‘নো হোয়্যার টু রান’

Urmi ATN
ইশরাত জাহান ঊর্মি

ইশরাত জাহান ঊর্মি: ভোরের নারায়ণগঞ্জ। লিংকরোডে ঢুকতেই একপাশে টুকরো টুকরো সবুজ চোখে পড়ে। নীচুজলার মধ্যে বুনো কচু, হেলেঞ্চার লতা দোল খাচ্ছে। আকাশ শ্লেট রঙা। দুএক ফোঁটা বৃষ্টিও। আমরা দুই টিম এসেছি শহরে নির্বাচন কাভার করতে। আগে থেকেই আছে আরও দুই টিম। শহর ফাঁকা ফাঁকা। শুধু বাতাসে দোল খাচ্ছে দড়িতে টানানো সেলিম ওসমানের শত শত পোস্টার। সাদা-কালো।

এক জায়গায় শ্লোগান লেখা দেখলাম, কে বলেরে নাসিম নাই, নাসিম মোদের সেলিম ভাই..কোথাও কোথাও ভুল বানানে লেখা নাসিম ওসমানের মৃত্যুতে “শ্রদ্ধাঞ্জলী”। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ভুল বানানের মতোই, কত ভুল জায়গাতেই না মানুষ শ্রদ্ধার অঞ্জলি দেয়। আসলেই শ্রদ্ধা না কি সকলই গরল সখা?

একসময় নারায়ণগঞ্জ শহরে অনেক এসেছি। বাবুরাইল, চাষাড়া, শীতলক্ষা, কালিরবাজার। রাস্তাগুলো সরু সরু, একটু অগোছালো দোকান-পাট, বন্দরের গন্ধ লেগে থাকা এক শহর। অনেকবছর পর আবার প্রথম যাই গত মে’তে। জালকুড়ি চন্দন সরকারের বাড়ি।

আর এবার নির্বাচন কাভারে। আপাত চোখে কিছুই বদলায়নি শহরের। আগের মতোই রাস্তা-ঘাট, চাষাড়ার মোড়ের সান্ত্বণা মার্কেট, প্রেসক্লাবের সুধীজন পাঠাগার। শহর চুপচাপ। ভোট হচ্ছে। দূর থেকে দেখছে সাধারণ মানুষ। যেন এই ভোটের সাথে তাদের কোন সংযোগ নেই, যেন তারা কেউ নয়, যেন তারা অনাহূত, কখনও জাস্ট রবাহূত অর্থাৎ রব শুনিয়া আহুত, সোজা বাংলায় শব্দ শুনে এসেছে। কিসের শব্দ?

ভোটের গর্জন, মিডিয়ার গাড়ি আর সাংবাদিকদের ব্যস্ত চলাচলের শব্দ। গণবিদ্যা উচ্চ নিকেতনের সামনে টেলিভিশনের গাড়ির ভিড়। ভেতরে ধুন্ধমার লাইভ হচ্ছে। আমার কপাল ভালো, একই নিউজে দুইবার দুই হেভিওয়েট প্রার্থীকে লাইভে দেখালাম। তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বাইরে এসে দেখি রাস্তার আইল্যান্ডে মানুষের ভিড়। তারা মজা দেখতে এসেছে। আমি কারো কারো সাথে কথা বলতে চাই। তারা ক্রমেই দূরে সরে যায়। ‌…কি কথা বলব, আপনেরা তো দেখতেইছেন, ভোট ভালোই হইতাছে… এসব বলে আমাকে এড়িয়ে যায়। আমি স্কার্ফ দিয়ে মুখের ঘাম মুছি। কোথাও একটা ঝামেলা হয়েছে, কোথাও একটা খামতি আছে টেলিভিশনের ক্যামেরার চোখে তা ধরা পড়ে না।

আমি কয়েকটা কেন্দ্রে ঘুরি। সব স্বাভাবিক। একটাই অস্বাভাবিকতা, ভোট উৎসবে উৎসব করার কেউ নেই, অর্থাৎ ভোটার নেই। আর কেন্দ্রগুলোর বাইরে বুকে লাঙ্গলের স্লিপ সাঁটা মানুষ-জন দাড়িয়ে আছে। আনারস বা গামছার প্রার্থীর এজেন্ট খোলা চোখে তো দেখতে পেলাম না। একজন আমাকে (কে তা বলছি না সঙ্গত কারণেই, গুমের ভয় তো সবারই আছে!) ফোন করে বলা হলো, আপনি বারবার ভোটার নেই, ভোটার নেই বলছেন কেন লাইভে? ভোটার কম আসাটা তো কোন অন্যায় না, ভোটটা ঠিকঠাক হচ্ছে কি না সেইটা বলেন।

আমি তর্ক করি না। বলি না যে, ভাই ভোটার না এলেই তো নিজেদের ইচ্ছেমতো ভোট দেয়া সুবিধা হয়। তবে এটা তো ঠিক যে, সেলিম ওসমানের ভোটাররা অন্তত: ভোটটা দিতে এসেছেন, নিজেরটা দিয়েছেন সাথে আরও কয়েকটা হয়তো বাড়তি…সেইটা তো কথা না, কথা হলো এস এম আকরামের পক্ষের ভোটারই তো ঠিকঠাক আসেনি। আমার স্থানীয় এক বন্ধু আমাকে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি বুঝালো দুপুরের খাবার খেতে খেতে। আমি সেসব লম্বা কথায় যাচ্ছি না।

বড় ধরনের কোন ঝামেলা সারাদিনে হলো না। শেষ বিকেলে নারায়ণগঞ্জ কম্যুনিটি ক্লাবে শামীম ওসমানের সহযোগী খোকন সাহা খুব রাগ হলেন। কেন কন্টিনিউ এখানে টিভি ক্যামেরা বসে আছে-এই তার রাগ। ভোট শেষ হতে তখন ১০/১৫ মিনিট বাকী।  তার খানিক আগেই একদল ছেলে তারা এজেন্ট না অন্য কোন দায়িত্বের আমরা বুঝলাম না একদল নারীকে ভোট দিতে ‍‌‌‌”সাহায্য” করছিলেন। ক্যামেরাগুলো ছবি নিচ্ছিল। ক্যামেরা কারণে ভোট দিতে ‌‍”সাহায্য” করতে সমস্যা হচ্ছিল বুকে লাঙ্গলের স্লিপ আঁটা ভাইদের। এজন্যই খোকন সাহা বিরক্ত হচ্ছিলেন। প্রিজাইডিং অফিসার বেচারী না পারেন সাংবাদিকদের সামলাতে, না পারেন খোকন সাহা স্যারকে থামাতে। এত রাগের কারণ একটু পরে আরও খোলাসা হলো।  ইলেকশন অবর্জাভার ফেমার নির্বাহী মুনীরা আপা এলেন ওই সময়। বললেন, এই সেন্টারে ভোট কম পড়েছে। অর্থাৎ কম ভোটকে একটু বাড়িয়ে দেয়ার দায়িত্ব হয়তো খোকন সাহার ছিল। দুদশ মিনিটও কি ক্যামেরাগুলো বাইরে যেতে পারে না? এটা তো অনিয়ম। সে কি রাগ তার। ক্যামেরা-ট্যামেরা মানেন না। যাই হোক একটু পর তারা বের হয়ে যেতে বাধ্য হলেন।

ভোট ঢালা দেখে আমিও আমার আরেক রিপ্লেসের রিপোর্টারকে রেখে বের হয়ে এলাম। ঢাকায় ফিরবো। গেটে তখনও খোকন সাহার নেতৃত্বে গর্জন চলছে। লোকজন দাঁড়িয়ে শুনছে তার গর্জন।

আমি ড্রাইভারকে বলি, দ্রুত গাড়ি টান দিতে। কেন জানি না গা ছমছম করছিল। অথচ কোথাও তেমন কোন গণ্ডগোল নেই। তবু কেন এরকম লাগল।

সবচেয়ে বড় কথা দমবন্ধ লাগছিল আমার। নদীর পাড়ের শহরে কেন দমবন্ধ লাগবে? আমি বুঝি না, শুধু মনে হয়, এখানকার মানুষগুলোরও কি আমার মতো দমবন্ধ লাগে? আমি তো ঢাকায় পালালাম, ওরা তবে কোথায় পালায়?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.