উইমেন চ্যাপ্টার: অদ্বিতীয়ার গল্প- ২। অদ্বিতীয়ার একাকী জীবন শুরু হল। একা সে কেমন করে থাকবে তাই ছোট ভাই এলো সাথে থাকতে। অদ্বিতীয়া থাকছিল তার মৃত স্বামীর নামে বরাদ্দকৃত সরকারী বাসাটাতেই। দু বছর সে থাকতে পারবে।
এই চাকরিটিতে তাদের বিভাগের ম্যানেজার প্রতিদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতেন কাজেই সে সহ অন্য সহকর্মীদেরকেও থাকতে হতো। এদিকে অফিসের বেশ কিছু পুরুষ সহকর্মী অদ্বিতীয়ার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে উঠছিল। একসাথে লাঞ্চ করার প্রস্তাব থেকে শুরু করে অফিস ফেরত বাসায় পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত সবই ছিল।
কাজ শেষে ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীরে রান্না, অন্যান্য কাজ, বিসিএসের পড়া তার উপরে পুরুষ সহকর্মীদের হয়রানিজনিত মানসিক চাপ, সব মিলিয়ে বছর খানেকের মাথায় অদ্বিতীয়া অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেল।
হাসপাতালে পরিচয় একজনের সাথে। কোনও আত্মীয়ের সাথে দেখতে এসেছিল তাকে। অদ্বিতীয়া সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরে গেলেও সেই তরুণের আসা থামল না। অদ্বিতীয়াও যেন নিঃশ্বাস ফেলার এক টুকরো জানালা পেলো। কিছুদিনের মধ্যেই সব জায়গায় আলোচনা শুরু হলো অদ্বিতীয়া আর তার বন্ধুকে নিয়ে। পরিবার তড়িঘড়ি অদ্বিতীয়ার জন্য দুটি বিয়ের প্রস্তাব আনল। অদ্বিতীয়া কোনটিতেই রাজী নয়।
এদিকে সরকারী বাড়ী ছেড়ে দেয়ার সময়সীমাও প্রায় শেষের পথে। অদ্বিতীয়া আবেদন করল যাতে সে আরও একটি বছর এই ফ্ল্যাটটিতে থাকতে পারে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অদ্বিতীয়াকে আলাদা দেখা করতে বললেন এক ছুটির দিনে আরেকটি ফাঁকা ফ্ল্যাটে। তাহলে উনি বিনা অসুবিধায় অদ্বিতীয়াকে আরও দুই বছর থাকার ব্যবস্থা করে দিবেন।
দিশেহারা অদ্বিতীয়া জানতে চাইলো, ছেলেটি কি অদ্বিতীয়াকে বিয়ে করবে তার অতীত সহ? সময় চাইল ছেলেটি। ১৫০০ টাকার বেতন ততদিনে ২৭০০ টাকা হয়েছে, কিন্তু তা দিয়ে ঘর ভাড়া করে থাকা প্রায় অসম্ভব। অদ্বিতীয়া ভাবল এখানেই ইতি তার নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন পূরণ করার! কি করবে সে বুঝে উঠতে পারছিল না।
পৃথিবীতে সুখী হওয়ার মতন ব্যাপার তখনো অদ্বিতীয়ার জন্য অবশিষ্ট আছে প্রমাণ করে ছেলেটি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলো। মায়ের তীব্র অমতেই অদ্বিতীয়া ছেলেটিকে বিয়ে করলো। ছেলেটির পরিবারও খুব সঙ্গত কারণেই এই বিয়েতে খুশী হলেন না।
অদ্বিতীয়ার দ্বিতীয় যৌথজীবন শুরু হল। বিয়ের সপ্তাহ খানেক পরে অদ্বিতীয়া তার ছেলেকে কাছে এনে রাখার কথা বলল। নিজের কানকে অবিশ্বাস করে অদ্বিতীয়া শুনল’ না, ছেলেকে এখানে রাখার তো কোনও কথা আমাদের মধ্যে হয় নাই!’ প্রতারিত বোধে জর্জরিত সে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া হৃদয় সামলে ছেলেকে মায়ের কাছেই রাখতে হলো, তার মা’ও ছাড়তে চাইলেন না নাতিকে। এই কাঁটা বিঁধে রইল অদ্বিতীয়ার মনে।
মানুষের নিজের জীবনের উপরে তার নিজের নিয়ন্ত্রণ আসলে কতটাই বা থাকে আমাদের সমাজে? অদ্বিতীয়া এই দ্বিতীয় বিবাহিত জীবনে যথাসাধ্য মানিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলো। প্রথম বছর দুয়েক বড় কোনও বিপত্তি ছাড়াই ভালই কাটল যদিও, তবে স্বামীর অন্য আরেকটি চেহারা জানতে শুরু করলো সে। স্বামীটি আসলে পড়াও শেষ করে নাই। তেমন কোনও চাকরিও সে করতো না। অদ্বিতীয়ার বেতনের টাকায় সংসার চলতো, বেতনের টাকা স্বামীর কাছেই দিতে হতো।
এরই মধ্যে অদ্বিতীয়া সন্তানসম্ভবা। স্বামী অন্য নারীর সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লো। অন্য নারীর সাথে সম্পর্কের ব্যাপার মাত্র একটিতেই সীমাবদ্ধ থাকল না। এই বিষয়টি অদ্বিতীয়াকে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত করে তুলছিল। দুইবার বিসিএস দিয়েও ভালো করতে পারল না সে।
অদ্বিতীয়া যৌথ জীবনে পারস্পারিক স্পেস দেয়াতে বিশ্বাসী ছিল। যেকোনো বিষয়ে শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের মধ্যে সেটল করাটাই অদ্বিতীয়ার পদ্ধতি, কিন্তু স্বামী চিৎকার চেঁচামেচিতে অভ্যস্ত। দাঁতে দাঁত চেপে অদ্বিতীয়া সংসার করছিলো। অদ্বিতীয়ার আস্তে কথা বলা, বা চুপ করে থাকা ‘ভড়ং’ হিসেবে বিবেচিত হতো। ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়…এযে মায়ার ছলনা…!’
এরই মধ্যে চাকরী বদলেছে সে বার কয়েক। প্রতিবার আরও ভালো চাকরী। অফিস থেকে ইউরোপে পড়তে গেছে মায়ের কাছে বাচ্চা রেখে। আমেরিকাতে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তার স্বামী এই সব ব্যাপারে বাধা দেয় নাই। বরং উৎসাহই দিয়েছে, যদিও তার অতি উৎসাহের কারণ পরে জানা গেছে। তবু এই ব্যাপারে সে স্বামীকে পুরো কৃতিত্ব দিতে কৃপণতা করে না, যে কারণেই হোক, অদ্বিতীয়ার পড়ার সুযোগ তো মিলেছে। এই পড়ার জন্যই তো তার সব আকুলতা ছিল। নিজের কর্মক্ষেত্রে, কি দেশে, কি বিদেশে, লোকজন চিনতে শুরু করেছে তাকে তার নামে। অবশ্য শেষের দিকে এটাও স্বামীর মধ্যে ‘ইগো’ সমস্যা তৈরি করছিলো বড়ভাবেই।
ছেলেকে অদ্বিতীয়া ভালো আবাসিক স্কুলে ভর্তি করেছে। খোলাখুলি জানিয়েছে ছেলেকে, কেন তাকে কাছে এনে রাখতে পারছে না। এই একটি জায়গায়ই অদ্বিতীয়া নিঃসঙ্কোচে সব কথা খুলে বলতে পারে। চোখের জলে ভেসে ছেলে তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, মা, আমি বড় হয়ে তোমাকে আমার কাছে রাখব।
অদ্বিতীয়ার দ্বিতীয় জীবন পার হয় সুখে থাকার অভিনয় করে। চিরকালের স্বাধীনচেতা মেয়েটি নিজের ভুলের মাশুল দিতে আত্মসন্মান বোধ বিসর্জন দিয়ে নতজানু জীবে পরিণত হল যেন। বিবাহিত জীবনে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব অদ্বিতীয়া নামটিকে প্রতিনিয়ত ব্যঙ্গ করে। তবু সে ভাবে সংসার টিকে থাক।
বাড়ী তৈরি হলো ঋণ নিয়ে, সেই ঋণ অদ্বিতীয়াকেই শোধ করতে হয়েছে। যদিও বাড়ীটির মালিকানা তার নামে নয়। ছেলে এর মধ্যে সেরা ফল করে কলেজ শেষ করেছে। অদ্বিতীয়ার ছেলে-মেয়ে দুজনেই মায়ের মেধা পেয়েছে। এইবার সে ছেলেকে নিজের কাছে এনে রেখেছে। স্বামীও ছেলেকে আদরই করে। অদ্বিতীয়া ভাবলো জীবনের মোড় বোধহয় ঘুরলো।
সৎ বাবার আদর সত্ত্বেও ছেলে বেঁকে বসলো মায়ের অসম্মান আর মাকে দেয়া গালি গালাজের বহরে। মেয়েটিও বড় হচ্ছে, বাবা যখন গভীর রাতে মায়ের সাথে চিৎকার করে, গায়ে হাত তুলতে চায়, ভাইয়ের কাছে আশ্রয় খোঁজে সে ভীতু খরগোশ ছানার মতন। অদ্বিতীয়ার মা, ভাই বোনেরা সবাই এই বাড়ীতে আসা ছেড়ে দিয়েছিল।
মানসিক বিষণ্ণতা অদ্বিতীয়াকে ঘিরে ধরেছে। চিকিৎসা চলল বেশ কিছুদিন। ছেলে তার হাত ধরে বসে থাকে ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে। স্বামী বেড়াতে গেছে বন্ধুদের সাথে দেশের বাইরে। কাটল আরও কয়েক বছর। আবারও স্বামীর সাথে কাছের একজন আত্মীয়াকে জড়িয়ে লজ্জাকর ঘটনা। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ অসুস্থ হয়ে পড়লো অদ্বিতীয়া।
প্রায় কয়েকমাস লেগে গেল তার সুস্থ হতে। সিদ্ধান্ত নিলো সে, আর নয়, সম্মানবিহীন এই জীবন সে আর টেনে বেড়াবে না। প্রায় ১৫ বছর পার হয়েছে এই জীবনের, নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে অদ্বিতীয়া, কোথায় সেই দৃঢ়চেতা মেয়েটি, এন্ড্রোমিডা ছুঁতে চাইতো যে! নিজেকে চিত্রাঙ্গদা ভাবতো যে তরুণী, কোথায় সে! এ যে ভেঙ্গে পড়া এক মধ্যবয়সী নারী! একবার এই শিকল ছিঁড়ে বের হতে চায়, পরক্ষণেই ভাবে পারবে কি সে?
কথা বলে সে সন্তানদের সাথে। মায়ের যে কোনও সিদ্ধান্তে দুজনেই মায়ের সাথে থাকবে তারা। ভালো একটি চাকরী আছে তার, আছে তার সন্তানেরা – যারা তার জীবনের বেঁচে থাকার প্রেরণা।
কিসের ভয় করছে সে? চৈত্র শেষের এক তাপদগ্ধ সকালে বাইকুড়ানীর ঘূর্ণির মধ্যেই সন্তানদের হাত ধরে অদ্বিতীয়া দ্বিতীয়বারের মতন পা বাড়ায় এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত, কিন্তু মুক্ত একাকী জীবনের দিকে। (চলবে)