সোভিয়েত নারীর দেশে-১৩

Leningrad 1সুপ্রীতি ধর: শুরু হলো নতুন জীবন। অচেনা শহর, অচেনা মানুষ। রাতের ঘুম পার করে দিল পুরো সকালটা। কি করবো বুঝতে পারছি না। রুমমেটদের অপেক্ষায় আছি। কে আসবে, কখন আসবে। যেই আসুক, কথা তো বলা যাবে অন্তত। শুনেছি এই হোস্টেলেই পাঁচজন ভারতীয় আছে। এর মাঝে তিনটি মেয়ে একসাথেই থাকে। কিন্তু কোথায় তারা?

সকালে তৈরি হয়ে নিচের ক্যান্টিনে গিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। আরমেনিয়ান খাবারের চেয়ে রুশ খাবার অন্যরকম। এরা সালাদ খায় বেশি। আর সব সেদ্ধ করা। বিট আর ডিমের সালাদটা ভাল লাগলো খেতে। স্যুপ খেলাম, তাও বিটের। এক ধরনের কালো ব্রেড পাওয়া যায়, আরমেনিয়াতেও ছিল। বাটার দিয়ে খেতে বেশ মজা। পটেটো পাস্তা আর এক পিস মাংস। মোটামুটি ফুল আমি তখন। নিচে থেকে লিফটে উঠতে গিয়ে দেখা ওদের সাথে।

খল খল করে কথা বলছিল নিজেদের মাঝে। বেশ সুন্দর দেখতে। আমাকে দেখে একজন বাংলাতেই জিজ্ঞাসা করলো, ‘তুমি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছো’? বুঝলাম, এরাই সেই তিনবাহিনীর একজন। নাম স্বপ্না। অরিজিন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, বর্তমানে এলাহাবাদের বাসিন্দা। আসলে অরিজিন অর্থে ওই ঠাকুরমা পর্যন্তই। তারপর আর কোন যোগাযোগই নেই এই বাংলা কেন, ওই বাংলার সাথেও। বাংলা-হিন্দী মিশিয়ে কথা বলে। বাংলারও সে কী করুণ হাল! আশ্চর্য হয়ে দেখলাম রুচি আর অর্চনা নামের অন্য দুজনও বেশ হাসিখুশি, আর আমার সাথে বাংলাতেই কথা বলার চেষ্টা করছে। তাদের মিশ্রিত বাংলায়।

পলকেই আপন হয়ে গেলাম আমরা। সেইদিন থেকে পরের চারটা বছর বলতে গেলে আমরা একইসাথে গায়ের সাথে লেপ্টে ছিলাম একে-অপরের। আমি একা বলে ওরা আমাকে প্রায় কোলে তুলে রাখলো। সেই রুচির সাথে আমার আবার দেখা ২০ বছর পর ২০১১ সালে দিল্লিতে, একটা অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়ে। আমার মেয়েটার জন্মও হয়েছিল এই বন্ধুদেরই হাতে, সেই মেয়েটি ২২ বছর পর দিল্লি গিয়ে দেখা করে এসেছে তার রুচি মাসীর সাথে। আসলে এই আত্মীয়তার কোনো তুলনা নেই, এই ভাল লাগার কোনো শেষ নেই, কেবলই নিরন্তর বয়ে চলা।

বিকেল নাগাদ বাদল নামের একজন এলো আমার হোস্টেলে। চেনা নাই, জানা নাই, এসেই ‘তুমি’ বলে ডাকা শুরু করলো। জানলাম, সেও আমার ক্লাসমেট, অন্যশহর থেকে এসেছে। আমার রুম দেখলো, কিচেন দেখলো, বললো, চলো। ওর কথায় পুরাই হতভম্ব আমি বেরিয়ে গেলাম হোস্টেল থেকে। কাছেই একটা মার্কেটে গিয়ে কিছু হাঁড়ি-পাতিল কিনলাম, একটা মুরগি নিলাম। সাথে পেঁয়াজ, রসুন, আলুসহ নানান খাবার। রুটি-বাটার-জেলি নিতেও ভুল হলো না। একগাদা বাজার করে রুমে ফিরে মুরগিটা কেটে দিল বাদল। তারপর চলেও গেল, খেলো না। আমি আরও আশ্চর্য হলাম। আরো মজার বিষয় হলো, বাজারের টাকাও নিল না।

পরে স্বপ্নাদের কাছে শুনেছিলাম, সে নাকি ওদের রুমে গিয়ে বলে এসেছে, আমাদের দেশের একটি মেয়ে এসেছে তোমাদের ইউনিভার্সিটিতে, ওকে তোমরা দেখো, সাথে রেখো। আমার ভাল লাগলো পুরো বিষয়টা। সেই থেকে জানলাম, বাদলটা আসলে ওরকমই।

সমস্যা হলো, রুমে তখনও কোন ফ্রিজ না থাকায় যা রান্না করা হতো, সবটাই খেয়ে ফেলতে হতো। আমি একা মানুষ, বিপদে পড়ি মুরগি নিয়ে। এটা কি সম্ভব খাওয়া? অবশ্য রুচি-স্বপ্নারা আমাকে অচিরেই উদ্ধার করলো এই সমস্যা থেকে। বলতে গেলে, রান্না আমাকে কমই করতে হয়েছে বহুদিন পর্যন্ত। হয় ১৪০১ নম্বর রুম (যেখানে তিনকন্যার আবাস), নয়তো মেডিকেলের ৪৩০ নম্বর রুম। আযান দিয়ে যতদিন চলা যায় আর কী!

এদিকে কয়েকদিনের মধ্যেই আমার দুই রুমমেট হাজির। পাশের রুমেও একটি পরিবার-ছোট্ট একটি পরীসহ উপস্থিত। জীবন আমার কানায় কানায় পূর্ণ। রুমমেটদের একজন তানিয়া, সে মিক্সড। বাবা সিরিয়ার, মা রুশ। অসম্ভব দক্ষতা সাহিত্যে-ভাষায়। রুশ-আরবী-ইংরেজি বলে অনর্গল। চোখে ভারী চশমা। রক-জ্যাজ, শাস্ত্রীয় সব সঙ্গীতের প্রতিই তার অনুরাগ চরম মানের। আরেকজন জেনিয়া। পুরোপুরি রুশ, গ্রাম থেকে আসা। ছবি আঁকার হাত তার অসাধারণ। ভাস্কর্যও বানায়। তার বিছানার আশপাশে রং-পেন্সিল-তুলি আর কাদামাটির ছড়াছড়ি। গুছিয়ে রেখেও লাভ হয় না। যেখান দিয়ে হেঁটে যায়, সেখানেও আনমনা হয়ে কিছু না কিছু ছাপ রেখে যায়। সেখানে আমি হলাম গিয়ে মোটামুটি রকমের শুচিবাই টাইপের। তানিয়ার সাথে প্রচণ্ড মিল হয়ে গেলেও জেনিয়ার সাথে অল্প-বিস্তর দূরত্ব রয়ে গেল।

তানিয়ার সাথে শুরু হলো আমার যুগপৎ পথচলা। সেপ্টেম্বরে ক্লাস শুরুর পর দেখা গেল আমরা একই ক্লাসে যাই, একই রুটিন আমাদের। বয়সে ও আমার এক বছরের ছোট। ও আমায় ডাকে বাঙালী কায়দায় ‘দিদিউশা’ বলে, শুনতে ভারী মজার লাগে। একসাথে রাঁধি, একসাথে খাই, ক্লাস করি, গান শুনতে যাই, জাদুঘরে যাই, রীতিমতোন অ্যাডভেঞ্চারে নামি আমরা দুজন। ওর নানী মস্কোর কাছের একটি শহর থেকে প্রায়ই ‘খাবারের পার্সেল’ পাঠান আমাদের দুজনের জন্য। ওর সাথে থেকে থেকে আমি প্রথম বছরেই রুশ সাহিত্য পড়া শুরু করি। চলমান অভিধান তো আছেই, অসুবিধা কী! যেখানটায় আটকে যাই, ও আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দেয়। বাঙালীদের হোস্টেলেও আমি তানিয়াকে সাথে নিয়েই যাই।

এর মাঝেই বাঙালী পাড়ায় জানাজানি হয় আমার কথা। পরিচয় হয় পার্থদা, কেশবদা, মোশাররফ ভাই, মাকসুদ ভাইয়ের সাথে। আজ এতো বছর পর স্মৃতিতে আমার ‘পরিচয় পর্বের ধাপ’টা মনে করতে পারছি না। তবে এটা জানি, আমরা একই ইয়ারের ছিলাম মোট নয়জন। তার মাঝে মেয়ে আমরা দুজন, বেলী আর আমি। আগে থেকেই ছিলেন মেডিকেলের শিউলী আপা, কবিতা আপা আর ইঞ্জিনীয়ারিং ইনস্টিটিউটের সুবর্ণা আপা। আমি ছাড়া সবাই দলবদ্ধ জীবনযাপন করে। আমিও করি, তানিয়া আর রুচি-রত্নাদের সাথে। ক্লাস শেষে মাঝে মাঝেই চলে যাই মৃণালদা-শিউলী আপাদের হোস্টেলে। তানিয়ার বড় ভাইও ছিল ওই হোস্টেলে। ফলে আমাদের যাওয়া-আসায় কোনো অসুবিধাই আর ছিল না। রাত একটায় শেষ মেট্রো ধরে রুমে ফিরি। প্রায়ই মেট্রো স্টেশন থেকে পুলিশ গাড়িতে করে হোস্টেলে পৌঁছে দেয়।

রাতের লেনিনগ্রাদ অন্যরকম। কেউ একজন বলেছিল (এখন নাম মনে নেই), রাতে চলাচলের সময় কপালে ‘টিপ বা বিন্দী’ পড়ে নিও, অসুবিধা হবে না’। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বলেছিল, আমরা অনেকটা কিউবানদের মতোন। তাই ওরা মনে করে, আমরা হয়তো ‘অনেক ফ্রি’। তাই এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে উপায়টা অবলম্বন করে আমিও দেখলাম, যে, পদ্ধতিটা আসলেই কার্যকরি। তাই বড় করে টিপ লাগিয়ে প্রায় প্রতি রাতে ঘরে ফিরি। মাঝে-মধ্যে মধ্যরাতের ট্রলিবাস আর মেট্রোতে মাতাল লোকজনের দেখা মেলে। তারা গায়ে পড়ে কথা বলেন। পাশে এসে বসতে চায়। জায়গা না পেয়ে মুখটা দেখে ভাল করে।

কপালের টিপ দেখে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী কেমন আছেন? স্যালুট তাকে’। তখন বুঝি, ভারতের প্রতি তাদের একটা অসম্ভব রকমের শ্রদ্ধাবোধ আছে, যে বোধ থেকে একটা মেয়েকে তারা মাতাল অবস্থাতেও সম্মান করতে ভুলে যায় না। একজন ‘অবহেলিত মেয়ে’ হিসেবে বড় হওয়া এই আমি এখন নতুন সমাজের নতুন সিস্টেমে পূর্ণাঙ্গ নারী হয়ে উঠতে থাকি, নতুন বোধ জন্ম নেয়, নিজের প্রতিও শ্রদ্ধা জাগে, এক ধরনের অহম কাজ করে।

এরই মাঝে একদিন প্রত্যক্ষ সম্পর্ক তৈরি হয় বিশ্বখ্যাত মিউজিয়াম হেরমিটেজের সাথে। সেই সম্পর্কের শুরুটাই কেবল মনে আছে, শেষ কবে হয়েছিল, আদৌ হয়েছিল কিনা তা এখন আর মনে করতে পারি না। শুধু মনে আছে, মিউজিয়ামটিতে গেলে এক অন্য অনুভূতি এসে ওলটপালট করে দিতো আমার আমিকে। ছবিগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আমি চিনে নিতে চেষ্টা করতাম একটা মহাকালকে, মহাকালের পাত্রপাত্রীদের, জীবনযাপনকে। বড় আশ্চর্য সেসময়! অনুভবে থাকে, ভাষায় আসে না।

আরমেনিয়াতে যা পাইনি, তাই পেতে শুরু করি রাশিয়াতে এসে। এখানে সমাজতন্ত্র তার পূর্ণ ডানা মেলে অপেক্ষায়। পেরেস্ত্রোইকা-গ্লাসনস্তের ছোঁয়া যদিও রাজনীতিতে, সামাজিক জীবনে এর প্রভাব নিতান্তই কম তখনও। ফলে সামাজিক এই সিস্টেমের রূপ-রস শুষে নিয়ে নিজে থেকেই সমৃদ্ধ হতে থাকি একের পর এক ঘটনা-পরম্পরায়। সেইসাথে আলাদা হতে থাকি আমার এতোদিনের সংস্কার, এতোদিনের যাপিত জীবন থেকে। (চলবে)

শেয়ার করুন: