সাংবাদিকতা কি আদৌ কোন পেশা?

Amey 2তাসকিনা ইয়াসমিন: সাংবাদিকতা আসলেই কি কোন পেশা? যদি তাই হয়, তবে বেতন-বোনাস মেলে না কেন! এটা যদি সত্যি পেশা হতো তাহলে এ পেশায় রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক মর্যাদা থাকতো, কিন্তু সেটি তো বাস্তবে দেখা যায় না।

প্রায়ই দেখা যায়, সাংবাদিকদের ধরে কেউ পেটাচ্ছে। কেউ ‘কুকুর’ বলে গালি দিচ্ছে, সেই গালি আদৌ দিয়েছে কিনা সেটা জানতেই ফোন করছে কোন সাংবাদিক এবং সেই সাংবাদিক নিজেই বলছে, কোন কোন সাংবাদিককে ‘কুকুর’ বলাই যায়! শুনি আর অবাক হই – আমার স্বজাতি কাউকে ‘কুকুর’ বললে, আমি নিজে ‘কুকুর’ এর বাইরে হই কি করে?

আর সাংবাদিকতা কেন পেশা নয় এর জন্য এর সময় ঠিক না থাকা, কাজের ধরনের পরিবর্তন এবং এর পাশাপাশি বিডিনিউজ, একুশে টিভিতে যখন দেখি শিশু সাংবাদিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তখন প্রশ্নটা বেশি আসে মনে, কারণ যদি এটা পেশা হয় তাহলে শিশুরা সাংবাদিকতা করতে পারবে না।

কারণ, এই দেশে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ- আর যদি নেশা হয় তাহলে যেকেউ করতে পারবে। তবে, আজ সেই তর্কে যেতে চাই না।

আজ অন্য প্রসঙ্গে আসি – সাংবাদিকরা যদি মানুষ হয়, সাংবাদিকতা যদি পেশা হয় ঈদের আগে সাংবাদিকদের বেতন-বোনাস মিলবে নিশ্চয়! এবার সব হাউসের সংবাদকর্মীদের বেতন-বোনাস মিলবে তো! ঈদ-উল-ফিতর মুসলমানদের বড় ধর্মীয় উৎসব। এই দেশে যেহেতু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাধিক্য তাই এই উৎসব ঘিরে উৎসাহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতোই। দেশের বৃহৎ সংখ্যক জনগোষ্ঠির ঈদ উৎসব কেমন হবে এনিয়ে মিডিয়া কর্মীদের বিভিন্ন সংবাদ সংগ্রহে উৎসাহ-উদ্দীপনার ঘাটতি নেই।

এর মধ্যে রয়েছে ঈদের কেনাকাটা, ঈদে শহুরে মানুষের গ্রামে ফেরা, ঈদ জামায়াত, ঈদের আগের ও পরের প্রতিটি মূহূর্ত গণমাধ্যম কর্মীরা দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরছেন। কিন্তু যে সংবাদকর্মীরা ঈদ নিয়ে এত লিখছেন তাদের ভিতরের অবস্থাটা কি? যতদূর জানি, দেশে সাড়ে চারশ’র উপরে সংবাদপত্র রয়েছে। টিভি চ্যানেল রয়েছে প্রায় ৩০টি। রেডিওর সংখ্যা প্রায় ৩০টি, অনলাইনের সংখ্যা প্রায় চারশ। এই সব গণমাধ্যমের মধ্যে বেশিরভাগেরই বেতন নিয়মিত নয়। আর বেতন নিয়মিত না হওয়ার কারণে ঈদের আগে বোনাস মিলবে কিনা সেটা নিয়ে বেশির ভাগ হাউসের সাংবাদিকরাই সন্দিহান।

এক্ষেত্রে দেশের সাংবাদিক সমাজ ঠিক কি করছে? সে নিয়ে অনেকের মতো আমারও মনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এইতো ১৯ জুলাই ছিল ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ইফতার মাহফিল। এদিন এতে যোগ দেন দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ইফতারের আগে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় যোগ দেন। এসময় সাংবাদিক নেতাদের কয়েকজন তার কাছে অভিযোগ করেন যে, সরকার অষ্টম ওয়েজবোর্ড ঘোষণা করলেও অধিকাংশ মালিক তা মানছেন না। অনেক মালিক সাংবাদিকদের চাকরিচ্যূত করছেন। ন্যায্য পাওনাও দিচ্ছেন না। আবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন বেশি দামে ঠিকই নিচ্ছেন।

এসব শোনার পর প্রধানমন্ত্রী কি বলেছেন, তা অবশ্য গণমাধ্যম এবং ফেসবুকে পাওয়া পোষ্টে জানা যায়নি। তবে আশার কথা এই যে, প্রধানমন্ত্রীর কান পর্যন্ত কথাটি গেছে। তিনি যেহেতু অনেক বেশি মানবতাবাদী তিনি নিশ্চয় সাংবাদিক সমাজের এই বিষয়টি দেখার জন্য নিয়োজিতদের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে বলবেন!

বয়সে সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রায়ই বলতে শুনি, এই পেশায় তো বেতন ঠিকমতো হয়না এটা জেনে এসেছ, কাজেই এখানে এসে বেতন চাওয়া যাবে না। তাহলে কি এই দেশটা এগুবে না! এই দেশটা কি পিছিয়ে থাকবে! এই প্রশ্নের উত্তর পাই না। বেতন-বোনাস না পেলে সব শ্রমিকেরই কষ্ট হয়। এইদেশে শুধু গার্মেন্টস কর্মীদের না পাওয়ার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আর এই খবর প্রকাশ করে সংবাদকর্মীরাই। যাদের হাত দিয়ে এগুলো লেখা হয় এবং ছাপা হয় এর বেশিরভাগই আসে আমার-আমাদের মতো অর্ধভুখা, বেতন নিয়মিত না পাওয়া, সাংবাদিক-সংবাদকর্মীদের লেখার মধ্য দিয়েই। দুর্ভাগ্য এইটুকুই দেশের সব মিডিয়া পোশাক শ্রমিকদের সংগঠন (বিজিএমইএ) কি বলছে, সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় কি বলছে, শ্রমিক নেতারা কি বলছে, বিদেশী বায়াররা কি বলছে তা ফলাও করে ছাপায়, কিন্তু এই গণমাধ্যম কর্মীরাই যেসব গণমাধ্যমে বেতন-বোনাস ঠিকমতো হচ্ছে না তাদের কোন সংবাদ ছাপায় না! এইদেশের গণমাধ্যমে আসলে কোন ধরনের সুশাসন নেই। তাই এখানে কর্মরত সাংবাদিক-সংবাদকর্মীদের মালিকের তার ঘামে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়ের হিসাব জানা কোনভাবেই সম্ভব হয় না।

কোন কোন অফিসে বসের কাছে জুনিয়র সাংবাদিকরা বেতন কবে পাবে সেই সংবাদটাও সংগ্রহ করতে পারে না । তাদের সম্পূর্ণভাবে ভাগ্যের উপর নির্ভর করতে হয়! ভাগ্যে যেদিন টাকা পাওনা লেখা থাকবে সেদিনই টাকা মিলবে! তরুণ সাংবাদিকদের জন্য বড় কষ্টের বিষয় ঈদ শপিং এর সংবাদ। একদিকে সংবাদ সংগ্রহ করছে, কিন্তু নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনাকাটা করতে পারছে না। এটা যে কত বড় কষ্টের বিষয় একমাত্র সেই জানে যে এই পরিস্থিতিতে পড়ে।

এই বিষয়টি মাথায় রেখে গত মঙ্গলবার ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দেই এতে লিখি – ‘যে সব সাংবাদিকরা ঈদ শপিং এর সংবাদ করছেন, কিন্তু এখনো ঈদ বোনাস বা বেতন পাননি তাদের জন্য সহজ বুদ্ধি আপনারা দিনে নিউজ করবেন, আর সন্ধ্যার পর নীলক্ষেত মোড়ে ছিনতাই করবেন। যতই যাই বলুন না কেন ছিনতাইকারী একটা পেশা তো!’

অনেকে এটা পড়ে ভুল ভাববেন যে আমি বোধহয় ছিনতাই করাকে সাপোর্ট করছি। আমি মোটেও তা করছিনা। শুধু এই ধরনের কমেন্ট করে নিজের ক্ষোভটা প্রকাশ করেছি মাত্র। আমাদের অফিসগুলো ধরেই নিলাম শেষ সপ্তাহে বোনাস দেবে, তারা যদি নিয়মিত বেতনটা দিয়ে যায় তাহলে আমরা সেই বেতনের টাকা থেকেও কেনাকাটা করতে পারি! কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সেটাও হয়না!

আমাদের দেশের পরিস্থিতি দেখলে মনে হয়, এই দেশে প্রশাসন নেই, আইন নেই, শাসন নেই, কোন ব্যবস্থা নেই – এমনি এমনি চলছে সবকিছু। এই যে সাংবাদিকদের এত এত হাহাকার, কষ্ট, অপ্রাপ্তি কিছুই ছুঁয়ে যায় না সাংবাদিক নেতাদের! কিন্তু কেন, এ উত্তর আমার জানা নেই। নেতারাই ভাল বলতে পারবেন। গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য বেতন দেবার জন্য সময় বলা হয় – সংবাদ মাধ্যমের ক্ষেত্রে কোন বিবৃতি দেননা সাংবাদিক নেতৃবৃন্দরা। অথচ বাংলাদেশ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) এবং ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) রয়েছে। এরই সঙ্গে প্রায় প্রতিটি জেলার ঢাকায় কর্মরত সাংবাদিকদের সাংবাদিক সমিতি, প্রতি বিটের কর্মীদের বিট সমিতি ছাড়াও রিপোর্টারদের নিজস্ব সংগঠন, রিপোর্টার্স ইউনিটি, সাব এডিটরদের সংগঠন, টেলিভিশনের রিপোর্টার ক্যামেরা পারসনদের সংগঠন, অভাব নেই সংগঠনের। অথচ এরা কেউই সাংবাদিকদের বেতন-বোনাস নিয়ে কোন ধরনের কথা বলে না। ঈদ চলে আসছে বেশির ভাগ অফিস বেতনই দেয়নি-আবার বোনাস দেবে কখন! এসব নিয়ে আমাদের নেতারা কোন ধরনের উচ্চবাচ্য করছেন না, কোন বিবৃতি দিচ্ছেন না! বড়ই অদ্ভূত ব্যাপার!

এরই মধ্যে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫শ। এরমধ্যে সবমিলিয়ে চারশ নারী সদস্য হবেন। এই নারী সদস্য এবং পুরুষ সদস্যদের স্ত্রী ও মেয়েদের জন্য আয়োজন করে বসলেন ‘মেহেদী উৎসব’। যখন রিপোর্টারদের মন ক্ষত-বিক্ষত, বেতন-বোনাস না পেয়ে অসহায়ত্বে ভুগছেন ঠিক এই সময় পেশার সঙ্গে কোনভাবেই যায়ও না এমন একটা উৎসব আয়োজন করে কি লাভ করলেন সেটা এই সংগঠনের নেতৃবৃন্দই ভাল বলতে পারবেন।

সাংবাদিকরা যে বেতন-বোনাস ঠিকমতো পাচ্ছে না তাদের হাহাকারের প্রকাশ দেখা যায়, ফেসবুক-টুইটারে! অনেকেই এখানে নিজেদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরিবর্তন ডটকম এর রিপোর্টার এ ইসলাম মিঠু তার কষ্টের সীমানা এঁকেছেন ফেসবুকের দেয়ালে। নিজের সেলফিতে তিনি প্ল্যাকার্ড ‘আমি একজন সাংবাদিক আমাকে বেতন দিন’ বলে নিজের কষ্ট তুলে ধরেছেন। মিঠু পারলেও বেশিরভাগ সাংবাদিকই চাকরি চলে যাবার ভয়ে নীরব। তারা শুধু একে অন্যের সঙ্গে কানাঘুষো করছেন আর সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা চাইছেন- যেন ঈদের আগেই বেতন-বোনাস হয়। দুটো না হলেও অন্তত একটা যেন হয়।

আমি দেশের গণমাধ্যমের একজন খুব সামান্য কর্মী হিসেবে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই বলে প্রার্থনা করতে পারি যে, এদেশের গণমাধ্যম মালিকদের সুবুদ্ধি দাও যেন তারা শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে মজুরি দিয়ে দেয়, সরকারকে সুবুদ্ধি দাও যেন তারা দেশে শ্রম আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন করে, সাংবাদিক নেতৃবৃন্দকে সুবুদ্ধি দাও যেন তারা অধিকার আদায়ের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থেকে অধিকার নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠে কথা বলে, গণমাধ্যমের উচ্চ পদে আসীনদের সুবুদ্ধি দাও যেন তারা নিজ দায়িত্ব শুধু কর্মীর কাছে কাজ আদায় করে নেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তার নায্য পাওনা পাইয়ে দেয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখে এবং যে গণমাধ্যম কর্মী গণমাধ্যমে কাজ করছে সে যেন মুখ বুঁজে না থেকে সকল সহকর্মী মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে মাসের বেতন, উৎসব বোনাস এবং বাৎসরিক তার নায্য পাওনা নির্দিষ্ট সময়েই আদায় করে!

শেয়ার করুন: