মাতৃত্ব আগে, নাকি সাংবাদিকতা?

Women journalistঅনিন্দিতা রায়: অনেকদিন আগে একটা কর্মশালায় একজন নারীনেত্রী প্রশ্ন রেখেছিলেন অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে, মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু কে? কেউ বলেছিলেন, শাশুড়ি, কেউ ননদ, কেউ সামাজিক প্রেক্ষাপট ইত্যাদি। কিন্তু উনি নিজের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, মেয়েদের প্রধান শত্রু তার ‘প্রজনন ক্ষমতা’। অর্থাৎ তার মাতৃত্বের সৌভাগ্যকেই তিনি একজন নারীকে অবদমনের প্রধান হাতিয়ার বলে তুলে ধরেছিলেন।

বলেছিলেন, এই মা হওয়াটাই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে মাতৃত্ব, অন্যদিকে পেশাগত দায়িত্ব, সবমিলিয়ে একটা মেয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলে। না পারে মা হিসেবে সর্বংসহা ‘জননী’ হয়ে উঠতে, না পারে নিজেকে ‘অন্যতম কর্মদক্ষ’ হিসেবে প্রমাণ করতে। বিষয়টি নিয়ে অনেকবার নানাভাবে ভাবা হয়েছে।

সত্যিই কি তাই? তাহলে যে যুগে যুগে নারীকে মাতৃতুল্য হিসেবে বন্দনা করা হয়েছে! বলা হয়েছে, মাতৃত্বই নারীর আসল সৌন্দর্য! তবে কী বলা হবে যে, নারীকে আজীবন শৃঙ্খলিত করে রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে এই মাতৃত্ব?

বিতর্কে না গিয়েই বলা যায়, একজন কর্মজীবী নারীর জন্য তার মাতৃত্ব নানাভাবেই প্রতিবন্ধক হয়ে উঠে। বিশেষ কিছু পেশার ক্ষেত্রে এটা আরও কঠিন হয়। যেমন সাংবাদিকতাকেই ধরি না কেন, নারী সাংবাদিকরা একদিকে পেশার প্রতি অদম্য নেশা, অন্যদিকে সন্তান-সংসার সামলাতে গিয়ে প্রায়ই হিমশিম খায়। আগেকার দিনে এমন ক্ষেত্রে মেয়েরা হাল ছেড়ে দিয়ে হয় অন্য সাবলীল পেশায় চলে যেত, নইলে চাকরিই ছেড়ে দিত। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। এতো সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয় মেয়েরা। তারা শেষবিন্দু পর্যন্ত চেষ্টা করে যায় পেশা এবং সংসার-এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায়। আর তা করতে গিয়ে প্রায়ই কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হয় তারা।

একজন পুরুষ সহকর্মী কথায় কথায় বলছিলেন, কিছুদিন আগে এক আড্ডায় নাকি কয়েকজন সাংবাদিক মন্তব্য করেছেন এই বলে যে, মেয়েদের নিয়ে আর পারা যায় না। আজ এই সমস্যা তো কাল এই সমস্যা। সপ্তাহের চারদিনই বাড়িতে নানা সমস্যার অজুহাত দেখায় তারা। আর বাচ্চা থাকলে তো কথাই নেই। আবার মেয়েদের না নিলেও ঝামেলা, সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। কথাটা শুনে সহকর্মীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ, বোঝার চেষ্টা করলাম।

ভাবলাম, যে অন্যায়ের দাবিতে সবসময় সোচ্চার থাকি, কত অনায়াসেই তা বলে যাচ্ছেন উনি। আমাদের সমস্যাগুলোকে ‘সমস্যা’ হিসেবে না দেখে ‘সম্ভাবনা’ হিসেবে দেখলেই তো এর সমাধানের পথও সহজ হয়।

প্রতিবাদের সুরে বললাম, ‘তা হবে কেন? মেয়েরা যে কারণগুলো দেখাচ্ছে, সেগুলো খুবই বাস্তবিক। ঘরে বাচ্চা থাকলে মেয়েটাকেই মুখোমুখি হতে হয় সমস্যার, অথচ এক্ষেত্রে পুরুষদের এসব পোহাতে হয় না। সে নিশ্চিন্তে অফিসে যায়, কাজ করে। আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থা মেয়েদের কাজের অনুকূলে না। প্রথমত সন্তান রাখার জন্য বিশ্বস্ত কোনো সিস্টেম এখনও গড়ে উঠেনি। তার ওপর একা হাতে ঘর-বাহির সামাল দিতে হয় বলে সহকারির প্রয়োজন হয়ই। সেটাও তো এখন টানাটানির পর্যায়ে। তাহলে মেয়েরা করবেটা কি?’ সহকর্মীর সাফ জবাব, তাহলে কাজ করবে না মেয়েরা। কাজ করতে এসে এতো বাহানা কিসের? আমাদের কি সমস্যা নেই? বাড়িতে আজ এই সমস্যা, কাল ওই সমস্যা, সেগুলোর সমাধান কি আমরা করছি না?

করছেন’, আমি বলে চলি।

‘কিন্তু এটা নিত্যদিনের সমস্যা তো নয়। আর আপনি যেসব সমস্যার কথা বললেন, তার সাথে একজন মা সাংবাদিকের সমস্যার তুলনা হয় না কোনভাবেই। ঘুম থেকে উঠেই তাকে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, এটা তা না। তবে সংসারের পুরুষ পার্টনারটি যদি এক্ষেত্রে সহনশীল হয়, সহানুভূতিশীল হয়, ঘরের কাজে সহায়ক হয়, বাচ্চা লালন-পালনে সহায়ক হয়, তাহলে সমস্যার শতকরা ৮০ ভাগ মিটে যায়। কিন্তু বাকি ২০ ভাগ পোহাতে হয় ওই মেয়েটিকেই’।

সহকর্মীর কথার মাঝখানে আরেক নারী সহকর্মী, যার একমাত্র ছেলেকে বড় করেছেন তারই বড়বোন, সেই তিনি ফোড়ন কাটেন, ‘অতসব ঘরের ঝামেলা অফিসে আনার কী দরকার? কাজ করতে হলে কাজই করবে, সমস্যার কথা বলবে কেন? কাজ ছেড়ে দিলেই হয়!’

আমি অবাক হয়ে তাদের কথা শুনি। কথা আর বাড়াই না। কারণ আমি জানি, এই পুরুষতান্ত্রিক স্টেরিওটাইপ ভাঙা আমার কাজ না, আমি পারবোও না। এতো আলোচনা-সমালোচনা, সেমিনার-টেমিনার দিয়েও এর ঊর্ধ্বে উঠানো যাচ্ছে না মানসিকতাকে, সেখানে আমি দুই পয়সার ছাপোষা মানুষ, তর্ক করে কতটুকুই বা অর্জন করতে পারবো! (চলবে)

শেয়ার করুন: