বিশ্বকাপ এলেই মনে পড়ে

Monija Rahman
মনিজা রহমান

মনিজা রহমান: এই সেনেগাল আমার মহা মূল্যবান তিন পয়েন্ট কেড়ে নিয়েছিল। ম্যানহাটান দিয়ে যাচ্ছিলাম ট্যাক্সিতে। ফ্রন্টসিটে বসা আমার স্বামী ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিল। ভদ্রলোকের নাম আবদুল হাই। বাড়ী সেনেগাল।

সেনেগালের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাসিতে ভরে গেল মুখ। পাশে বসা আমার ছেলে জিজ্ঞাসা করল, আম্মু হাসছ কেন? উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। মন হয়ে গেল অতীতাশ্রয়ী।

মনে পড়ল ২০০২ বিশ্বকাপের কথা। উদ্বোধনী ম্যাচে সেনেগালের কাছে প্রথম ম্যাচে হেরে গিয়েছিল ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স। ওই ম্যাচে জিদান বাহিনী শুধু হারেনি, হেরেছিলাম আমরা অনেকেই। বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যতম অঘটনের ম্যাচ ছিল সেটা। তবে অঘটনের মাঝেই আনন্দে বগল বাজিয়েছিল কয়েকজন। তাদের সেই আস্ফালনের কথা ভেবেই বহুদিন পরে হাসির দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছিল শরীর। মনে পড়ল জনকণ্ঠ অফিসের সেই বিশ্বকাপ বাজির কথা।

বিশ্বকাপ ফুটবল এলেই জনকণ্ঠ অফিসের আবহ পাল্টে যেত। সাজ সাজ রব চারদিকে। দেয়ালে ঝুলতো ম্যাচের শিডিউল। প্রত্যেকের সিটে প্রিয় দলের পতাকা উড়তো। টিম জার্সি পরে আসতো অনেকে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে আনন্দ উত্তেজনা তো ছিলই। কথা কাটাকাটি। তর্কযুদ্ধ চলতো।

বিশ্বকাপ শুরুর আগের দিন বিশাল এক রঙচঙে বাক্স রাখা হত টেবিলে। সেখানে সবাই ম্যাচের ভবিষ্যৎবাণী করতো। প্রত্যেকেই তখন দুঁদে বাজিকর।

বাজিতে আমার ভাগ্য নেহাত মন্দ ছিল না। প্রথম পাঁচজনের মধ্যে ছিলাম ২০০২ আর ২০১০ বিশ্বকাপে। আর ২০০৬ সালে তো রীতিমত কিস্তিমাত। ইতালি চ্যাম্পিয়ন। আমিও চ্যাম্পিয়ন। গুলশানের সমরখন্দ রেস্তোরায় বিশাল ভোজ শেষে এডিটর সাহেব প্রথম পুরস্কারের অর্থ তুলে দিলেন আমার হাতে। আহা! জীবনে এমন আনন্দের মুহূর্ত খুব বেশী আসেনি।

ক্রীড়া বিভাগের কেউ না কেউ প্রথম পুরস্কারটা বাগিয়ে নিত। একবার সাইফুর ভাই (শেখ সাইফুর রহমান), আরেকবার সাঈদ ভাই (সাঈদুজ্জামান) প্রথম হয়ে ক্রীড়া বিভাগের মান রেখেছিলেন। আমরা সবাই প্রতিযোগিতা করতাম প্রথম হবার জন্য। প্রথম পুরস্কারটা বাগিয়ে নিতে। এজন্য রাতের ঘুম হারাম সবার। আর হবেই না কেন খেলা দেখতে হত রাত জেগে।

তবে কয়েকজন ছিল ব্যাতিক্রম। যারা সব সময়ই উল্টোপাল্টা ধরতো। ম্যাচে যেদিন আপসেট হত, সেদিনই তারা পয়েন্ট পেত। শুধু সেইদিনই তাদের কণ্ঠ শোনা যেত। বাকী কয়েকদিন তারা চুপচাপ অফিসে আসতো। মাথা নীচু করে কাজ করে যেত। চারদিকে নানা টিটকারি-টিপ্পনির মধ্যে থাকতো আশ্চর্য্য নীরব। যেভাবে আসতো, সেভাবে নীরবে প্রস্থান করতো তারা।

শেষ দিক থেকে প্রথম হবার লড়াইয়ে চঞ্চল আশরাফ আর রাশেদ মেহেদি ছিল অগ্রণী। দুজনের একজন নামকরা কবি, অন্যজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। দুজনেই তারা বুর্জোয়া বিরোধী। দুর্বলদের পক্ষে। যে কারণে ফ্রান্সের বিপক্ষে তাদের বাজি থাকতো সেনেগালের পক্ষে। এই নিয়ে কম কথা শোনানো হয়নি তাদের।

ফুটবল অনিশ্চয়তার খেলা না। হাতেগোনা দুই-একটা আপসেট ঘটলেও শেষ পর্যন্ত ফেবারিটরাই জিতে নেয় বিশ্বকাপ। প্রথা বিরোধীদের তাই শেষ পর্যন্ত ঠাঁই হত সবার নিচে, তলানিতে।

নিচে রিপোর্টিং ফ্লোর, ওপরে ফিচার বিভাগ- সরগরম থাকতো বাজির একটা মাস। অফিসের পিয়ন-দারোয়ান থেকে শুরু করে বাজিকররা বার বার এসে দাঁড়াতো পয়েন্ট টেবিলের সামনে। দেখতো তাদের অবস্থান কোথায়? ওপর থেকে হাইহিলে ঠক ঠক শব্দ তুলে নামতেন শান্তা আপা। ঝুমা আপা। রুমা আপা। অদিতি আপা। আগুন। মিলি আপা। বাজির কুপন ফেলতে আসতেন তারা। রিপোর্টাররা তাদের আগমনে প্রীত হতেন।

রিপোর্টিং বিভাগ থেকে কেউ কেউ যোগ দিতেন ক্রীড়া বিভাগে। যেমন মাসুদ কামাল ভাই। ক্রীড়া বিভাগের কদর তখন আকাশ ছোঁয়া। সবাই আসতো পরামর্শের জন্য। আমরা ফি দাবি করতাম! অন্য সময়ের চেয়ে কাজের চাপ থাকতো দ্বিগুণ। কিন্তু প্রত্যেকটি মুহূর্ত ছিল উপভোগ্য। ওভার টাইমের টাকা পেয়ে সবার থাকতো পকেট ভারী। আশেপাশের হোটেল থেকে খাবার অর্ডার দিয়ে আনা হত। তিন তলার ক্যান্টিনে গিয়ে জমিয়ে চলতো খানাপিনা।

রিপোর্টিং ফ্লোরে টিভি সমস্যা করলে ক্রীড়া বিভাগ চলে যেত তোয়াব খানের রুমে। বিশ্বকাপ তো, তাই আমাদের জন্য ছিল সব জায়গায় ছাড়। ওখানে বসে বসে শুনতাম ফটোগ্রাফার হাজি জহির ভাইয়ের বয়ান। খেলা দেখার সুবিধার জন্য জহির ভাই একটা ইজি চেয়ার কিনে দিতে চেয়েছিলেন তোয়াব ভাইকে। জহির ভাইয়ের প্রস্তাবে তোয়াব খানের সেই বিখ্যাত ঝাড়ি। আমাদের হাসি লুকাতে কষ্ট হত।

পুরো অফিস ভাগ হয়ে যেত ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনায়। এক ম্যাচে ব্রাজিলের জয়ের পরে শিবলি ভাই (আরিফ রহমান) এমন এক ডিগবাজি খেয়েছিলেন, যা এখনও অনেকের মুখে মুখে ফেরে। সদা মুখর বাবু ভাই (আরিফুর রহমান) সারাক্ষণ নিজ প্রিয় দলের সমর্থনে বকবক করতেন। তাকে থামাতে পারতো কেবল একজন। তিনি রাজা ভাই (রেজোয়ানুল হক)। একদিকে মাঠের লড়াই, অন্যদিকে চলতো কথার লড়াই।

স্কুল বয়স থেকে কোন কারণ ছাড়াই কেমন করে যেন ইতালির সমর্থক হয়ে গেলাম। জীবনে আজ্জুরিদের জন্য যত নফল নামাজ পড়েছি, আর কারো জন্য পড়েছি বলে মনে হয় না। রবার্তো ব্যাজিও, দিনো ব্যাজিও, কোস্তাকুর্তা, শিলাচি,বারেসি, আলবার্তিনি, দোনাদুনি, জিয়ানফ্রো জোলা, দেল পিয়ারো, টট্টি, ক্রিশ্চিয়ানো ভিয়েরি, মাতেরাজ্জি, জামব্রোত্তা, পিরলো, গাত্তুসো, ইনজাগি, বুফন, ক্যানাভারো কত প্রিয় সব নাম। মনে হয় কত আপন! একটা বয়সে মনে হতো, এই গ্রহে পাওলো মালদিনির মতো সুদর্শন মানুষ আর কেউ হতে পারে না।

বাজির বাক্স সাজানোর দায়িত্ব থাকতো কাওসার ভাইয়ের (কাওসার রহমান) ওপর। পয়েন্টের হিসাবও রাখতেন তিনি। এজন্য কম কথা শোনানো হতো না তাকে। কাওসার ভাই হাসিমুখে সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা শুনে যেতেন। তবে তাকে সর্বদা রক্ষা করতেন ওবায়েদ ভাই। আর ওনার ওপরই পড়তো বিশ্বকাপ শেষে অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্ব। যেখানে জনকণ্ঠ পরিবারের সদস্যরা সবাই একত্রিত হতো।

ইতালি দলের আরেকজন সমর্থক ছিল তখন জনকণ্ঠ অফিসে। তিনি ফজলুল বারী ভাই। মনে আছে, ২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালি চ্যাম্পিয়ন হবার পরদিন সন্ধ্যায়, অফিসের সবাইকে আমি আর বারী ভাই মিলে মিষ্টি খাইয়েছিলাম। বারী ভাই এখন সিডনিতে। আমি নিউইয়র্কে। সোনার বাংলা ছেড়ে আমরা এখন দূর পরবাসে।

আমেরিকা এবার বিশ্বকাপ খেললেও নিউইয়র্কে প্রকৃত আমেরিকানদের মধ্যে ফুটবল নিয়ে হেলদোল একটু কমই। তবে ইংরেজীভাষী আমেরিকানরা বাস্কেটবল আর বেসবল নিয়ে যতই মাতুক, এখানকার স্প্যানিশ আমেরিকানদের মধ্যে বিশ্বকাপ নিয়ে উত্তেজনা প্রবল। স্প্যানিশ (হিসপানিক) মানে স্পেনের অধিবাসী নয়, এটা জানলাম নিউইয়র্কে এসে।

অবাক হয়ে দেখলাম, এই শহরের অধিকাংশ মানুষই স্প্যানিশ। বিশেষ করে আমরা যেখানে থাকি, সেই জ্যাকসন হাইটসে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী সব দেশই (ব্রাজিল বাদে) স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে। উত্তর আমেরিকা, মধ্য আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে দলে দলে মানুষ প্রতিদিনই সীমান্ত অতিক্রম করে এদেশে আসে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি যাই হোক না কেন, প্রতিবেশীদের জন্য খুব ভালো। অন্তত সীমান্তে দেখামাত্র গুলি করার নির্দেশ নেই। মাঝে মাঝে মনে এটা বুঝি ওদেরই দেশ।

স্প্যানিশ ভাষা নিয়ে আমার একটা স্মৃতি আছে। ঢাকায় যেবার আর্জেন্টিনা দল এলো প্রীতি ম্যাচ খেলতে, তখন নীলক্ষেত থেকে একটা স্প্যানিশ শেখার চটি বই কিনেছিলাম। মনে বড় সাধ ছিল সংবাদ সম্মেলনে লায়নেল মেসিকে স্প্যানিশ ভাষায় একটা প্রশ্ন করবো। আমার সেই সাধের গুঁড়েবালি দিয়ে মেসি কথাই বললো না সংবাদকর্মীদের সঙ্গে। তবে এসেছিলেন আলেসান্দ্রো সাবেয়া। আর্জেন্টিনা দলের কোচ। যিনি এবার বিশ্বকাপেও আর্জেন্টিনার দায়িত্বে।

মেসিকে না পেলেও সাবেয়াকে প্রশ্ন করেছি। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। সাবেয়ার মধ্যে যেন মেসির ছোঁয়া পেয়েছি। আমার প্রশ্ন শুনে সাবেয়া হেসেছে। আর ওই হাসি ছুঁয়ে গেছে সারা মন। হোটেল লবিতে এক হাত দূরত্বে মেসিকে দেখেছি। মনে হয়েছে, মানুষ নয়, স্বয়ং দেবতা বুঝি হেঁটে যাচ্ছেন। মেসিকে বলতে চেয়েছিলাম, ‘ওলা’। স্প্যানিশ এই শব্দটার মানে ‘হ্যালো’। কিন্তু ফুটবল এই যাদুকরকে দেখে এতটাই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছি যে, মুখ থেকে শব্দ বের হয়নি একটাও।

খেলোয়াড়দের নিয়ে সাধারণ মানুষের ক্রেজ বরাবর। পৃথিবীতে কে আছেন একজন ম্যারাডোনার সমান জনপ্রিয়? পেলের চেয়ে বড় সেলিব্রেটি? জিদান কিংবা মালদিনির মতো কোটি মানুষের চোখের মণি!

মেসি, রোনালদো, রোবেন, বেনজেমা, মুলার, সুয়ারেজদের বড় বড় ছবি দেখি এখানকার দোকানগুলিতে। জার্সি, ব্রেসলেট, মালা, ক্যাপ কত কি বিক্রি হচ্ছে! তবে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলিয়ানদের তুলনায় এখানে মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, কোস্টারিকার মানুষ বেশী।

মেক্সিকো যেদিন দ্বিতীয় রাউন্ডের টিকেট নিশ্চিত করল বাক্সটার এভিনিউতে ভুভুজেলা বাজিয়ে, নিজ দেশের পতাকা উড়িয়ে মেক্সিকানদের সেকি উৎসব। যেদিন মেক্সিকো আর কলম্বিয়ার খেলা থাকে, সেদিন চারদিক ছেয়ে যায় সবুজ আর হলুদ জার্সিতে। মেক্সিকোর সবুজ জার্সি আর কলম্বিয়ার হলুদ জার্সি পরতে দেখা যায় বুড়ো-খোকা সবাইকে। বারে, রেস্টুরেন্টে, স্যালুনে, পার্লারে, গ্রোসারি শপে, লন্ড্রোমেটে সবাই ভিড় করে দেখে প্রিয় দলের খেলা।

বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরাও খুশী হয় মেক্সিকো কিংবা কলম্বিয়া জিতলে। যদিও তাদের হৃদয়ে থাকে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা। আসলে মেক্সিকো বা কলম্বিয়া বা ইকুয়েডর যেদিন জয় পায়, তখন বেচা-বিক্রি বেড়ে যায় সব দোকানে।

আমেরিকা যতই এবারের বিশ্বকাপে ‘ইউনাইটেড বাই টিম, ড্রাইভেন বাই প্যাশন’ বলে স্লোগান দিক….শিকড়কে কি এত সহজে ভোলা যায়! তাইতো অস্তিত্বের প্রয়োজনে এই স্প্যানিশরা ঘর ছাড়া হলেও কোনভাবে ভুলতে পারেনি তাদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ফুটবলের প্রতি ভালোবাসাকে। কারণ ফুটবলই তাদের ধর্ম। ফুটবলই ঈশ্বর। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেশী দেশগুলি অর্থে-বিত্তে তেমন সমৃদ্ধ নয়। তবু তারা নিয়মিত বিশ্বকাপে খেলে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মতো র‌্যাংকিংয়ে অনেক ওপরে তাদের অবস্থান নয়, তবে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা কি কম?

ওদের ফুটবল উন্মাদনা দেখি আর মনে মনে ভাবি, পলিমাটির গন্ধ গায়ে নিয়ে লাল-সবুজরা কি কোনদিন পা রাখবে বিশ্বকাপের বন্দরে? নাকি যুগ যুগ ধরে আমরা শুধু গলা ফাটাবো ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার জন্য?

মনিজা রহমান: লেখক, ক্রীড়া সাংবাদিক।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.