সুমন্দভাষিণী: গত ১৩ এবং ১৪ জুলাই জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ব্রিজিং প্রোগ্রাম ফর জার্নালিস্টস’ নামের একটি কর্মশালা।ঢাকার যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের সহায়তায় নারী সাংবাদিকদের দু’দিনব্যাপি এই অভিজ্ঞতা বিনিময় কর্মশালাটি গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে পরিণত হয়েছিল প্রাণবন্ত এক আড্ডায়। বিভিন্ন মিডিয়া হাউসের ছোটবড়, সিনিয়র-জুনিয়র মিলে প্রায় ২০ জন সাংবাদিক অংশ নেন এতে।
দুদিনের এই আড্ডার মূল কথা হলো, এখন, এই মূহূর্ত থেকে সহকর্মীরা যেন সহমর্মিতা প্রদর্শণে পিছপা না হই সেই প্রত্যাশা। যারা এসেছিলেন সবাই সবাইকে চেনে-জানে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে। আসলেই কী জানে? এ প্রশ্নটিই ঘুরপাক খাচ্ছিল দুদিন ধরে। যাদের সাথে আমরা পথ চলি, কথা বলি, এমনকি অনেক বিষয় শেয়ারও করি, তারপরও কি বলা হয় সব কথা? বলা হয় না, ফলে জানাও হয় না। কিন্তু এই দুদিনের পরিবেশটাই এমন হয়ে গিয়েছিল যে, সবাই না জানতে চাইতেই কথা বলা শুরু করেছিলেন। বলেছিলেন কর্মক্ষেত্রে তারা কি ধরনের বৈরিতার মুখোমুখি হন বা অতীতে হয়েছেন, বা এখনও হচ্ছেন। নিজেদের দু:খ-কষ্টগুলো শেয়ার করতে করতে বরাবরের কাছের মানুষগুলো আরো কাছের হয়ে গেলাম। নতুন করে প্রত্যয় নিলাম হাতে হাত ধরে চলার।
অপেক্ষাকৃত জুনিয়র সাংবাদিক মেয়েরা বড় বোনদের কাছে পেয়ে যেন একটা প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পেল। কেউ কেউ ঝর ঝর করে কেঁদেও ফেললো নিজের লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে। সিনিয়ররা তখন তাদের জীবনের কথা শোনায়, জানায় লড়াই করে টিকে থাকার কথা, কোথাও কোথাও কম্প্রোমাইজ করার কথা। জানি না জুনিয়ররা এতে সান্ত্বনা পায় কিনা, তবে এটুকু বোঝে যে, এই লড়াই একা তারই নয় কেবল, এটা সবার। এবং সর্বোপরি কর্মপরিবেশের কিছুটা উন্নতি হলেও নারী সাংবাদিকদের এখনও অনেক পথ হাঁটার বাকি।
কর্মশালাটি হয়ে দাঁড়িয়েছিল অংশগ্রহণকারীদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতামূলক আশ্বাসের এক অক্সিজেনক্ষেত্র। নিজেদের পেশা, এর দীনতা নিয়ে এতো খোলামেলা আলোচনা কোনদিন শোনা হয়নি।
কর্মশালাটি যার উদ্যোগে হয়েছে, ভোরের কাগজ পত্রিকার কূটনৈতিক প্রতিবেদক আঙ্গুর নাহার মন্টি বলছিলেন, ‘ইচ্ছে ছিল আমাদের নৌকায় অনেককে উঠানোর, কিন্তু নৌকাটি এতো ছোট যে সবাইকে স্থান দিতে পারিনি। তাই চেষ্টা করেছি নানাভাবে তিনগুন সহযোদ্ধাকে পাশে রাখতে। সাংবাদিকতার বাইরে প্রথম এমন কাজে এতো সহযোগিতা আমাকে ভীষণভাবে আপ্লুত করেছে। বন্ধু-সিনিয়র-জুনিয়র সকলের এতো ভালবাসা আমাকে সামনে আরো কাজ করার সাহস ও শক্তি যোগাবে নিশ্চয়ই’।
আমরাও বলাবলি করেছি, সবে তো নতুন একটা পথের শুরু, অনেক পথ এগোতে হবে, পিছিয়ে পড়ার কোন অবকাশ নেই। কথা একটাই, কাঁধে কাঁধে ঠাঁই দিতে হবে একে-অপরকে, অন্তত কান্নার জন্য হলেও।
সিনিয়র সাংবাদিক ফরিদা ইয়াসমীন যেমনটি বলছিলেন, গত ২৬ বছরে তার সাংবাদিকতা পেশায় অর্জন কিছুই না। বরং এতো বছর টিকে থাকার জন্য একটা মেডেল চান তিনি। বলেন, তাদের সময়ে সাংবাদিকতা শুরু করেছিল এমন অনেকেই ছেড়ে চলে গেছে অন্য পেশায়, কিন্তু যখন মেয়ে রিপোর্টার নেয়ার কথা ভাবতেই পারতো না মিডিয়া হাউসগুলো তখনই তিনি এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। সব ধরনের প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে তিনি এখনও টিকে আছেন। তিনি গেরিলা নেটওয়ার্কিং গড়ে তোলার ব্যাপারে গুরুত্ব দেন।
মুনিমা সুলতানার মতে, মেয়েদের সাংবাদিকতা বিষয়টি একটি স্টেরিওটাইপ সমস্যা। কেউ তৈরি করে দেয় না পথ, নিজেকেই করে নিতে হয়। অন্তত গত ২০ বছরে এটাই উপলব্ধি হয়েছে। প্রথমদিকে কোন মেন্টর ছিল না। এই অভাব নিয়েই কাজ শুরু করেন তিনি। মুনিমা আরও বলেন, সাধারণত বলা হয়ে থাকে, মেয়েদের জন্য ডেস্ক ওয়ার্ক, রিপোর্টিং তাদের জন্য না। কিন্তু আমি বলবো উল্টোটা। রিপোর্টিংই মেয়েদের জন্য উত্তম, তাতে করে সে তার সময়টাকে কাজে লাগাতে পারে, সাজিয়ে নিতে পারে। সংসার-সন্তান সামলানোর পথ সহজ হয়।
শাহনাজ মুন্নী বলছিলেন, টিকে থাকার জন্য মেয়েদের প্রমাণ দিতে হয় প্রতিনিয়ত। অথচ এটা ভুলে যায় সবাই যে, আমরা নারী সাংবাদিকতা করতে আসিনি, এসেছি সাংবাদিকতা করতে। এর মধ্যে পার্থক্য অনেক। আরেকটা বিষয় হলো, মা-নানীরা খুব একটা বের হতেন না। আমরা যেন বের হয়ে সমস্যায় পড়েছি, আর আমাদের সন্তানদের তো আরও সমস্যা বের না হয়েই। তাদের শিকার হতে হচ্ছে সাইবার নির্যাতনের। কাজেই সমস্যাগুলোর আপডেট নিয়ে এখন ভাবতে হবে।
দুদিনের কর্মশালায় অনেকেই মেয়েদের ‘স্ট্রং’ থাকার ওপর জোরারোপ করেছে। অনেকেই তাদের বর্তমান সমস্যার কথা তুলে ধরেছে। আরেক সিনিয়র সাংবাদিক রিনভী শারমিন তো জানিয়েই দিল যে, তার সংসার ভাঙার চেষ্টাও কম করেনি লোকজন। কিন্তু ঘরের মানুষটা ঠিক থাকায় দুষ্ট গ্রহের প্রভাব সেখানে পড়েনি। এসবই হয় পেশাগত ঈর্ষা থেকে।
চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র রিপোর্টার জান্নাতুল বাকেয়া কেকা বলেন, দু’দুবার মা হতে গিয়ে নানারকম তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বিট পর্যণ্ত হাতছাড়া হয়ে গেছে। এগুলো নিয়ে এখন জোটবদ্ধ হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই।
কর্মশালায় উপস্থিত অনলাইন পোর্টাল উইমেন চ্যাপ্টার এর সম্পাদক সুপ্রীতি ধর বলেন যে, এখন থেকে যথাসম্ভব প্রতি মাসে একটি করে গেট-টুগেদারের আয়োজন করা হবে, যাতে করে সবাই ধরে নিতে পারে যে, তারা কেউই একা নন। আর যেকোনো বিপদে বা সমস্যায় পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকারও করা হয় এই কর্মশালা থেকেই। দলমত নির্বিশেষে একে-অপরের পাশে দাঁড়াবে নারী সাংবাদিকরা। (সংকলিত)