উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই ……

Jahanara Imam 4লুতফুন নাহার লতা: বনানী থেকে শহীদ মিনার এতো দীর্ঘ আর কোন দিন মনে হয়নি। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, আমাদের সবার আম্মা অলরেডি এসে পৌঁছেছেন সেখানে। সংবাদ পাবার পর থেকে হু হু করে চোখের জল গড়িয়ে চলেছে, সকালের কোন কাজে মন বসাতে পারিনি, সংসার-সন্তান সব আজ এলোমেলো। বাসায় কাজের বুয়ার কাছে ছেলেকে রেখে ছুটছি সেখানে, যেখানে বাংলা ও বাঙ্গালীর আজ পতাকায় ঢাকা তাঁর দেহাবশেষ ছুঁয়ে আবার নতুন করে শপথ নেবার দিন এসেছে।

আমি কিছুতেই কান্না থামাতে পারছি না। ড্রাইভার বার কয়েক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বলল ‘আফা কাইন্দেন না, কানলে মুর্দার কষ্ট হয়’। সত্যিই তো আমি কাঁদছি কেন, আমি তো চাই না আম্মার আত্মার কষ্ট হোক।

১৯৭১ থেকে যে মানুষটি তাঁর আদরের সন্তান মুক্তিযোদ্ধা রুমিকে হারাবার বেদনায় ঝাঁজরা হয়ে আছে। যার পাঁজর ফেটে রক্তধারা বয়ে চলেছে সেই বীভৎস হত্যার উৎসবে রাজাকার, আলবদরদের হাতে নিহত তার সন্তানের মত হাজার হাজার ছেলের জন্যে, কেমন করে তাঁকে ব্যথা দেই!

আম্মার লেখা ‘একাত্তরের দিনগুলি’ যখন পড়তে শুরু করি আমি তখন সিদ্ধার্থের জন্মের আশায় দিন গুনছি, মনে মনে খুব নাজুক, সব কিছুতেই কেবল কান্নাকাটি করি। সারাদিন হাতে ধরে রাখি ওই বই, পড়তে পড়তে কেঁদে ভাসাই।

আমার একটা সমস্যা হলো, যা কিছু প্রাণ দিয়ে উপলব্ধি করি, আমি ঠিক সেই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাই। কিছুদিনের মধ্যে আমার কেমন যেন নিশি’তে পাওয়া মানুষের মত অবস্থা হল। যেন আমি সারাক্ষণ দরজায় পাকিস্তানি মিলিটারির ভারী বুটের আওয়াজ শুনি, চারিদিকে ফিসফাস, গোলাগুলি, আর্তনাদ আর বীভৎস উল্লাস শুনি! দু’হাতে পেট চেপে ধরে আমার রুমীকে লুকিয়ে রাখি আমার গর্ভের অতল অন্ধকারে। যেন ওটাই আমার সন্তানের জন্যে আমার একমাত্র নিরাপদ ঠাঁই। যেন কেউ ওকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে না পারে। গর্ভের আঁধারে আমার সিদ্ধার্থ কখন আমার রুমী হয়ে ওঠে নিজেরই অজান্তে। মাঝে মাঝে আম্মার বাসায় যাই। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই কলাপসিবল গেট খুলতেই আম্মা এসে দাঁড়ান, আমি ‘খালাম্মা গো — ‘ বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠি। তখনো আমি তাঁকে ‘খালাম্মা’ বলেই ডাকতাম।

আমাকে ধরে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজে রুমীর ছবিটির নিচে রাখা চেয়ারে বসতেন। রুমীর ছবির নিচে জীবনানন্দের সেই অসাধারণ দেশপ্রেমের কবিতার কয়েকটি চরণ লেখা, মনে হত যেন মুখ ভরা হাসি নিয়ে মাথার হ্যাটটি ঝুঁকিয়ে সবার দিকে চেয়ে বলছে, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ি’টির তীরে এই বাংলায়, হয়ত মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে —-আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ খেত ভালোবেসে’।

সিদ্ধার্থের জন্মের পরে দুই মাস বয়সে ওকে নিয়ে যাই আম্মার কাছে, ঐ সেই চেয়ারে বসেই ওকে কোলে নিয়ে বলেছিলেন ‘লতা এই তো তোমার রুমী!’ আম্মার সাথে সাথে আমরাও তখন সিদ্ধার্থকে প্রায়শই রুমী বলে ডাকতাম।

শহীদ মিনারে এসে দেখি মানুষের ঢল। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা, শিল্পী , সাহিত্যিক, কবি, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, মুটে, মজুর, কুলি, রিকশাওয়ালা, গাড়ীওয়ালা সব একাকার। সবার চোখে জল। আমেরিকার ডেট্রয়েট থেকে আম্মার সাথে এসেছে তাঁর ছোট ছেলে জামী, সে অবিচল পাথরের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে শহীদ মিনারের পাদদেশে, যেখানে একটি বিশাল লাল-সবুজ পতাকায় ঢাকা এক মহীয়সী নারী। এক রুমীকে হারিয়ে যিনি হয়ে উঠেছিলেন হাজার হাজার রুমীর মা। আমাদের সবার মা।

একাত্তরে আর এক শহীদের স্ত্রী, লেখিকা মুশতারী শফি আমাকে চত্বরের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কাছে এসে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর লেখা পড়ে একবার তাঁকে চট্টগ্রামে ফোন করে কথা বলেছিলাম, সেকথা মনে করে আবার বুকের সাথে চেপে ধরলেন, ওনার এক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল, তার মাধ্যমে এরপর থেকে আমার খোঁজ খবর রাখতেন, মাঝে মাঝে আমিও ফোন করতাম। সময় বয়ে গেল কেমন সবাইকে অবশ-বিবশ করে দিয়ে! দেখা শেষ হলে আম্মাকে নিয়ে সবাই চলল মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানের দিকে পিছনে পিছনে আমিও। বুদ্ধিজীবী গোরস্থানের গেটে একটি ইটের বেদীফলকে লেখা রয়েছে ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তাঁর ক্ষয় নাই ।’

জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বাংলাদেশে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ। বিশেষ করে ৯১ তে ঘাতক গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামী দলের নায়েবে আমীর হবার পরে তিনি আর বসে থকতে পারেননি। তিনি সকল মুক্তিযোদ্ধা ও সমমনা মানুষকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সেই দিনগুলোতে এর সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষের অবদান ও আত্মত্যাগ আমাদের জাতির ইতিহাসে অবিনশ্বর।

Lata apa
লুতফুন নাহার লতা

সেদিনের গণ আদালত চত্বর থেকে আজকের শাহবাগ আন্দোলনের শুভ সূচনা করেছিলেন তিনিই। তাঁর সন্তানেরা, ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির প্রতিটি কর্মী ছুটে বেড়িয়েছে পথে-প্রান্তরে, গ্রাম থেকে গ্রামে, সীমান্ত থেকে সীমান্তে, মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী। ১৯৭১ এ যারা বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনি, অখণ্ড পাকিস্তানের হয়ে পাকিস্তানি মিলিটারিদের সাথে হাতে হাত রেখে, নিজের দেশ, জাতি ও দেশের মানুষের সাথে করেছে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। রাজাকার, আলবদর সেজে বাংলাদেশের সাধারণ, নিরীহ মানুষকে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে পৈশাচিকভাবে হত্যায় সহযোগিতা করেছে এবং নিজেরাও হত্যা করেছে। সেই সব গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগ করেও তারা পার পেয়ে গেছে।

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিশ্বাসঘাতকতায় আবার যুদ্ধাপরাধী, পাকিস্তানপন্থী, মানবতাবিরোধী এই সকল ঘাতক বেরিয়ে আসে অন্ধকার থেকে। কেবল রাজনীতি করার অধিকারই শুধু নয়, তাঁরা সংসদে বসে দেশ পরিচালনাতেও অংশ নেয়। একটি স্বাধীন দেশে কেবলমাত্র অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধের মত বিশাল একটি অর্জন অতি দ্রুতই ভূলুণ্ঠিত হতে থাকে। তার বদলে স্থান করে নেয় ঠক, বাটপার, বিশ্বাসঘাতকদের নেতৃত্ব।

আজ যখন শাহবাগে এসে দাঁড়ায় বর্তমান প্রজন্ম, লক্ষ কন্ঠে গগনবিদারী আওয়াজ তোলে ওদের ফাঁসির দাবি নিয়ে, তখন যুদ্ধাপরাধী বা মানবতাবিরোধী যাই বলিনা কেন, সেই সকল ঘাতকের তখতে তাউস কেঁপে ওঠে বৈকি! এর সকল কৃতিত্ব সেই মহান সৈনিক জাহানারা ইমামের, যিনি দূরন্ত ক্যান্সারের সাথে থেকেও অসম সাহসের সাথে লড়াই করে গেছেন বাংলাদেশের ক্যান্সার জামাত আর তার মানবতাবিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে।

আজ যখন একে একে তাদের বিচার হচ্ছে, বিচারে তাদের সকলের সর্বোচ্চ শাস্তির রায় কার্যকর হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তখন যে কোন মূল্যেই তা হবে, দেশ জাতি ও সরকারের কাছে কেবল সেই প্রার্থনাই করি।

এই আকাশ, আলোক, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চিরদিন এই কথা জানুক, এই সেই নদী বিধৌত পলিমাটি ভরা বাংলাদেশ, এই দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটি শহীদের রক্তে ভেজা। এই দেশে একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের ক্ষমা নেই। বিপ্লব বিদ্রোহ দীর্ঘজীবী হোক। জয় হোক বাংলার। জয় হোক সত্যের। জয় হোক শহীদ জননী জাহানারা ইমামের। তাঁর অন্তর্ধান আমাকে নত করে আমার সকল সমর্পণ তাঁর আত্মার প্রতি। তিনি আমার অজান্তেই কখন আমার চিরকালের মা হয়ে ওঠেন।

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই —– ‘

শেয়ার করুন: