হলুদ সাংবাদিকতা ও অনলাইন পত্রিকার ভূমিকা

Yellow 2ফারজানা কবীর খান (স্নিগ্ধা): পরচর্চ্চা একটি মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। পরিচিত অনেকেই বলেন, পরচর্চ্চা না করতে পারলে নাকি পুরো দিনটাই নষ্ট হয়ে যায়। কিংবা তাদের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব নয়। পরচর্চ্চা নামক এই ব্যাধিটি এখন সংক্রামক রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এই সংক্রামক রোগ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারছে না সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্র- পত্রিকাগুলোও।

হলুদ সাংবাদিকতার জন্য বিখ্যাত পাপারাৎসিদের অনুকরণ করছে এখন বাংলাদেশের মূলধারার পত্র -পত্রিকাগুলো। অথচ একটা সময় ছিল যখন এ ধরনের হলুদ সাংবাদিকতা করতো দেশের কিছু সুনির্দিষ্ট পত্রিকা। নাম উল্লেখ না করলেও সবাই এসব পত্রিকার নাম বলে দিতে পারতো। কিন্তু এখন এই ধরনের সাংবাদিকতায় নাম লিখিয়েছে দেশের বড় বড় খ্যাতিমান পত্রিকাগুলোও। বিশেষ করে অনলাইন পত্রিকাগুলো এ ব্যাপারে এক কাঠি আগে দাঁড়িয়ে আছে। অনলাইন পত্রিকাগুলোর কোন হার্ডকপি না থাকায় তারা এর শতভাগ সুবিধাটা নিয়ে থাকে। অভিযোগ উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে ‘দুঃখিত’ বলে খবরটি সরিয়ে নেয়। অনেক পত্রিকার আবার দুঃখ প্রকাশ করার দায়িত্ববোধটুকুও থাকে না।

দায়িত্বহীনতার কারণে কোন বিখ্যাত নারী বা পুরুষের সবচেয়ে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে সবসময় তাদের মাথা ঘামাতে দেখা যায়।  এই দায়িত্বহীনতা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছায় যে তারা সেলিব্রেটি নারী ও পুরুষকে নিয়ে যাচ্ছেতাই হলুদ সাংবাদিকতা করে থাকেন। আর অনলাইনে ক্লিক ও পাঠক বাড়ানোর জন্যও এটি অন্যতম এক ফন্দি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য তারা বিভিন্ন উদ্ভট শিরোনামের আশ্রয় নিয়ে থাকেন, যাতে পাঠক আকৃষ্ট হয়। বিশেষ করে পর্নো শিরোনাম হলে তো কথাই নেই।

উদাহরণস্বরূপ কিছুদিন আগে বাংলাদেশী কোন এক সঙ্গীত শিল্পীকে নিয়ে অনলাইনে ঝড় উঠেছিল, তার নাকি একটি পর্ণো ভিডিও ক্লিপ পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে। খবরটির শিরোনাম এমন ছিল যে, যে কেউ লালায়িত ও অতি উৎসুক হয়ে খবরটিতে ক্লিক করবেন। ঘটনার বৃত্তান্ত দেয়ার পর, খবরটির শেষে লেখা ছিল, উক্ত সঙ্গীত শিল্পীর চেহারার সঙ্গে মিল থাকলেও আসলে সেই ভিডিও ক্লিপটি অন্য কারো বলেই ধারণা করা হচ্ছে। আর কোন পাঠক যদি পুরো খবরটি না পড়েন, তাহলে তাদের ধারণা হবে বোধহয় উক্ত সঙ্গীত শিল্পীর সত্যিই কোন পর্ণো ভিডিও এটি।

এটি গেল যৌনতা নিয়ে অনলাইন খবরের নোংরা ব্যবসা। এই হলুদ সাংবাদিকতার ব্যবসা থেমে নেই বিয়ের মতো একটি সামাজিক বন্ধনকে নিয়ে নোংরামি করার ক্ষেত্রেও। বিয়ে একজন নারী ও পুরুষের একসঙ্গে বসবাস করার জন্য একটি সামাজিক রীতি। বাংলাদেশে বা উপমহাদেশে বিয়ের জন্য পরিবারের সিদ্ধান্ত বা পছন্দকে প্রাধান্য দেয়া হয়। তবে এখন সময় বদলেছে। এখন দুজন মানুষের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অনেক শিক্ষিত পরিবার। আর দেশে আইনও আছে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, এতে পরিবার কোনো ধরনের বাধা দিতে পারবে না। অথচ বিয়ের মত সুন্দর ও সামাজিক প্রথাকে সম্মান করে, পছন্দের নারী বা পুরুষকে বিয়ে করলেও সে নিয়ে আলাদা করে খবর করতে ভুলেন না এই সব পত্রিকাওয়ালারা। আর সেলিব্রেটি হলে তো কথাই নেই।

একজন সেলিব্রেটি নারী বা পুরুষ বিয়ে করলে তা নিয়ে জন সাধারণের মাঝে এমনতিই আগ্রহের সীমা থাকে না। সেক্ষেত্রে সেই নারী বা পুরুষের ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক অতীত ঘটনা নিয়ে মুখরোচক গল্প তৈরি করে, একটি অতিরঞ্জিত শিরোনাম দিয়ে মনের মাধুরীর সমস্ত রস সেখানে নিসৃত করে, পাঠকদের আকর্ষণ করার সকল কুপন্থা প্রয়োগ করেন এই পত্রিকাগুলো। যা রীতিমত আপত্তিকর এবং বেআইনী।

এ ক্ষেত্রে যাকে নিয়ে এমন রুচিহীন ও নিম্নমানের সংবাদ প্রকাশ করা হয়, তিনি চাইলেই সেই পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশের যে কোন আইনী প্রক্রিয়া এত ধীর গতিতে চলে যে এবং তা বিচারপ্রার্থীকে এত ভোগান্তি ফেলে যে তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেকেই আইনের দ্বারস্থ হওয়ার ঝামেলায় জড়াতে চায় না। এছাড়া আইনের সঠিক প্রয়োগ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা আশানুরুপ নয় বলে, বাংলাদেশের পত্র -পত্রিকার খবর প্রকাশের উপর নির্দিষ্ট আইনকানুন থাকা সত্ত্বেও অনেক সাংবাদিকরা তা মেনে চলা তো দূরের কথা, তার তোয়াক্কাই করেন না।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আমরা বাক-স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। কিন্তু বাক-স্বাধীনতা যখন অন্যের ক্ষতিসাধন করে কিংবা অন্যকে নিয়ে পরচর্চ্চার দিকে এগিয়ে যায়, তখন তা আর কোনভাবেই বাক-স্বাধীনতায় থাকতে পারে না, তা অপসাংবাদিকতার দিকে মোড় নেয়। প্রাপ্ত বয়স্ক একজন নারী বা পুরুষ কাকে বিয়ে করবেন, সেটা তাদের একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার। সে বা তারা কোন ধর্মানুসারী বা তার আগে কোন অতীত ছিল কিনা তা নিয়ে লেখার বা পরচর্চ্চা করার অধিকার সাংবাদিকতার কোন নীতিতে পরে তা আমার মত সাধারণ মানুষের বোধগম্য নয়। তবে পত্রিকাগুলো যে তাদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে, তা নিয়ে আমার মতো অনেকেই একমত হবেন বলেই আশা করছি।

সম্প্রতি আমেরিকায় বসবাসরত একজন বাংলাদেশী অভিনেত্রী বিয়ে করেছেন। তার এই বিয়ের ঘটনা নিয়ে তার এবং তার পরিবারের পক্ষ থেকে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেয়া ব্যাখ্যাটি পড়ে যে কোন সুস্থ মনের মানুষের তার ও তার পরিবারে প্রতি এবং বিয়ের মত এই সামাজিক রীতির প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যাবার কথা। অথচ আমাদের দেশের অনেক সাংবাদিক এই চমৎকার মানবিক ঘটনাটিকে বিকৃত, অশ্লীল ও আদিম প্রক্রিয়ায় তাদের ইচ্ছামতো রসালোভাবে পরিবেশন করে দায়িত্বহীনতার পরিচয়ই শুধু দেননি, পাশাপাশি হলুদ সাংবাদিকতার আশ্রয় নিয়ে নিজেদেরকে বিতর্কিতও করেছেন। সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশায় তাদের এই দায়িত্বহীনতা ও অজ্ঞতার প্রতি আমি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

ফারজানা কবীর খান (স্নিগ্ধা)

বন, জার্মানি
এক্টিভিষ্ট, সাংবাদিকতার ছাত্রী এবং  ডয়েচেভেলের প্রাক্তন একজন সংবাদকর্মী

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.