সোভিয়েত নারীর দেশে-১২

S.Petersburg 2
সেন্ট পিটার্সবুর্গ স্টেট ইউনিভার্সিটি

সুপ্রীতি ধর: প্লেন যখন ককেশাসের ওপর দিয়ে উড়ে আসছিল, অদ্ভুত একটা অনুভূতি আমায় আচ্ছন্ন করছিল প্রতি মূহূর্তে। প্রকৃতি কী বিশাল সৌন্দর্য নিয়ে ছড়িয়ে আছে বিশ্বময়। এতো সবুজ যে ওপর থেকেও বোঝা যাচ্ছিল। প্লেন কখনও নিচ দিয়ে, কখনও পাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল।

প্রায় তিন ঘন্টা ধরে পাহাড়-নদী-পর্বত সব পেরিয়ে এসে নেমেছিলাম বিপ্লবমণ্ডিত শহরে, লেনিনের শহরে। হেরমিটেজের শহরে। যেখানকার প্রতিটি ইঞ্চি ইতিহাসের কথা বলে। হেরমিটেজের প্রতিটি ছবি এখনও চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই যেন। এতোবার গিয়েছি, এতোবার পড়েছি চিত্রকলা সম্পর্কে, মাতিস, রেমব্রান্ট, ভ্যান গগরা এমনভাবে মাথায় চেপে বসেছিল যে, পরে ভালবেসে একটা কোর্সও করেছিলাম আমি ঊনিশ শতকের স্যুরিয়ালিজম, রিয়ালিজমের ওপর। শিশকিনের গাছের ছায়ার ভিতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি অনুভব করেছিলাম আইভাজভস্কি’র ‘জিভিয়াতি ভাল’ (নয় নম্বর স্রোত জাতীয় কিছু হবে অনুবাদ করলে)। এই গল্প আরও পরে হবে।

লেনিনগ্রাদে এসে পৌঁছালাম বিকেলবেলা। যদিও সময়টা ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা বলেই জানান দিচ্ছিল। কিন্তু দিনের আলোয় একে সন্ধ্যা বলি কি করে!

লেনিনগ্রাদ, যা কিনা আজকের সেন্ট পিটার্সবুর্গ পৌঁছানোর তারিখটাও মনে আছে। ২২ শে আগস্ট। পাতা ঝরার দিন আসন্ন। শুনেছি এখানে, এই শহরে ৪৫ জনের মতোন বাঙালী আছেন। তারা কেমন দেখতে? তারা কি মিশুক হবে? আমাকে মেনে নেবে তো? অনেকদিন বাঙালী সান্নিধ্য পাই না। কতদিন পর যে বাংলায় কথা বলবো, এই খুশিতেই রাতে ঘুম হলো না।

পরদিন সকাল সকাল আসাদ ভাই ডেকে তুললেন। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে রওনা দিলাম ইউনিভার্সিটির দিকে। আমার কাঙ্খিত লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটি। জ্বলজ্বলে রোদ বাইরে, আসাদ ভাই বললেন, হালকা সোয়েটার জাতীয় কিছু সাথে নিতে। ভেবেই পাচ্ছিলাম না, এরকম রোদেলা দিনে সোয়েটার কোন কাজে লাগবে। বাইরে বেরুনোর পর আসাদ ভাই বললেন, লেনিনগ্রাদের আবহাওয়ার কথা বলা যায় না, যেকোনো মূহূর্তে তা বদলে যেতে পারে। তাই গরম কাপড় রাখাই ভাল। আমিও শিখে নিলাম। পরবর্তী নয় বছরই আমার এই শিক্ষা কাজে লেগেছে।

হোস্টেল থেকে বেরিয়ে কেমন যেন অচেনা শহরের গন্ধ নাকে আসছিল। গত নয় মাস যে শহরে কাটিয়ে এলাম, সেখানে আর যাই হোক, দেশের কাছাকাছি আবহাওয়ার স্বাদ ছিল। কিন্তু এখন, এতোদিনে আমার বিদেশ, বিদেশ বলে মনে হলো। ঝকঝকে মন ভাল করা রোদ। কিন্তু ভারী বিষন্ন। কোথায় যেন একটা সুরকাটা আমেজ বাতাসে মিশে আছে। এটাই কি এই শহরের বৈশিষ্ট্য? জানা হয়নি কখনও।

আসাদ ভাইয়ের হোস্টেলের কাছ থেকেই ইলেকট্রিক ট্রলিব্রাসে করে ইউনিভার্সিটিতে এলাম। ডিন অফিসে গিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সারলাম। ইউনিভার্সিটি জানলো, সুপ্রীতি নামের একজন বাংলাদেশি মেয়ে তাদের এখানে পড়তে এসেছে। পরে যাকে তারা একনামেই চিনবে, সেইকথা অবশ্য ওই মূহূর্তে ধারণাও করতে পারেনি ওরা।

