শুচি সঞ্জীবিতা: গত কয়েকদিন ধরেই একটা নোটিশ অনেকের চোখে পড়ছিল। ‘রক্ত চাই, বি পজিটিভ রক্ত চাই’ এমন একটি আবেদন ঘুরছিল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে। কেউ সাড়া দিয়েছে, শেয়ার করেছে, কেউ প্রয়োজন মনে করেনি, এড়িয়ে গেছে।
একজন বৃদ্ধ লোক ঘুরছেন হাসপাতালে, হাসপাতালে। আজ এখানে তো, কাল ওখানে। সমস্যা বার্ধক্যজনিত হলেও সামাজিক সমস্যা আরও প্রকট। এই বয়সে তাঁর পাশে থাকার কেউ নেই। নিজের ছেলেমেয়েরা কেউ নেই, সবাই দূরদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। স্ত্রী চলে গেছেন আগেই। সেই থেকে ঢাকার একটি আবাসিক এলাকার একটি ফ্ল্যাট বাড়িতে তাঁর জীবনযাপন। সকাল-বিকাল একজন গৃহকর্মী এসে রান্না করে, গুছিয়ে দিয়ে যান। বাকি সময়টা তিনি একাই থাকেন। কি করে যেন একজনের নজরে আসে তাঁর খবর। সুস্থ থাকার সময় মেয়েটি গিয়ে প্রায়ই দেখে আসতো তাকে। গল্পগুজব করতো, এটা-সেটা রান্না করে নিয়ে যেত। কোন প্রতিদান পেতে নয়, স্রেফ মানবিকতার টানেই। মূলত সেই ওই গৃহকর্মীকে ঠিকঠাক করে দিয়ে এসেছিল। তার আগে উনার নিজেকেই সব কাজ করতে হতো। প্রায়ই তিনি নোংরা পড়ে থাকতেন। গৃহকর্মীটা ভাল, এককথায় রাজী হয়ে যায় উনার দায়িত্ব নিতে। এভাবেই চলছিল দিন।
এর মাঝেই একরাতে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। পরদিন সকাল পর্যন্ত কেউ জানতেও পারেনি সেকথা। গৃহকর্মী সকালে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ডাকাডাকি করেও যখন দেখে যে ঘুম ভাঙছে না, তখন খবর দেয় নাম না জানাতে আগ্রহী সেই মেয়েটাকে। মেয়েটা দ্রুতই আসে খবর পেয়ে। হাসপাতালে নিয়ে যায় অ্যাম্বুলেন্স ডেকে। জ্ঞান ফেরে এর মাঝে। তিনি তখন নিজেই টাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সমস্যা হয় হাসপাতালে কারো থাকা নিয়ে। মেয়েটা একে সাধে, ওকে ধরে। কেইবা রাজী হয় এই ব্যস্ত সময়ে? সময়ই বা কোথায়? অবশেষে একজনকে পাওয়া যায় দুদিনের জন্য। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি ওই বৃদ্ধকে সঙ্গ দেন, বন্ধুদেরও ডেকে আনেন।
কিন্তু সমস্যার মূল আরও গভীরে। একদিনে ভাল হওয়ার তো নয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হবে, এমনটিই জানিয়ে দেন চিকিৎসকেরা। মেয়েটি আবার সমস্যায় পড়ে। এবার একটি মেয়েকে রাজী করায়। কিন্তু সেটিও তো কয়েকদিনের জন্য। তারপর কি হবে? নিজেও পারছে না দায়িত্ব নিতে, আবার সরেও আসতে পারছে না। এদিকে বৃদ্ধ মানুষটার নিজের লোকদের কাউকে কাউকে খবর দেয়া হয়েছিল, কেউ আসেনি।
মেয়েটি বরাবরের মতোনই আরেকজনকে শোনায় এ গল্প। একটা কিনারা হয় এতে। বৃদ্ধের স্থান হয় একটা বৃদ্ধনিবাসে। তবে তাও সুখের হয় না। চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ হয়ে যায় বাকি জীবনটা। বিশাল ভবনের একটি ঘরে শক্ত তক্তপোশে জায়গা মেলে বটে, জীবন হারিয়ে ফেলে তার স্বাভাবিকতাটুকু। বুড়ো মানুষটা কিছুদিন আগেও চলতে-ফিরতে পারতেন, হঠাৎই তিনি খেই হারিয়ে ফেললেন। পড়ে গেলেন বিছানায়। শরীরের একটা পাশ অবশ হয়ে যায়। কষ্টে-সৃষ্টে সেই নিবাসে তার একজন দেখভালকারী ঠিক হয়, তাহলেও উনি পড়ে থাকেন বিছানায়, আর শরীর শীর্ণ থেকে শীর্ণকায় হতে থাকে। নিবাসের খাবার তাঁর মুখে রোচে না।
একদিন কথাচ্ছলে জানা যায়, তাঁর দুই ছেলের একজন প্রকৌশলী, যুক্তরাষ্ট্রনিবাসী, অপর ছেলে চিকিৎসক। সে থাকে জাপানে। আর এক মেয়ে ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর স্ত্রী, থাকে গুলশানে। কিন্তু সবার সাথে যোগাযোগের চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। উনি দেখতে চেয়েছিলেন ছেলেমেয়েদের। প্রায়ই বলতেন তাদের কথা। আবার নিজের মনে হাসতেনও, কেমন যেন চেতনালোপ পাচ্ছিল দিন দিন।
মেয়েটি জানায়, একদিন তার হাত ধরে বুড়ো মানুষটি বলছিলেন, ‘মা, তুমি আমাকে আকাশ দেখাবে একটু? নি:শ্বাস ফেলতে চাই বড় করে’। একথা বলার সময় মেয়েটি ঝর ঝর করে কাঁদছিল। সে পেরেছিল। হুইল চেয়ারে বসিয়ে ওই ভবনের ছাদে নিয়ে আকাশ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল এক বর্ষাস্নাত বিকেলে। সেদিন কী হাসি ওই মানুষটার চোখে-মুখে! কী সেই তৃপ্তি!
এরপর অনেকদিন খোঁজ নেয়া হয়নি। শুনেছি, উনি চলে গেছেন শান্তির দেশে। খুশি হই একটা মানুষের চলে যাওয়ার খবরে। জীবন এমনই। একটা ব্যর্থ জীবনের গল্প লেখার অপেক্ষায় বৃদ্ধকে পিছনে ফেলে আমরা এগিয়ে চলি আপাত জীবন নিয়েই। খুশি থাকি, সুখী হই, বিলাসী জীবন কাটাই। কিন্তু ভাবি না, আমাদের কি হবে? (চলবে)
বি. দ্র. উইমেন চ্যাপ্টার এর সব লেখাই সত্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে। শুধু নাম-ধাম পাল্টে দেয়া হয়। আমরা চাই সমাজের এই বৈকল্যগুলো উঠে আসুক বেশি করে, যাতে করে সচেতনতা সৃষ্টি হয়।