মানুষকানা!

Tania Lopa
তানিয়া মোর্শেদ

তানিয়া মোর্শেদ: জীবনের বাঁকে বাঁকে কত কি যে ছড়ানো! একেকটি ঝাপ্টা (কখনো ঝড়) আসে, আর আমি আবিষ্কার করি, নিজেকে! গত দু’মাস (না কি আরো বেশী!) এত দিকে এত ধরনের কাজ, খেয়াল করা, সিদ্ধান্ত নেওয়া ইত্যাদি করতে হয়েছে, হচ্ছে যে মাঝে মাঝে ভাবছি, “আমি এখনো এত কিছু করতে পারি!”

তারিখ ভুলে গেছি, মে মাসের এক সময় ফোন এলো দীপ্ত যে হাইস্কুলে যেতে চায় সেখানে লটারিতে ওর নাম ওঠেনি! গত বৎসর পর্যন্ত ট্রান্সফার নিয়ে নিজের এলাকার বাইরের হাই স্কুলটিতে স্টুডেন্টরা পড়তে পেরেছে। এই বছর এতোজন যেতে চেয়েছে যে লটারি হয়েছে! ও এবং আরো কিছু স্টুডেন্ট বাদ গেছে।

এর আগেই জেনেছি যে, যে প্রাইভেট স্কুলটিতে অ্যাপ্লাই করেছিল (ক্যাথলিক একটি স্কুল, প্রাইভেট স্কুল মানেই কোনো না কোনো ধর্মের সাথে যুক্ত) টেস্টে হাই স্কোর পেলেও হয়নি! পরীক্ষা একটি অংশ মাত্র। ওরা আরো অনেক কিছু দেখে! ভাইভা সবাই দিতে পারেনি বলে (স্নো ফল এর জন্য) তা বাতিল হয়েছে। সেটাও ও খুব ভাল দিয়েছিল। আর কি দেখে? দেখে কতটা ধার্মিক (যে ধর্মেরই হোক না কেন)। অ্যাপ্লিকেশন ফর্মের বড় অংশ জুড়ে ধর্ম বিষয়ে প্রশ্ন। কোন চার্চ/টেম্পল ইত্যাদিতে যাও? প্রিস্ট/ধর্ম গুরু কে? ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

যে স্টুডেন্টের ফর্মে লেখা থাকে “হোম” তাকে কেন নেবে? এমনিতে অন্য ধর্মের অল্প কিছু কোটা আছে। তারপর এতজন পড়তে চাইছে। সেখানে যে স্টুডেন্টের বাড়িতে ধর্ম চর্চা/পালন হয় না, স্পিরিচুয়ালিটিতে বিশ্বাসী, তাকে কেন নেবে?! ধার্মিক, অতি ধার্মিক, ধর্মান্ধদের তো “বিশ্বাস” ধর্ম পালন না করা মানুষদের “মোরালিটি” বলে কিছু নেই!! এরা যা ইচ্ছে তাই করে, ভাবে!! সব ভালো কিছু ধার্মিকদের দখলে আর এরা হচ্ছে সব ………। যাক সে কথা।

মিজান ও আমি খুশী হয়েছিলাম জেনে যে দীপ্তকে ওরা নেয়নি। আশ্চর্য্যজনক না!? ধর্ম/ অধর্ম অন্তরের বিষয়, পরিধানের নয় এটা বিশ্বাস করা মানুষ কিভাবে সন্তানকে ধর্মের সাথে (যে কোনো) যুক্ত স্কুলে দেবে!! আর প্রাইভেট স্কুল নিয়ে আমার দ্বিমত আছে। যাক সে কথা। অনেকেই আহত হবেন! তবে লটারিতে পাবলিক স্কুলে না হওয়াতে ভাবলাম, ভালোই তো! ন্যায়-অন্যায়, খারাপ-ভাল সারাক্ষণ চিন্তা করা, পালন করা মানুষের পুরষ্কার জুটেছে!! এর মধ্যেই জেনেছি, চেনা এক মানুষ কাম্য স্কুলের এলাকায় অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে সেই ঠিকানা ব্যবহার করেছে! না সেখানে থাকবে না। আরো কেউ কেউ যে করবে তা বোঝা আছে।

যেদিন ফোন পেয়েছিলাম, তার আগেরদিনই ফেইসবুকের এক বন্ধু স্ট্যাটাসে সব দিক বন্ধ বলে লিখেছিল। আমি তাকে লিখেছিলাম যে, ঘুরে অন্যদিকে যেতে বা সামনের দেওয়াল ভেঙ্গে যেতে। পরেরদিনই আমার রাস্তা বন্ধ দেখলাম! কিছু সময়ের মধ্যেই উঠে বাড়ীর সাজানো জিনিস প্যাক করা শুরু করলাম। অন্ততপক্ষে অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নেবো আর নিজেদের বাড়ি ভাড়া দেবো এই চিন্তায়। কয়েকদিনের মধ্যেই একটি বাড়ি দেখে মনে হলো কেনা যায় (গত অক্টোবর থেকেই দেখছিলাম বাড়ি, অসুস্থ্যতার জন্য মাঝে মাঝে বন্ধ ছিল)। বাড়ি থেকে অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া বেশ কঠিন (অসম্ভব না হলেও)। দামটা বেশী (আমাদের এখনকার বাড়ীর চেয়ে) তবে স্কয়ার ফুটেজে ২০০+ কম। আরো কমেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু সব মিলিয়ে অনেক সময় অনেক কিছু হয় না। প্রতিদিন শুধু জিনিসপত্র বাঁধাবাঁধি করছি! আর নিজেকে বকছি, “বাংলাদেশের জিনিস দিয়ে বাড়ি ভরানোর ফল এবার বুঝছো?” খুব সাবধানে সব কিছু প্যাক করতে হয়, ভঙ্গুর জিনিসপত্র। মুভাররা ভারী জিনিসপত্র নেবে। কিন্তু আমার শখের জিনিসগুলো নিজেই গুছাই (প্রতিবার!), নিয়েও যাবো নিজেরাই (বাড়িমাত্র ৫/৬ মিনিটের ড্রাইভ)। এর মাঝেই সিদ্ধান্ত নিলাম বর্তমান বাড়ি বিক্রি করে দেবো। ভাড়া দেওয়াটা “ভাগের‍্য” ব্যাপার। যদি নষ্ট করে দেয় বাড়ি! তাহলে আর্থিক ক্ষতি হবে অনেক। আর এবাড়ীতে আবার ফিরে আসবার দরকারো নেই।

শুরু হলো চুড়ান্ত ব্যস্ততা। নিজেরা বাড়িতে থেকে মার্কেটে দেওয়া কি ব্যাপার তা বুঝলাম! বাড়িকে “স্টেইজড হোম” বানাতে হবে। “নিউট্রাল লুক” দিতে হবে, যতটা সম্ভব “এথেনিক লুক” ত্যাগ করতে হবে! “আনক্লাটারড” করতে হবে! কাজ করতে করতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত, বিরক্ত হয়ে বলে বসলাম, “এমন ভাবে সাজাতে হবে যেন সাদাদের বাসা এটা তা মনে হয়!” দীপ্ত আশ্চর্য্য হয়ে তাকালে বললাম, “এথেনিক লুক” ত্যাগ করা মানে কি বোঝো?” বাংলাদেশী, ইন্ডিয়ান, চাইনীজ, কালো, হিস্পানিক, …… সব বাদ দিলে (সব এথনিক লুক) বাদ দিলে কি থাকে? নিজের প্রিয় জিনিস অন্যের কাছে “ক্লাটার”! আমি আগেই গুছানো শুরু করেছিলাম। স্টেইজিং এজেন্ট এসে মুগ্ধ। তবে কথা ওটাই, “এথিনিক লুক” কমাতে হবে! কারণ সবার কাছে আকর্ষণীয় করতে হবে বাড়ী! তাই নিউট্রাল লুক! যদিও আমরা যে বাড়িটি কিনছি বা আগে দেখা অনেক বাড়ীই, বুঝেছি কাদের (সাদাদের) বাড়ি!

একদিন কাজ করতে করতে রাত বারোটা পার, দীপ্ত এসে “শুভ জন্মদিন মা” বললো। আমি তখন পা মুড়ে মাটিতে বসে কিচেন ট্র্যাশবিন যেখানে থাকে সে জায়গা মুছছি! হেসে বললাম, “নিজেকে সিন্ডেরেলা মনে হচ্ছে!” মিজান আর দীপ্ত না বুঝে অবাক হয়ে তাকালো! আমি বললাম, “আমাকে দেখো!” বাড়ীকে সাজিয়ে গুছিয়ে মার্কেটে দেওয়া হলো। যদিও সবাই বলে মনে হয় না যে আট বৎসরের পুরনো বাড়ী! এত সুন্দর করে কিভাবে রাখো ইত্যাদি! এই আট বৎসরে শুধু একবার একজন ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করিয়েছিলাম, লাংসের প্রথমবার সার্জারীর আগে। মানুষ বাড়ী দেখে সুন্দর সুন্দর মন্তব্য করে যায়! যখন দেখতে আসে তার আগে আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়। রেডফিন (অনলাইন বাড়ীর বাজার) “হট হাউজ” স্টিকার দিয়েছে!

ভাবলাম, আমার মত এক ভ্যাবলা মানুষের বাড়ী “হট”! হট হাউজ মানে কি জানতাম না। দু’ সপ্তাহের মধ্যে অফার আসবে, তাই লেখা ছিল! বারো দিনের মাথায় দুটো এলো। একজন অ্যাস্কিং প্রাইজের চেয়েও এক হাজার বেশীতে অফার দিলো! সব ভালো। হঠাৎ কারণ ছাড়া তিনদিন পর অফার তুলে নিলো! পরে জেনেছি, এ প্রদেশে পাঁচ দিন পর্যন্ত তা করা যায়, কোনো কারণ ছাড়াই! যা নিউ ইয়র্ক প্রদেশে মাত্র কয়েক ঘন্টা পর আর করা যায় না! মানুষ তখনই “আইন” তৈরী করে যখন অনেক মানুষ আনএথিক্যাল কাজ করে এবং তাতে আরো অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়! এক দু’জনে কি যায় আসে!!

এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন, কোন দেশীয়? শুনে বললেন, “এরা কোনো এথিক্স, মানবিক কিছু্রই ধার ধারে না।” আরো একজন সহমত হলো! বুঝলাম, কাজের জায়গায় অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে সেই দেশের মানুষের সাথে!। তাছাড়া এরা এমন কথা বলবার মানুষ নন।

বললেন, “এরপর আর এই দেশীদের অফার অ্যাক্সেপ্ট করো না।”আমি বললাম, “তাহলে আমি তো রেসিস্ট হয়ে যাবো!” ততদিনে দ্বিতীয় অফার হাত ছাড়া হয়ে গেছে! বাড়ি আবার মার্কেটে ফিরে এলো! মনে হয় যেন মেয়েকে সাজিয়ে গুজিয়ে বর পক্ষের সামনে তুলে ধরি! সব দেখে সুন্দর মন্তব্য করে চলে যান! একজন এনগেইজমেন্ট করে ক’দিন পর আংটি ফেরৎ নিয়ে গেছে বিনা কারণে! মেয়ে দেখার/ বিয়ের নোংরা সামাজিক নিয়ম (বাংলাদেশ, ভারত সহ যে সব দেশে এখনো আছে) আমাকে মেয়ে বেচা-কেনার কথাই বলে!