ওখান থেকে হোস্টেল। ঠিক হয়ে গেল ১২০১ নম্বর রুম, লিফটের ১২ তলায়। জীবনে এই প্রথম আমি ১২ তলায় থাকবো। দেশে তো ছয় তলার ওপরে উঠিইনি কখনও। আসাদ ভাইয়ের হোস্টেলে ফিরে গোছানো ব্যাগটা নিয়েই চলে এলাম নতুন ঠিকানায়।

১২০১ নম্বর রুম। প্রচণ্ড আলো-বাতাস। রুমমেটরা তখনও কেউ আসেনি। কে আসবে, কোন দেশের, কোন প্রজাতন্ত্রের, ধারণাতেও নেই। তিন-আসনের একটি আর দুই-আসনের একটি রুম নিয়ে একেকটি অ্যাপার্টমেন্ট টাইপ। সঙ্গে করিডোর, যেখানে রান্নার চুলা বসানো, বেসিন। একদিকে শাওয়ার রুম, এবং টয়লেট। বেশ ছিমছাম, সুন্দর। আমার ভাগে পড়েছে তিন আসনের রুমটি। সাধারণ বিবাহিতদের জন্য বরাদ্দ থাকে দুই আসনের ছোট রুমগুলো। বিছানাপত্র বুঝে নিয়ে এসে বিছিয়ে নিলাম। আলমারিতে কাপড় গুছিয়ে রেখে, টেবিলটা ঝেড়ে-মুছে নিলাম। পুরো অ্যাপার্টমেন্টে তখন আমি একা। গ্রীষ্মের ছুটি বলে রুশ শিক্ষার্থীরা চলে গেছে ‘কালখোজে’, একধরনের খামার। সেখানে আলু তোলাই তাদের প্রধান কাজ। তাই কেউ এখনও আসেনি। মনটা খাঁ খাঁ করতে লাগলো আবার………এখানে থাকবো কি করে?

বিকেলে আসাদ ভাই আবার এলেন। মেডিকেল হোস্টেলে নিয়ে যাবেন উনি। সেখানে নাকি ‘বাঙালীদের আখড়া’- আসাদ ভাইয়ের ভাষায়। আমার হোস্টেলের সামনের রাস্তার নাম কারাবলেস্ত্রোইচিয়েলেই। সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল বলেই হয়তো বা এমন নামকরণ রাস্তার। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘জাহাজনির্মাণকারী’। তিনটা ১৯ তলা হোস্টেল পাশাপাশি। হোস্টেল থেকে বেরিয়েই বাস স্টপেজ, দু পা এগোলেই পলিক্লিনিক, আরও দুই পা দূরত্বে খাবার-দাবার কেনার দোকান। আর হোস্টেলের দোতলায় স্তালোভায়া বা ক্যান্টিন। মোটামুটি এই হলো আমার আগামী কয়েক বছরের সঙ্গী-সাথী। ভাল কথা, একটা সিনেমা হলও আছে, বলা হয়নি। আর সবচেয়ে ভাল লাগার জায়গাটিই তো আমার হোস্টেলের পিছনে, ফিন উপসাগর। শীতে-গ্রীষ্মে ভিন্ন রূপ। সারা বছর সেখানে লেগে আছে ‘পাগলা হাওয়া’- পার্থদা-মামুন ভাইয়ের ভাষায়। এই পাগলা হাওয়ায় কত মন যে ভেঙে গেছে, কে জানে! আর এই সাগরের তীরেই পাঁচ তারা হোটেল-প্রিবালতিস্কায়া। কত বিপদে-আপদে যে ছুটে গেছি এই হোটেলে, কখনও কেক আনতে, কখনও হোস্টেলের ফোন কাজ করছে না, তাই হোটেল, এমন অনেক কাজে।

ইলেকট্রিক ট্রলিবাসে করে আবার যাত্রা শুরু। রাস্তার দুপাশের সবই দেখার মতোন। নতুন ভবন একেবারে হাতে গোণা। সবই প্রায় মধ্যযুগ না হলেও জারের আমলের, তাতে সন্দেহ নেই। এঁকেবেঁকে রাস্তা, কখনও নদীর ওপর দিয়ে প্রায় এক ঘন্টা পর গিয়ে পৌঁছালাম নদীর পাড়ে এক হোস্টেলে। পুরনো আমলের ভবন। দেখলে মনে হবে কোন রাজপ্রাসাদে ঢুকছি। কিন্তু ভিতরে ছাত্রছাত্রীতে গাদাগাদি। চার তলায় ৪৩০ নম্বর রুমটিই খুব সম্ভবত ছিল মৃণালদার। দুরু দুরু বুক নিয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেই দেখি কত অচেনা মুখ, অথচ সবাই এক ভাষাতেই কথা বলছে। কী যে শান্তি!

মৃণালদা, শিউলী আপা, পল্লব, মুরাদ আগে থেকেই ছিল। পরে শিহাব ভাই এলেন অন্য একটা রুম থেকে। বেলি আসলো। লোকেশ আসলো। এতো দেখি রীতিমতো জনারণ্য! আমি এক কোণে বসে শুনি তাদের কথা। এখানে এসে মনে হচ্ছে, আমার বাংলায় ফ্লুয়েন্সি চলে গেছে। কথায় কথায় রুশ বলছি। কারও যে বিষয়টা নজরে পড়ছে না, তা নয়। মৃণালদা স্বীকারই করলেন যে, মাত্র নয় মাসে রুশ ভাষায় এমন শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলা সত্যিই বিস্ময়কর।

মৃণালদা আর শিউলী আপা রান্না করলেন। তারা ধরেই নিয়েছিলেন, আমি খেয়ে যাবো। কিন্তু আমার ‘যাই যাই’ শুনে তারা যারপরনাই অবাক হলেন। মেয়ে বলে কী! এখানে নাকি নিয়ম কোথাও গেলে খেয়েই আসতে হয়। এখানকার বাঙালীরা বলে, ‘আযান দেয়া’, মানে খাওয়া। আমিও প্রথম দিনেই ‘আযান’টা তাই দিয়েই দিলাম। অন্তত রাতে ক্যান্টিনে খাওয়ার ঝামেলা থেকে তো বেঁচে গেলাম।

রান্না করতে করতে গানও হয়ে গেল এক পশলা। বড় গায়ক একজনই, মৃণালদা। অন্যরা সবাই সহশিল্পী আর কি।  মৃণালদা মানুষটা আগাগোড়াই গানের। সবসময়ই সে গায়, কখনও জোরে, কখনও গুন গুন করে। সাথে অন্যরাও গায়। পরে থেকে আমিও সুর ধরেছি।

এখন আর মনে পড়ে না, তবে রবীন্দ্রনাথের ‘আজি বাদর, মহা ভাদর’ শব্দটার অর্থ নিয়ে একটুখানি বিতর্ক উঠেছিল। আমি যখন বললাম, এই বাদর মানে বাদল, বর্ষা, মৃণালদা সায় দিয়ে বলেছিলেন, যাক, আজকে থেকে ‘আরেকজন’ পাওয়া গেল।

অনেকদিন পর ঘরের রান্না খেলাম মনে হলো। এমন সুস্বাদু রান্না আর এমন আন্তরিকতার সাথে খাওয়া গত নয় মাসে জোটেনি। কেউ তো কখনও বেড়ে খাওয়ায়নি এই কদিন। আমিও প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম বাড়ি বলে মানুষের কিছু থাকে। সেদিন আমার ওই রুমটাকেই নিজের বাড়ি মনে হয়েছিল। আর মানুষগুলোকে একই পরিবারের। সেই যে বোধটা কাজ করেছিল, আজ এতো বছর পরও একচুল পরিমাণও সরেনি।

খাওয়া শেষে অনেক রাত করে ফিরলাম হোস্টেলে। একা এক রুমে। কেমন জানি গা ছমছমে ভয়। রাতে ঘুমালাম নির্বিঘ্নেই, কিন্তু সকালটা হলো ভীষণ রকমের এক বিষন্নতা দিয়ে। হাহাকার একরাশ। বিদেশে আসার পর থেকে এই হয়েছে এক জ্বালা। সকালে ঘুম ভাঙলেই বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে আসে। মায়ের জন্য, প্রিয় মুখগুলোর জন্য, পরিচিত রাস্তাঘাটের জন্যও মনটা কেমন করে উঠে! একা রুম পেয়ে আমি চিৎকার করে কাঁদি। ফিরে যেতে ইচ্ছে করে রাতে ফেলে আসা সেই রুমটাতে, যেখানে অনেকগুলো মানুষ একসাথে ছিল, যেখানে অনেকগুলো মুখ বাংলায় কথা বলেছিল, যেখানে অনেকগুলো মানুষ গান গেয়েছিল।

সেই প্রথম রাত থেকেই মেডিকেল হোস্টেলের এই ৪৩০ নম্বরটা আমার জন্য হয়ে উঠেছিল বাড়িঘর, তীর্থক্ষেত্র। কত মানুষের কত আনন্দ, হাসি-কান্না, স্বপ্ন-স্বপ্নভঙ্গের, সুখ-দু:খের সাক্ষী এই রুম, আমরা ছাড়া কেই-বা জানে!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.