবেশদ্বারে পৌঁছে দেখতে পাই দুধসাদা রঙের ফটক। সামনে খোলা লন। পরিচয় পর্ব সারা হলো। তাঁর আদর্শের অনুরাগী অনেকেই এখানে আসেন। প্রবেশে কোনো বাধা পড়েনি।
অবকাশ- লেখিকা তসলিমা নাসরিনের বাড়ি। ছোট্ট এই ব-দ্বীপের সীমানা ছাড়িয়ে যার লেখা পৌঁছে গেছে অন্যদেশে, মহাদেশ ছাপিয়ে অন্য মহাদেশে। যার লেখা সমাজবদলের ডাক দেয়, ভেঙে দিতে চায় অচলায়তন।
অবকাশে পা রেখে নিজের কিশোরী বেলার কথা মনে পড়ে যায়। শৈশবের অমল বয়স পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখার সময় কতশত সমস্যা আর সামাাজিক ট্যাবু পার হয়ে আসতে হয় মেয়েদের। নিজের সমস্যাগুলোর কথা কাউকে না বলতে পারার বেদনা, সমাজের কাছে মানুষ হিসেবে পরিচিত হবার চেয়ে মেয়ে হিসেবে চিহ্নিত হবার ক্রাইসিস এবং সেটি প্রিয়জনদেরও বলতে না পারার কষ্ট দগদগে ঘা হয়ে মনে-শরীরে জুড়ে থাকতো। ঠিক সেসময় পরম বন্ধুর মতো পাশে পেয়েছিলাম তসলিমা নাসরিনের লেখাগুলোকে।
সবকিছুকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার বিষয়টি তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়েই আমাদের জানা হয়। তাঁর লেখা পড়েই আমাদের শেখা হয়, সমাজের প্রথাগত ভাবনা ছাপিয়ে নিজের একটা যুক্তিবাদী মতামত প্রতিষ্ঠিত হলে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা করায়ত্ত হলে, একটি মেয়ে কেবলই মেয়ে থাকে না, সে মানুষ পরিচয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। তিনি যেন নীরবে দীক্ষা দান করে গেছেন, আলো হাতে আঁধারের যাত্রীদের মতো এগিয়ে নিয়ে গেছেন লক্ষ্য অর্জনে। তাঁর লেখা কবিতা পড়ে আমরা জেনেছিলাম শৃঙ্খল ভাঙার গান। অবকাশে পৌঁছে তাই শরীর থরথর করে কাঁপে, বাড়িতে পা রাখার পরও বিশ্বাস হতে চায় না আমি দাঁড়িয়ে আছি তসলিমা নাসরিনের বাড়ির আঙিনায়।
একসময় পুরো বাড়ি প্রদক্ষিণ করি। দেখি তাঁর লেখার ঘর, তাঁর বেড়ে ওঠার জায়গাটিকে। তাঁর লেখা গ্রন্থাবলীও। স্বজনদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাই। একসময় ফেরার তাগিদ নিতে হয়। বিদায় সম্ভাষণ জানাতে গিয়ে তাঁর স্বজনদের বেদনা আমাদের ছুঁয়ে যায়। কতোদিন তাঁর ভাইপো, তাঁর অগ্রজ তাঁকে দেখেন না। তাঁর স্পর্শ বঞ্চিত তার ঘর, লেখার টেবিল, শোবার ঘরের আসবাব। তাঁর স্বজনদের গোপন রোদন আমাদের বেদনার্ত করে।
ফিরে আসার সময় স্মৃতি-বিস্মৃতির দোলায় দুলতে থাকি। যাত্রাপথের মোহগ্রস্ততা আর প্রস্থানের ভাবনা একরকম থাকে না। মনের ভেতর জমা হয় অসহায় ক্ষোভ। দ্রোহ। শুধুমাত্র লেখার জন্য তসলিমা নাসরিনকে তাঁর প্রিয় দেশ ছেড়ে ভিনদেশে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। কলমের স্বাধীনতা আত্মসমর্পণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠের নিষ্ঠুরতার কাছে। শুধুমাত্র লিখে জনমানুষের কথা বলতেন তসলিমা নাসরিন অথচ সেসবকে কলমের মাধ্যমে যুক্তিগ্রাহ্য করে জবাব দেবার ক্ষমতা নেই বলে পেশীর জোর দেখিয়ে তাঁকে হেনস্থা করার মাধ্যমে দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
কতগুলো বছর তিনি স্বদেশ ছাড়া। নারীর অধিকারের কথা বলে, নারীর স্বাধীনতার কথা বলে সমাজের যে সংস্কারের কাজ তিনি করেছেন বদ্ধ সমাজ সেটি মেনে নিতে পারেনি। এ সমাজে তিনি আজ অপাংক্তেয়। অথচ তাঁর লেখাই এখনো অনেক কিশোরীর গোপন গহীন কষ্ট প্রশমিত করে। অন্ধকারে আলোর পথের নিশানা দেখায়।
পৃথিবী এখন অনেক এগিয়েছে। নারীরা এখন আর শুধুমাত্র প্রজননের বস্তু নয়। নারী আজ সমানতালে কাজ করে পুরুষের পাশাপশি পরিবারে, সমাজে ভূমিকা পালন করছে। তসলিমা যে সমাজের স্বপ্ন দেখতেন তার বাংলাদেশও সেই অগ্রযাত্রায় সামিল।
তসলিমা নাসরিনকে স্বদেশে ফেরার সুযোগ দিতে সরকারের কাছে আকুল আহবান জানাই। আধুনিক বিশ্ব আমাদের চিনুক ন্যায়বিচারের দেশ হিসেবে, যেখানে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা লিখতে গেলে নির্বাসিত হতে হবে না। তার প্রতি অমানবিক আচরণ বন্ধ করা হোক। এ দেশ কোনো কুপমণ্ডুকতার রাজ্য হিসেবে পরিচিত হোক আমরা তা চাই না। আমরা চাই, তসলিমা নাসরিন ফিরে আসুক। ‘অবকাশ’ ফিরে পাক তার প্রিয়জনকে।
তার স্বজনেরা তাদের প্রিয় নাসরিনকে মায়ায়, স্নেহে ঘিরে থাকুক, প্রত্যাশা থাকলো এটাই।