ফাতেমা জোহরা হক কাকলী: ঈদ বাঙালি মুসলিমের জন্য একটা বড় উপলক্ষ যেখানে শিশুরা অনিবার্যভাবে উপহার পেয়ে থাকে, এমনকি সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও এসময়ে সন্তানদের উপহার দিয়ে থাকেন। এমনতো হয়ই যে, হয়তো তা কেবল পোশাকের বোঝা বাড়ায়। তা বিত্তবানদের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবেই ঘটে। ফলে, শিশুদের পুস্তকপাঠের আনন্দটুকু একটা পোশাকপ্রাপ্তির আনন্দের চেয়েও বেশি হতে পারে, তা অভিভাবকগণ চিন্তাও করেন না। বা, একটি গ্রন্থ শিশুদের মননশীলতা ও চিন্তার প্রসারণে কতোটা ভূমিকা রাখতে পারে, সেটাও আজকালকার বাবা-মায়েরা ভাবেন না।
জীবনের উপভোগ, এবং তার মধ্য থেকে সৃষ্টিশীল কিছু করবার প্রেরণা শিশুরা এখন আর পায় না শিশুর শিল্পসত্তার বিকাশে তাই সদগ্রন্থ পাঠ একটা স্বর্গীয় উপহার। উপনিষদে বলা আছে একজন মানুষ অমৃতের আস্বাদ পেতে পারে সদ্-গ্রন্থ পাঠে ও সাধু সান্নিধ্যে। আর এই সাধু-সান্নিধ্যও সদ্-গ্রন্থ পাঠে পাওয়া সম্ভব।
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের শিশুরই দরকার সাসটেইনেবল এডুকেশন। কারণ, এখনকার শিশুর বিশ্বমানব হয়ে গড়ে উঠবার কথা। এ দেশে অর্জিত জ্ঞান যদি বিদেশে গিয়ে কাজে না লাগে, যদি এদেশ থেকে অধীত বিদ্যা, দর্শনে আন্তর্জাতিকতার প্রসাদ উপ্ত না থাকে, তবে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য। ফলে, পুস্তক পাঠের কোনো বিকল্প নেই। আর এ পুস্তক তো ক্রয়-অক্ষম শিশুরা নিজগুণে পেতে পারে না, তাকে উপহার দেবার প্রবণতাই পারে পুস্তকের কাছে শিশুদের নিয়ে যেতে। আর, এই প্রবণতাটা সারাবছরের জন্য গড়ে উঠবে যদি আমরা তা ঈদ-উপহার দিয়ে শুরু করতে পারি।
মনে রাখতে হবে, উপনিষদে বিবৃত “সদগ্রন্থে”র কথা। ভালো বইয়ের কাছে শিশুদেরকে নিয়ে যেতে হবে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। চারিদিকে এতো বেশী কলুষতা, সে ক্ষেত্রে বইয়ের কোন বিকল্প নেই।। বই পারে আমাদের শিশুদের মূল্যবোধকে জাগ্রত করতে। মানবিকতা,নান্দনিকতা,সুন্দরের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারে একমাত্র বই।।
আমাদের শিশুরা তাদের ইট-সুড়কিতে ঘেরা যান্ত্রিক জীবনে প্রকৃতি জগৎ জীবন থেকে অনেক দূরবর্তী। তারা আকাশ দেখে না, তারা বাতাসের সুগন্ধ পায় না। তাদের জীবন টিভি বাক্সের এনিমেশন করা সংস্কৃতি ঘিরে রেখেছে।
মাটির সঙ্গে, স্বদেশের সঙ্গে তার যোগ নেই। এমনকি অগ্রবর্তী সভ্যতার সঙ্গেও শেকড় ছেঁড়া এই আকাশ-সংস্কৃতির শৈশব। সেখানে যা কিছু শুভ, তার দেখা সব শিশুরা পায় না। ফলে গ্রন্থপাঠ শিশুদের কল্পনাপ্রতিভাকে যেমন উদ্রিক্ত করবে, তেমনই স্বাদেশিকক চেতনায় আপ্লুত করবে, বিশ্বের সঙ্গে তার সংস্কৃতির যোগ সে নির্ণয় করতে পারবে।
আমাদের দেশে ত্রি-নীতি শিক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান। শিক্ষাব্যবস্থার অসাম্য ও বিভাজনের মাঝে একমাত্র গ্রন্থপাঠই পারে তিন প্রকারের শিশুদের একটা মানসিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে, চেতনাগত ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে। সেটা যদিও অলীক, তবে অসম্ভব নয়। আমাদের সমাজে বৈষম্য আছে, শিক্ষায় এবং অর্থনৈতিক, এবং সংস্কৃতিগত।

ফলে বই পড়াই পারে চেতনার দিক থেকে সমতা দিতে, যা সমস্ত বৈষম্যকে সরলরেখায় নিয়ে আসতে পারে।
পোষাক মানুষকে বাহ্যিক ঔজ্জ্বল্য দিতে পারে, পোষাক নষ্টও হয়ে যায়, ম্লান হয়ে যায়, বইপাঠের আনন্দ মলিন হয় না, তা বাহিত হয়।
ঈদ বাঙ্গালীদের আনন্দের উৎসব। বই তার শব্দে অন্তহীন আনন্দ ধারন করে। খেলনা ভেঙ্গে যায়, জামা কাপড় পুরনো হয়ে যাবে, কিন্তু বই পাথের আনন্দ কখনো ফুরায় না। টা অনিঃশেষ; বংশ পরম্পরায় বাহিত হয়। ফলে বই হতে পারে ঈদের যোগ্য উপহার। বাঙ্গালী নিত্য দিনের উৎসবে বই কে শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার প্রক্রিয়াটি খুব একটা সহজ নয়, তাই, আমাদের যে কোন আয়োজনে, কোথাও বেড়াতে গেলে, জন্মদিনে বা নানান সামাজিক উৎসবে খাদ্য দ্রব্য বা পোশাক, খেলনা নিয়ে যাবার রীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। পৃথিবীর যে কোন সুন্দর উপহার হিসেবে নশ্বর, একমাত্র বই-ই অবিনশ্বর। টা চেতনা বাহিত ব্যাপার। চেতনাই তো মনুষ্যত্বের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাপার। চেতনাগত ভাবে সমাজের স্থুল শ্রেনী বিভাজন ঘুচানো সম্ভব একমাত্র বই পাঠের মাধ্যমে। চেতনাগত পরিণতি ও সমতা সামাজিক এই স্তরভেদ কে একটা নিরপেক্ষ বিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে। জ্ঞান চর্চা একটা বিনিময়- সম্ভব ব্যাপার। আর এই জ্ঞান অর্জিত হয় প্রাথমিক ভাবে গ্রন্থপাঠে। আর তা সংবর্ধিত হয়ে উঠে নতুনতর চিন্তার সংযোজনে। ফলে, গ্রন্থপাঠ ই পারে শিশুদের মৌলিক প্রতিভা, যা তা অনিবার্য ভাবেই সুপ্ত থাকে, তা বিকশিত করতে, অভিনব চিন্তার দিকে, জগত জীবনের নবোতর আবিষ্কারের নেশায় তাদেরকে নিয়োজিত করতে পারে।
যদিও আমাদের বাঙালিদের এই অভ্যাসটা গড়ে ওঠেনি বই উপহার দেবার। এই অভ্যাসটাও গড়ে তোলা দরকার। শুধু শিশুদের নয়, আসুন আমরা বড়দেরকেও বই তুলে দিই হাতে।
বই-ই হোক আমাদের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা, আশীর্বাদ বিনিময়ের উপায়।