এদিকে আমরা যে বাড়ি কিনবো (কিনেছি) তারা সময়টা এগিয়ে আনতে বললো (ক্লোজিং-এর) কিন্তু বাড়ি দেবে সাতদিন পরে! মানুষের সুবিধা-অসুবিধা না দেখলে আমি “অমানুষ” হই কী ভাবে! সব কিছুতেই রাজী! বাড়ি ক্লোজিং-এর পর “অমানুষ” হবার পুরষ্কার কি পেয়েছি তা আর বললাম না! না কি একটু বলি! সব কিছুর চাবি ঠিক মত পাইনি, শাওয়ার কার্টেনের রড নিয়ে গেছে বলাতে তার দাম “দশ’ ডলার, কোথায় পাওয়া যায় জানিয়েছে!” না এরা সবাই সমাজের উচ্চ স্তরেরই মানুষ! মানুষের ব্যবহার (ভালো কি মন্দ) অনেক কিছুর সাথে রিলেটেড। সমাজ, শিক্ষা, আর্থিক অবস্থা, দেশ, সংস্কৃতি, ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতা-যুদ্ধ-কষ্ট ইত্যাদি এতে অনেক অবদান রাখে তা অবশ্যই সত্যি কিন্তু তা কখনোই গ্যারান্টি দেয় না ভালো বা খারাপ ব্যবহারের। জানি আমার সাথে সহমত পোষণকারী মানুষ হাতে গোণা কয়েকজন!

হঠাৎ ফোনে মেসেজ পেলাম, গ্র্যান্ডমা কে দু’দিনের জন্য (আসলে তারো কম সময়) এখানে আসছেন! প্রায় ৭৬ বৎসর বয়সে এখনো পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো মানুষটি একা ড্রাইভ করে কলোর‍্যাডো থেকে আসছেন! গতকাল প্রায় সারাদিন আমার সাথে সময় কাটালেন (মিজান, সবিতা, প্রণবদা অফিসে)! অনেক কথা! আমাদের বাড়িতে এসেই প্রথমে আমার বইটি দেখতে চাইলেন, অনেক কিছু জানতে চাইলেন, কি লিখেছি ইত্যাদি। মন্তব্য করলেন। তাঁকে নিয়ে লেখা পাতাটি দেখালে চোখ ছলছল করে উঠলো! কি লিখেছি না জেনেই! আমাকে অবাক করে দিয়ে এক কপি কিনে নিলেন! বাংলায় লেখা বই কিনলেন! আমি বললাম কি করবে, তুমি তো কিছু বুঝবে না? তবুও নিলেন! টাকা নেবো না বলাতে রাজী হলেন না। বললেন ,”তুমি তোমার কোনো কজে দিও।” এই প্রচন্ড গরমে মানুষটি একা ড্রাইভ করে ভালোভাবে কলোর‍্যাডো না পৌঁছানো পর্যন্ত চিন্তায় থাকবো। ফিরেই ছুটবেন বেলজিয়াম! বৎসরের শেষে ইকুয়েডোর! আগামী বৎসর আরো কত জায়গায়! প্রায় পুরো পৃথিবীটাই তাঁর দেখা। আমি সুস্থ থাকলে বাংলাদেশ নিয়ে যেতাম! সেখানে এখনো যাওয়া হয়নি তাঁর! বারে বারে (এখন পর্যন্ত) নিজের শরীর (মনের কথা থাক) একেকটা যুদ্ধ করে যেমন দেখাচ্ছে, এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাও! থেমো না! হঠাৎ হঠাৎ কোনো মানুষ নিঃর্শত ভালবাসা দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, “তুমি সারাজীবন মানুষকানাই থাকো। যারা বোঝে না তারা না বুঝেই থাক, তুমি তোমার মতই থাকো।”

শেয়ার করুন: