কফি উইথ তানিয়া

Tania
তানিয়া

তানিয়া কামরুন নাহার একজন বিজ্ঞান শিক্ষক ও লেখক। শিক্ষকতাকে উদযাপন করেন তানিয়া। আর তার লেখালেখিতে সমাজ রাজনৈতিক স্পষ্ট ভাবনার আলোড়ন। সারাক্ষণ হাসিমুখ বন্ধুভাবাপন্ন তানিয়ার মতো আলোর মানুষেরা ফাঁপা সমাজের জুরাসিক পার্কে বসেও নৈরাশ্যে হাল ছেড়ে দেননা। ক্রমাগত চেষ্টা করেন চিন্তার অচলায়তন ভেঙ্গে এক প্রাণবন্ত জীবন উৎসবের একজন হতে। তানিয়া মানুষ হিসেবে অক্সিজেন ঘরানার। তাই আজকের আড্ডা জম্পেশ হবে এটা চোখ বুঁজে বলা যায়। চলুন আড্ডা দিই আজকের অতিথি তানিয়ার সঙ্গে।

আকাশ বিডিবয়: ব্রাজিল ফুটবলপ্রেমী কামরুন নাহার তানিয়া আপা, কেমন আছেন?

তানিয়া: ধন্যবাদ। আমি সব সময়ই ভাল থাকি। এখানে সবার সাথে অংশ নিতে পেরে নিজেকে সম্মানিত ও সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি একজন ব্যক্তি যে কিনা, চা কফি, কোক, পান, সিগারেট, বিড়ি, গাঁজা, ইয়াবা, সিসা কিছুই পান করে না। দেখা যাক, কফি ইউথ মি কেমন হয়!

আকাশ: আপা, ব্রাজিলের জালে রেকর্ড সংখ্যক সাতটা গোল দেখার পর আমি এখনও স্বাভাবিক হতে পারিনি? আপনি কীভাবে এতো তাড়াতাড়ি সামলে নিলেন?

তানিয়া: ইয়ে মানে বিডি ভাইয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি যেই খেলায় হারুক জিতুক, আমাদের কি? আমাদের ভাগ্য কি আর ওদের হারজিতে বদলাবে? যতখানি আনন্দ করার করেছি। ব্যাস, ঐটুকুই অর্জন। কষ্ট,হতাশা…নাহ, আমি খেলাপাগল নই, এসব নিয়ে আমার তেমন দুশ্চিন্তা, কষ্ট হয় না। এসব ব্যাপারে আমার অনুভূতি অনেক আগেই পোষ মানিয়ে ফেলেছি। তাই খুব একটা সমস্যা হয়নি আমার। কিন্তু তবুও ব্রাজিল জিতলে ভাল লাগত।

মাসকাওয়াত আহসান: আমাদের স্কুল কলেজে বিজ্ঞান এতো কঠিন করে পড়ানো হয় কেন? বিজ্ঞান শিক্ষার কৌশল শিখতে পারছিনা আমরা তাইতো!

তানিয়া: মাসকাওয়াথ ভাইয়া, জবাব তো আপনিই দিয়ে দিলেন! তবে এখন অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা নিজে নিজেই যেন শিখতে পারে ক্লাসে তেমন পরিবেশ তৈরির কথা এখন বলা হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। ক্লাসে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী, ক্লাসের বেঞ্চ অ্যারেঞ্জমেন্ট, উপকরণের অভাব, হাতে কলমে কাজ করার সুযোগ না থাকা ইত্যাদি নানা কারণে বিজ্ঞান বিষয়টি চাইলেও প্রাণবন্তভাবে, নিজের মত করে ক্লাসে উপস্থাপনের সুযোগ থাকে না। আবার যারা কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত তারাও শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে এমন একটি মাইন্ড সেট করতে সক্ষম হয়েছেন যে, ক্লাসে পড়ালেখা হয় না।এতো এতো কোচিং করিয়ে একজন ক্লান্ত শিক্ষক ক্লাসে আর ঠিকভাবে মনোযোগ দিতে পারেন না বা চান না। শহরের শিক্ষার্থীদের তুলনায় গ্রামের অবস্থা আরো শোচনীয়।

রূপম: শিক্ষকতাতে নিরপেক্ষতা অনিবার্য। তাই না? আপা, আপনার ছাত্র-ছাত্রীর উপরে ইন্টারনেটের প্রভাব সম্পর্কীয় কিছু বলবেন কি?

তানিয়া: রূপম, নেটের প্রভাব শিক্ষার্থীদের উপর দুভাবে কাজ করতে পারে। শিক্ষার কাজে ব্যবহার করলে তো ভালই। কিন্তু অল্পবয়সীদের মধ্যে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যাবার আশংকা থাকতে পারে। আর আমাদের দেশের সাইবার ক্যাফেগুলোতে নিয়ম-কানুনের কোন বালাই নেই। সাইবার ক্যাফের কথা বাদ দেই। মোবাইলই তো ব্যবহার করছে সিক্স সেভেনের বাচ্চারা। তথ্য প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে ঠিক মত প্রস্তুত হবার আগেই আমাদের হাতে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি চলে এসেছে। আর শিক্ষার চেয়ে কুশিক্ষা ও অসচেতনতা বেশি থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ইন্টারনেটের খারাপ প্রভাবটাই বেশি কাজ করছে। বড়দের দেখে ছোটরাও শিখছে।  কিন্তু আমি আশাবাদী। কারণ তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়তি সিক্স থেকে ক্লাস এইট পর্যন্ত বাধ্যতামূলক। এখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের নৈতিকতার বিষয়গুলোও খুব সুন্দরভাবে ও বয়স উপযোগী করে বর্ণণা করা হয়েছে। এছাড়া প্রযুক্তি ও নেটের বিভিন্ন ধরনের ব্যবহারের দিকগুলো সম্পর্কেও বাচ্চারা জানতে পারছে ও সচেতন হতে পারছে।

তারেক আহমেদ: তানিয়া, “কি করে খাবি! কি করে চলবি” এটাকে কি আপনি মনে করেন উপমহাদেশের ওপেন সিক্রেট হিডেন এজেন্ডা প্রায় ৯৮ ভাগ পরিবার প্রধানদের যারা তাদের সন্তারদের স্কুলে পাঠায় এই এজেন্ডা মাথায় রেখে? ইঁদুর দৌড়ের শুরু কি এখান থেকেই নয়?

তানিয়া: তারেক আহমেদ, অবশ্যই। শুধু এ প্লাস পেলেই হল। নকল করে নাকি পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পেয়ে এ প্লাস পেল বড় কথা নয়। এ প্লাসটাই বড় কথা। আর আমি অভিভাবকদের দেখি মাত্র আধা নম্বরের জন্য তারা কত তদবির করতে পারে! অথচ সন্তান আদৌ কিছু শিখল কি না, জানলো কিনা সেদিকে কোন নজর নেই। খুবই হতাশাজনক।

মাসকাওয়াথ: তানিয়া গোটা দুনিয়ার মানুষের মধ্যে এই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কেন সব কিছুতেই চুলকানি বা ঈর্ষা ও অভদ্রতা-খিস্তির প্রবণতা! কোন বৈজ্ঞানিক কারণ কী আছে!

তানিয়া: আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে এই অসভ্যতাগুলো শুধু দক্ষিণ এশিয়দের মধ্যেই বেশি দেখা যায় কি না! আমার তো ধারণা সারা পৃথিবীতেই অভব্যতা, অসভ্যতা রয়েছে। এটা থাকবেই। ১০০% মানুষ কখনোই সভ্য হয়ে যাবে না। সবাই যদি সভ্য হয়ে যায় তবে তো সবাই মহামানব হয়ে যাবে।

“Some are born great, some achieve greatness, and some have greatness thrust upon them.”
তবে হ্যাঁ, আমি আমার দেশের মানুষ সম্পর্কে আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণের কথা বলতে পারি। একে তো আমার শিক্ষা আর সচেতনতার অভাব, এর কথা বারবার আর নাই বা বললাম। তারওপর দারিদ্র, মানসিক চাপ, চারপাশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি…কে কাকে বিশ্বাস করবে? এত কিছুর মধ্যে কি আর সহিষ্ণুতা বজায় রাখা যায়? এক ট্রাফিক জ্যামের কারণেই কত মারামারি লেগে যায় রাস্তায়! মাসকাওয়াথ ভাই।

রূপম: তানিয়া আপা, এদের ইন্টারনেট না দিলে তারা অন্যদের থেকে পিছিয়ে পড়ছে – দিলে শংকা হচ্ছে, কি জানি কি হয়।

তানিয়া: রূপম, অল্পবয়সীদের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিতে হবে। তবে অবশ্যই নিয়ন্ত্রিতভাবে। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা ব্যবহার করা যেতে পারে। আর অবশ্যই সবার সামনে তাকে ব্যবহার করতে হবে। সেজন্য পিসি বা ল্যাপটপ ঘরের উন্মুক্ত অবস্থায় সেট করতে হবে। মোবাইল ব্যবহার করতে দিলেও শর্ত সাপেক্ষে। আসলে ওদেরকে ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করে দিলে ওরা নিজেরাই ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে।

আকাশ: কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো, ফরমালিন দিয়ে খাদ্যদ্রব্যের পচনরোধ – বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগ এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। আর বিজ্ঞানের এমন হাতে কলমে প্রয়োগ বন্ধ করতে সরকার বাহাদুর মাঝে মাঝে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে জনস্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে। আরে আল্লার মাল আল্লা নিয়ে যাবে এতে ফরমালিন কার্বাইড কি দুষ করলো!! হাতে কলমে মাঠে ময়দানে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন কখনো একজন বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে? না করে থাকলে এর পিছনে কি উদ্দেশ্য-বিধেয়?

তানিয়া: আকাশ ভাইয়া, কি অদ্ভুত কথা! বিজ্ঞানের কাজ হাতে কলমে করতে আমি কেন বাধা দেব?  বরং আমি নানাভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি। সে অভিজ্ঞতা রয়েছে।

ফাতেমা জোহরা হক কাকলী: তানিয়া আপা, আমি ইংরেজির শিক্ষক। আমার ভীষণ ভালো লাগছে শিক্ষা পরিবারের একজন সহযাত্রীকে আজকের আড্ডায় পেয়ে। আপনাকে সু স্বাগতম। আমার প্রশ্ন, শিক্ষকতা পেশায় কেন এলেন? আদর্শ শিক্ষক হতে হলে কি কি গুণাবলী থাকতে হয় বলে আপনি মনে করেন? নিজেকে কি একজন আদর্শ শিক্ষক বলে মনে করেন?

তানিয়া: কাকলী আপা, ধন্যবাদ আপনার সুন্দর প্রশ্নটির জন্য। আমি শিক্ষকতা পেশায় এসেছিলাম কারণ আমি ফাঁকিবাজ।  কারণ, এই পেশায় রমজানের ছুটি, সামার, উইন্টার, ইত্যাদি নানা ভ্যাকেশনের ছড়াছড়ি। আবার আমি আমার নিজের পরিবারকে সময় দিতে চাই, তাই আধাবেলা চাকরি করে আবার বাসায় এসে নিজেকে ও পরিবারকে সময় দিতে পারবো। এইসব ভেবেই এসেছিলাম।এছাড়াও শিক্ষকতা আমার ভাল লাগে। অবশ্য আগামী ৫ বছর পর আমি নিজেকে স্রেফ একজন শিক্ষক হিসেবে দেখতে চাই না। আদর্শ শিক্ষকের তো গুণাবলীর শেষ নেই। প্রথমে দরকার তার বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। তারপর ক্লাস নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা, ক্লাসের বিষয়বস্তু প্রাণবন্তভাবে বুঝিয়ে দেবার দক্ষতা, সততা, সুক্ষ্ম রসবোধ, ভাষায় আঞ্চলিকতা থাকবে না, স্মার্ট হতে হবে, সময়জ্ঞান থাকতে হবে, শিক্ষার্থীদের সাথে সহজ সম্পর্ক তৈরি করতে জানতে হবে, কলিগদের সাথে ভাল সম্পর্ক থাকতে হবে, সব সময় আপডেটেড থাকতে হবে, কুসংস্কারমুক্ত হতে হবে, রেগুলার লেসন প্ল্যান করতে হবে, student psychology বুঝতে হবে … ইত্যাদি

আমি আদর্শ শিক্ষক কিনা? আরে ভাই, শিক্ষক হয়ে কেউ জন্মায় না, ধীরে ধীরে একজন মানুষ শিক্ষক হয়ে উঠে। আমি এখনো শিক্ষকতা শিখছি। তবে স্কুল ক্যাম্পাসের বাইরে আমি শিক্ষকসুলভ হাবভাব নিয়ে চলি না। আমাকে প্রথাবিরোধীই বলা যেতে পারে এক্ষেত্রে। প্রথমে শিক্ষকদের সাদা পাঞ্জাবী, হাতে ছাতা, পায়ে ছেঁড়া স্যান্ডেল মার্কা টিচার ইমেজ ভেংগে দেবার চেষ্টা করছি।

তানিয়া: তারেক ভাই, এখন তো আমরা টিচাররা ভুল হলেও নাম্বার কাটতে ভয় পাই। কারণপরে আবার উর্ধতন কর্তৃপক্ষ আদেশ দেবেন সব খাতা চেক করে নম্বর বাড়িয়ে দিতে। তারচেয়ে একবারে বেশি নম্বর দিয়ে দিলে ঝামেলা মিটে গেল। দুঃখজনক হলেও আমার নিজের ক্ষেত্রে এমন বেশ অনেকবার হয়েছে। এমনকি আমি খাতা দেবার আগে কর্তৃপক্ষকে আগেই জানিয়ে দিয়েছি, এবার যেন ভুল উত্তরে আমাকে নাম্বার দিতে ফোর্স করা না হয়! তবুও… এসব কারণে শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করতে শেখে।

কাকলী: আমাদের ত্রি-নীতি শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যদি একটু আলোকপাত করতেন তানিয়া আপা… আপনি কি মনে করেন আমাদের শিক্ষার্থীরা যুগের সাথে তাল মেলাতে খানিকটা হোঁচট খাচ্ছে? উত্তরনের উপায়?

তানিয়া: কাকলী আপা, ত্রিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা, মানে মাদ্রাসা, ইংলিশ মিডিয়াম আর বাংলা মিডিয়ামের কথা বলছেন তো? এগুলোর আসলে একটা সম্বনবয় দরকার। আমার ব্যক্তিগত মতামত। তিনটা তিন রকম ব্যবস্থা একই দেশে কেন চলবে? শিক্ষার্থীরা যুগের সাথে তাল মেলাতে মোটেও হোঁচট খাচ্ছে না। হোঁচট খাচ্ছে প্রাচীনপন্থী  আধমরা শিক্ষকেরা এই সবুজ অবুজ কাঁচাদের কাছ থেকে ঘা খেয়ে।

তীর্থের কাক: তানিয়া,আপনার সময় কাটে কি নিয়া?

তানিয়া: তীর্থের কাক, ফেসবুকিং, ব্লগিং, লেখালেখির অপচেষ্টা, বইপড়া, টিভি দেখে। আর আমার ৬ বছরের ভাতিজির সাথে খেলাধুলা করে। আমার সব ব্যাপারে সেই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে থাকে।

কাকলী: তানিয়া আপা, আপনার ক্লাশের বিভিন্ন মেধার শিক্ষার্থীদের আপনি কোন বিশেষ পাঠ দান দ্বারা শিক্ষা প্রদান করেন? আপনি কি মনে করেন আপনি ক্লাশের সকল শিক্ষাথিদের কাছে সমান ভাবে পৌঁছুতে পারেন? উপায় গুলো যদি শেয়ার করতেন ভীষণ ভাবে উপকৃত হতাম…

তারেক: আলাদাভাবে “ধর্ম” বিষয়টিকে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত রাখা কতটা যৌক্তিক আর একজন ছাত্রের জন্য তা আলাদাভাবে কি ভ্যালু এড করছে? (যদি ইঁদুর দৌড়ে জেতাটাকেও গোণায় আনি)

তানিয়া: আমার এই লেখাটি পড়তে পারেন। https://womenchapter.com/views/3285

আকাশ: তানিয়া আপা, ভূত দেখেছেন কখনো? আমার খুব দুঃখ আমি কোনদিনও ভূত দেখিনি! আমাদের দেশে ভূতের ভবিষ্যত কি?

তানিয়া: বিডি ভাইয়া, আমি ভূতে বিশ্বাস করি না। তবে মাঝে মাঝে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয় পাই। আমার চোখে হাইপাওয়ারের চশমা ব্যবহার করতে হয়। অনেক সময় রাতে ঘুম ভেংগে খালি চোখে ঘরের ভেতরে তাকালে কি কি সব দেখতে পাই, তখন ভয় ভয় লাগে।

কাকলী: তানিয়া আপা, কোচিং ব্যবস্থা কে কি আপনি বাণিজ্য বলে মনে করেন? নিজে কি কখন জড়িত ছিলেন বা আছেন এর সাথে?

তীর্থের কাক: সব ভাল ছাত্র/ছাত্রীই ভাল শিক্ষক নয়, আমার বাবার কথা। আপনি কি তা বিশ্বাস করেন? যদি করেন তাহলে কেন? না করলে কেন? তাহলে ভাল শিক্ষক হওয়ার পূর্বশর্ত কি?

তানিয়া: তীর্থের কাক, সব ভাল ছাত্র/ছাত্রীই ভাল শিক্ষক নয়, আমার বাবার কথা। আপনি কি তা বিশ্বাস করেন? করি। কারণ, আপনি একটি টপিক ভাল জানলেই হবে না, তা শিক্ষার্থীদের কাছে বোঝার মত করে পরিবহনও করতে হবে। একজন শিক্ষক এখানে জ্ঞান ট্রান্সমিট করছেন।ভালো টিচার হবার কিছু গুণের কথা আগের মন্তব্যে বলেছি। তাই আবার বললাম না।

কাকলী: তানিয়া আপা, কোচিং ব্যবস্থাকে কি আপনি বাণিজ্য বলে মনে করেন? নিজে কি কখন জড়িত ছিলেন বা আছেন এর সাথে?

তানিয়া: আগে চলুন দেখি কোচিং কাদের দরকার। যারা অন্যদের তুলনায় দুর্বল তাদের বিশেষ যত্নের জন্য চাই কোচিং। কিন্তু আমাদের এখানে হচ্ছেটা কি? তেলা মাথায় তেল দেওয়া হচ্ছে। যে শিক্ষার্থী এমনিতেই সুপারব, তার জন্য আরো বেশি বেশি কোচিং। তার অভিভাবকই চাইছে তাকে ভাল থেকে ভালত্তম বানিয়ে ছাড়তে। এভাবে অভিভাবকরাও শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যে আসতে উদ্বুদ্ধ করেন।
এখন যে নতুন আইন বা নিয়ম হয়েছে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে, তাতে বাণিজ্য আরো বৃদ্ধি পাবার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আমি নিজে কোচিং বাণিজ্যের সাথে জড়িত ছিলাম না কখনো। স্টুডেন্ট অবস্থায় কয়েকটা টিউশনি করেছিলাম, হাতখরচ চালানোর জন্য।তাও সেসবে নিয়মিত জুটত না।আর এত খাটুনি দিতাম, অভিভাবকেরা মাস শেষে আমার হৃদয় ভেংগে দিত।

কাকলী: আজ চারপাশে সবাই যেভাবে সব বিষয়ে জ্ঞান বিলোয়, কিংবা কারণে-অকারণে মুখিয়ে থাকে অন্যের ত্রুটি ধরতে।। বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন তানিয়া আপা?নিজেকে কোন ধারায় ফেলবেন?

তানিয়া: যে কিছু পারে না, সে উপদেশ দেয়। এবার বাজেটে উপদেশ দেবার উপরে কি ট্যাক্স ধরা হয়েছে? হয় নি? কেন হয় নিআপনাকে ফ্রি একটা জ্ঞান দিচ্ছি। কখনো কাউকে বিনামূল্যে পরামর্শ, উপদেশ দিতে যাবেন না। এতে আপনার দাম থাকবে না। উপদেশ শুনতে কেউ ভালবাসে না। সুতরাং উপদেশ দিয়ে সবার কাছে কেন বিরক্তির কারণ হবেন? নিজের দোষ ঢাকার জন্যই লোকে অন্যের দোষ ধরে। তবুও কখনো কখনো অন্যের কিছু আচরণ যদি শুভাকাংখী হিসেবে পরিবর্তন করতেই চান, তবে বলবো, অন্যকে কেউ বদলাতে পারে না, যদি না সে নিজে বদলাতে চায়। তাই আগে তার ভাল গুণ, ভাল কাজের প্রশংসা করুন। তাহলে সে নিজের ভালোটাতে মনোযোগী হবে। একটা ফ্রি জ্ঞান দিতে গিয়ে এত্তগুলা পরামর্শ দিয়ে ফেললাম। আমার ফি‘টা পাঠিয়ে দেবেন।

কাকলী: ‘প্রতিটি মানুষের মাঝেই একজন লেখক সত্ত্বা বাস করে’ তানিয়া আপা, আপনি কি তাই বিশ্বাস করেন? আপনার লেখালেখি শুরুর গল্পটা যদি একটু বলতেন আমাদের।

তানিয়া: –সবার মাঝেই লেখক সত্তা কাজ করে কি না, আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তবে একটা দার্শনিক সত্ত্বা কাজ করে। আমি লিখতাম, ছোটবেলায়। হাবিজাবি। পরে একসময় কবিতা লেখা শুরু হয়ে গেল। অবশ্য সেগুলোকে আদৌ কবিতা বলা যায় কি না জানি না। ডায়রীর পাতাতেই ছিল সেসব। ফেসবুক, ব্লগিং-এর মাধ্যমেই আমি প্রথম নিজেকে প্রকাশ করার সুযোগ পাই। এসব আমার প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। গল্প লিখেছি মনে হয় দু একটা। ভিকারুননেসায় পরিমলের ঘটনাটার পর পর আমি মেয়েদের সচেতনতার উপরে দুটো লেখা লিখি। ব্লগে তখন বেশ সাড়া পেয়েছিলাম। এ ধরনের লেখা এর আগে আমি কখনো লিখি নি। ঐ সময়ে ফেসবুকের কল্যাণেই ঔপন্যাসিক মঈনুল আহসান সাবেরের সাথে যোগযোগ হয়। তিনি তাঁর পত্রিকা অফিসে আমাকে যেতে বলেন। যথা সময়ে আমি সেখানে যাবার পর তিনি পত্রিকার আরেকজন সম্পাদককে বললেন, ”এখন থেকে এই মেয়েটি লিখবে”। আমি অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করিনি। কারণ আমার মনে হচ্ছিল সাবের ভাই হয়ত আমার সাথে মজা করছেন। এটা তো ফেয়ার এন্ড লাভলীর বিজ্ঞাপন নয় ! ব্লগের বাইরে সেই প্রথম একদম পেশাদার লেখালেখি শুরু হল। সবচেয়ে বড় কথা আমি এ ধরনের লেখা আগে কখনো লিখি নি। প্রতি সপ্তাহের লেখা লিখতে গিয়ে আমাকে রীতিমত পড়ালেখা করতে হয়েছে, অনেক মানুষের ভেতরটা দেখে আসতে হয়েছে। লিখতে গিয়ে আমি শিখেছি বেশি। এসব কারণে সাবের ভাইয়ের কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ। বলতে গেলে তাঁর হাত ধরেই আমার লিখতে শেখা।  কিন্তু আমার আলসেমীর কারণে লেখালেখিতে অনেক ঢিলেমি দিয়েছি, দিচ্ছিও।

রূপম: আসলেই বেশী হয়ে যাচ্ছে, আপনার সংসার আর সন্তাদের নিয়ে যদি কিছু শুনান।

তানিয়া: রূপম, সংসার মানে মা-বাবা, ভাই ভাবি, ভাতিজি আর আমি। এটাকে অনেকেই আমার নিজের সংসার বলে মানবেন না হয়ত। সংসারে আমার কাজ খাওয়া আর ঘুমানো। এজন্য আমার নিজেরও একে নিজের সংসার বলে মনে হয় না। দায়িত্ব নিতে চাইলেও মাঝে মাঝে মনে হয়, থাক গে, আছিই তো আরামে।শখ করে ঝামেলা মাথায় নিলে পৃথিবীর ৭০০ কোটি জনতাকে নিয়ে কে ভাব্বে?

কাকলী: তানিয়া আপা, আপনার লেখনীতে নারী অবমাননার বিষয়গুলো কি এসেছে? কোন বিশেষ দুর্বলতার কারণে আজো ‘নারী নির্যাতন’ শব্দ টিকে আমরা জাদুঘরে পাঠাতে ব্যর্থ বলে আপনি মনে করেন?

তানিয়া: হ্যাঁ, আসে। এজন্য আমাকে অনেকে নারীবাদী ভেবে বসে। আমি যেকোন মানুষের বঞ্চনা, অধিকার নিয়েই কথা বলতে চাই। যেহেতু নারীদের ক্ষেত্রে বঞ্চনা তুলনামূলকভাবে বেশি, তাই তাদেরটা বেশি বলা হয়ে থাকে।

কাকলী: আপনার ভাবনার আকাশে কি বেশী খেলা করে, কবিতা, গল্প, নাকি বিজ্ঞানের সূত্র?

তানিয়া: মানুষ…অবশ্যই বৈজ্ঞানিকভাবেই ভাবতে ভালবাসি।

কাকলী: অনেক সাহিত্য সমালোচক বলেছেন, ব্যক্তিগত তীব্র দুঃখবোধ না থাকলে মহৎ কবিতা লেখা যায় না। তাঁদের ব্যক্তিগত পরাজয় কবিতার ফুল ফোটায়। আপনি কীভাবে দেখেন বিষয়টিকে তানিয়া আপা?

তানিয়া: জগতের সকল মহৎ কিছুই হয়ে থাকে গভীর বেদনা থেকে। শুধু কবিতা নয়, সকল মহৎ কর্মের পেছনেই আপনি বেদনা খুঁজে পাবেন। গৌতম বুদ্ধের বাণী- যে ৫০ জনকে ভালবসেছে, সে আসলে ৫০ রকম বেদনাকে নিজের সাথে যুক্ত করেছে। যে কাউকে ভালবাসেনি, তার কোন দুঃখ নেই। কবি, লেখকদের ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনা থেকে সাহিত্য হতে পারে। তবে যখন ব্যক্তিগত অনুভূতির ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষের বেদনার জায়গা থেকে সাহিত্য রচিত হয়, তখন সেটা সার্বজনীন হয়ে উঠে।

কাকলী: কবিতায় শব্দচয়নে নতুন ধরনের শব্দ ব্যবহারকে কি আপনি বাংলা কবিতার ক্লাসিক রূপকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে ভাবেন তানিয়া আপা?

তানিয়া: নতুন ধরনের শব্দ বলতে কী বলতে চাইছেন? স্ল্যাং? নাকি আইসি, গেসি, করসি টাইপ শব্দ? স্ল্যাং এর ব্যবহার তো অনেক পুরোনো…ভাত দে হারামজাদা…স্ল্যাং এর মধ্যে এক ধরনের শক্তি আছে। ঠিকমত ব্যবহার করতে পারলে স্ল্যাং ব্যবহার করাকে খারাপ চোখে দেখি না। তবে আরোপিত শব্দ, জোর করে বসানো শব্দ (বা স্ল্যাং) যা কবিতাকে অহেতুক দুর্বোধ্য করে তোলে, এর বিপক্ষে আমি।

মাসকাওয়াথ: অনেক কৃতজ্ঞতা আজকের অতিথি শিক্ষক ও লেখক তানিয়ার প্রতি। আপনার আলোক সম্ভবা লেখক জীবন অর্থবহ হয়ে উঠুক; ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে সুচিহ্নিত হোন এ প্রত্যাশা আমাদের। আড্ডা জারী থাকুক। আনন্দম।

কাকলী: অনুভুতির তীব্রতার সময় – মন ভালো কিংবা খারাপ; কি করেন তখন তানিয়া আপা? সবুজে, প্রকৃতির কাছে আশ্রয়; নাকি নিজের সাথে কথোপকথন?

তানিয়া: মন ভাল থাকলে তো কথাই নেই।মন খারাপ হলে ইচ্ছে করে সব ছেড়েছুঁড়ে গহীন বলে চলে যাই।কিন্তু সবুজ আর প্রকৃতির কাছে চাইলেই যাওয়া যায় না। তখন ফেবুতে বসি।ফেবুতে বসলে কিছুক্ষণের মধ্যে মন রিলাক্স হয়ে যায়।এ ছাড়াও হাসির মুভি দেখলে কাজ হয়। মেডিটেশন করার চেষ্টা করি। কল্পনায় প্রকৃতির কাছে যাই।

হাসান অপু: বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক কোনটি বলে আপনে মনে করেন?

তানিয়া: অপু, আবারও শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন! এই শেষ আর এ নিয়ে কথা নয়।শিক্ষা ব্যবস্থার সব দিকই তো দুর্বল বলে মনে হয়। কারিকুলাম থেকে শুরু করে ক্লাসে পাঠদান, শিক্ষকদের সুবিধাবঞ্চিত করে রাখা, প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন, শুধু পরীক্ষায় নম্বরপ্রাপ্তিটাকেই বড় করে দেখার মানসিকতা…সবখানে দুর্বলতা।

কাকলী: আপনার সাথে আজকের আড্ডাটি আমার জন্যে যেমন শিক্ষণীয় তেমনই স্মরণীয় হয়ে থাকবে তানিয়া আপা!!  আপনার মতো শিক্ষক সমাজের অলংকার, দেশের অহংকার। আপনি শিক্ষার আলোক মশাল নিয়ে বহুদূর পথ এগিয়ে যান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে সাথে নিয়ে।। আপনার সান্নিধ্য আমাকে ঋদ্ধ করেছে, আপনার প্রাণবন্ত উপস্থিতি আমাকে আলোড়িত করেছে। আপনার যাপিত জীবন মঙ্গলময় হোক, আনন্দদায়ক হোক। নিরন্তর শুভেচ্ছা আপনার জন্যে।।

আকাশ: এবার প্রশ্ন ফরচুনটেলার বিশিষ্ট জইতিসি তানিয়া আপার কাছে- আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে জ্যোতিষি শাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না কেন? যেখানে দেশের পলিসিমেকার, শিক্ষাবিদ থেকে কন্যাদায়গ্রস্ত বাবা-মাসহ প্রায় সবাই কখনও না কখনও জ্যোতিষির পাথরে সব মুশকিলে আসান ভাবেন।

তানিয়া: বিডি ভাইয়া, আমরা প্রতিনিয়তই কিন্তু ভবিষ্যত নিয়ে ভাবি, ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিয়ে থাকি।নিজের বেলায়, অন্যের বেলাতেও। আমরা সবাই ভবিষ্যত বলতে পারি। (আমি অবশ্য একটু বেশি –অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যত সব বলতে পারি) যে বিদ্যা সবাই জানে, সেটা আর কারিকুলামে যুক্ত করার দরকার কী?

আকাশ: ধন্যবাদ জইতিসি তানিয়া আপুকে। কেউ যদি নিজের অতীত,বর্তমান, ভবিষ্যত জানতে চান, যোগাযোগ করুন এখনই। ১০০% গ্যারান্টি, বিফলে মূল্য ফেরৎ!!!

তানিয়া: কিন্তু আপনাদের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সকল প্রকাশ্য ও গোপন অপকর্মের কথা যে আমি জেনে যাবো। সেটা কি আপনাদের জন্য ভাল হবে?

মাসকাওয়াথ: অসুবিধা কী উনাকেও দেশপ্রেমিক খেতাব দেয়া যাবে!

তানিয়া: ধন্যবাদ, এতোক্ষণ সাথে থেকে সঙ্গ দেবার জন্য। প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে গিয়ে নিজেকে আবারও নতুন করে চিনতে সাহায্য করেছেন আপনারা।তাই এর কৃতিত্ব আপনাদেরই।

 

 

শেয়ার করুন: