উইমেন চ্যাপ্টার: অদ্বিতীয়ার গল্প – ১।
বাংলাদেশের আর দশটা মফস্বল শহরের মতনই এক ছোট শহরে অদ্বিতীয়ার জন্ম, বেড়ে ওঠা। ছোট হলেও অদ্বিতীয়াদের শহরটির সুনাম আছে নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের জন্য। পড়ালেখায়, কবিতা আবৃত্তি, নাটক সব কিছুতেই অদ্বিতীয়ার জ্বলজ্বলে উপস্থিতি। পরিবারেও রয়েছে পড়ালেখার আবহ। বাবা মা দুজনেই উচ্চ শিক্ষিত উদার সংস্কৃতিমনা।
অদ্বিতীয়া স্বপ্ন দেখে সে হবে কূটনীতিক, ঘুরে বেড়াবে দেশে বিদেশে, উঁচু করবে দেশের নাম, মান। হঠাৎই স্বপ্ন ভঙ্গ হলো আকাশ থেকে বিনা মেঘে বাজ পড়ায়। পরিবারের মধ্যমনি বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে বিনা নোটিশে। শুরু হলো আরেক জীবন। মধ্যবিত্ত সরকারী চাকুরে বাবা তেমন কোনও সঞ্চয় রেখে যেতে পারেননি। বাবা-বিহীন মা দিকশূন্য হয়ে পড়লেন। তবু চালিয়ে নিচ্ছিলেন দিন। ছেলে মেয়েরা বড় হচ্ছে। উঁচু ক্লাসে উঠছে, পড়ালেখার খরচ বাড়ছে। আর কন্যা সন্তান যেন লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে লাউয়ের চারার মতন।
অদ্বিতীয়া পরিবারের বড় সন্তান, মামা চাচারা সিদ্ধান্ত নিলেন বয়স হয়েছে ১৬, অতএব তাকে বিয়ে দেয়া যায়। বাংলাদেশের মেয়েদের সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে অদ্বিতীয়া সুন্দরীর দলেই পড়ে। রূপের পাল্লা ভারী হওয়াতে রুপো বিহীন পরিবারের পিতৃহীন কন্যারও বিবাহ প্রস্তাব আসতে শুরু করেছিল। অদ্বিতীয়ার বিয়ে হয়ে গেল বা বলা চলে তাকে বিয়ে দেয়া হল। কোরবানির পশুর মতন আছড়ে পিছরে কেঁদেও কোনও লাভ হলো না। বোঝানো হল তাকে, এই বিয়েটা শুধু তার একার ভালো নয়, পরিবারের জন্য অনেক ভালো করবে। তার স্বামী তার মায়ের ছেলের ভূমিকা নেবে। পরিবারের একজন পুরুষ অভিভাবক হবে। তবে এগুলোর চাইতেও যা তাকে একটু প্রবোধ দিতে পেরেছিল তা হলো ছেলেটি যেহেতু উচ্চশিক্ষিত, কাজেই অদ্বিতীয়ার পড়ালেখায় কোনও সমস্যা হবে না। সে তার ইচ্ছেমত পড়তে পারবে। বয়স দুই বছর বাড়িয়ে সেই বিয়ে রেজিস্ট্রিও করা হল।
শুরু হলো অদ্বিতীয়ার নুতন জীবন। ১৫ বছরের বড় স্বামী তাকে ভালই বাসতেন। বা বলা চলে, স্নেহ করতেন। শাসনও ছিল। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। শাসন তো একটু করতেই হতো, অদ্বিতীয়া বেয়ারা ছিল যে, মাসুদ রানা পড়তো, কবিতার পাগল, রাস্তা দিয়ে মিছিল গেলে সব কাজ ফেলে দৌড়ে যাওয়া চাই তার, বাড়িতে খবরের কাগজ আসার সাথে সাথে হুমড়ি খেয়ে পড়া, কিছুই রাঁধতে না পারা এবং শেখারও কোনও আগ্রহও নাই। ধর্মীয় বিষয়ে কোনও আগ্রহতো নাই-ই, উল্টে বরং তর্ক করা। পাড়ার ছেলেদের সাথে কথা বলা ইত্যাদি বিয়ে হয়ে যাওয়া মেয়ের এসব তো ভালো চরিত্রের লক্ষণ নয়। হাঁপিয়ে উঠছিল সে, আরও বেশী হাঁপিয়ে উঠছিলেন স্বামী।
অতএব মোক্ষম সমাধান- সন্তান এলে পেটে, বয়স তখন ১৭ পেরিয়েছে মাত্র। সামনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা। দুঃসহ সেইসব দিন মনে হলে এখনো বুকের ভিতরে কেঁপে উঠে অদ্বিতীয়ার। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়ই পরীক্ষা দিলো সে, পরীক্ষার ফল অদ্বিতীয়ার মেধা অনুযায়ী আশানুরূপ না হলেও প্রথম সারিতেই রইলো তার নাম। জীবনের চলা থামছে না। ছেলে এলো তার জীবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত তৃতীয় স্থান পেলো সে। ভর্তি পরীক্ষার ফরমটি শেষ দিনে তার এক আত্মীয় হাতে হাতে জমা করেছিলেন, নয়ত নানাবিধ জটিলতায় তার ভর্তি পরীক্ষাও দেয়া হতো না। ভর্তি হল সে প্রথম সারির একটি বিষয়ে। ক্লাস করলো এক বছর। প্রায়ই ক্লাস করতে পারতো না। কোলে দুধের শিশু। স্বামী ক্লাসে যেতে সরাসরি মানা করতেন।
বলতেন, এতো পড়ে কি দরকার, বিএ পাস করলেই তো হয়। মা আর বোন সাহায্য করতেন। প্রথম বছরের পরীক্ষায় সে প্রথম শ্রেণীর নম্বর পেলো। এরই মধ্যে স্বামীর অসুস্থতা এবং অনেকদিন দেশের বাইরে থাকতে হলো তাকে স্বামীর চিকিৎসার কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতা থেকে নাম কাটা গেল তার। স্বামী কিছুটা সুস্থ হয়ে দেশে ফিরলেন, কিন্তু অদ্বিতীয়ার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরা হলো না।
এদিকে রোগমুক্তি কিছুটা ঘটলেও স্বামী হারালেন যৌনক্ষমতা। অদ্বিতীয়ার কারাজীবন শুরু হলো। কোনও পুরুষ মানুষের সাথে কথা বলা নিষেধ। নিজের মামার পাশে বসে কথা বলার জন্য বেধড়ক পিটুনি খেলো সে একদিন। বাসার ফোনে তালা। স্বামী বাইরে যাওয়ার সময় বাইরের দরজায় তালা লাগিয়ে যেতেন। ফোনের তালা খোলার পদ্ধতি বের করে ফেললো অদ্বিতীয়া, চুলের ক্লিপের একটা দিক ঢুকিয়ে মোচড় দিলেই ফোনের তালা খোলা যায়, হাতে গোনা তিন জন স্কুলের বন্ধুর সাথে তখনো যোগাযোগ ছিল, ওদের সাথেই কথা বলা। ঘরের তালা খোলার পদ্ধতিও বের করে ফেললো অদ্বিতীয়া।
স্বামী অফিসে যাওয়ার একটু পড়েই সে ছেলেকে নিয়ে বের হয়ে রিকশা করে ঘুরে বেড়াতো। নিজের হাতে টাকা না থাকায় একটি সোনার চেইন বিক্রি করে দিলো সে মা-ছেলের এই গোপন অভিযানের রসদ জোগাতে। নিউ মার্কেটের বইয়ের দোকানে ঘোরাঘুরি করতো মা ছেলেতে, হেঁটে বেড়াতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে – যেখানে সে তার স্বপ্নের ডিগ্রী নিতে পারে নাই। অবুঝ ছেলেকে বলত, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেকে পড়তে হবে। কিছুদিন পরে টের পাওয়ার পরে স্বামীর সেই রুদ্রমূর্তি এবং নির্মম প্রহার আজো মনের গহীনে রয়ে গেছে। মাঝে মাঝে ভাবে, এতো দুঃসাহস কেন করতো সে? কেন ওইরকম পাগলামি করতো বাইরে বের হওয়ার জন্য! যা করতে না করা হতো তাই-ই কেন সে করতে চাইতো? তার ওইসব বেয়াড়া কাজ-কারবারে তার স্বামী উত্ত্যক্ত হয়ে উঠতেন, আর সেও চাইতো যেন স্বামীকে অস্থির করে তুলতে এইসব আচরণে। উত্তর পায় না আজো।
এরই মধ্যে এক কলেজ থেকে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণী পেলো সে বিএ পরীক্ষায়। স্বামী আবার অসুস্থ। চিকিৎসার জন্য এবার প্রতিবেশী দেশ। ডাক্তার জানালেন অনেকদিন থাকতে হবে। হাসপাতালে ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ শুরু করলো সে। ভলান্টিয়ারের কাজের সূত্রে পরিচিতি হওয়া একজন ডাক্তারের পরামর্শে সে গিয়ে ভর্তি হল নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবই স্বামীকে লুকিয়ে। স্বামী জানার পরও জেদী অদ্বিতীয়াকে দমাতে পারলেন না। ঘাড় গুঁজে মার খেত, সে কিন্তু পড়া ছাড়ত না। মাঝে মাঝে ভাবে সে এখন, জেদটা একটু কম হলে হয়তো জীবনে মারপিটের পর্বটা কমানো যেত। প্রায় দু বছর। স্বামী শেষ পর্যন্ত রোগের সাথে যুদ্ধ করতে করতে হেরে গেলেন। অদ্বিতীয়ার ছেলের বয়স তখন চার বছর। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, চেনা পরিচিতরা অদ্বিতীয়ার এই পোড়া কপালের আহাজারিতে ব্যস্ত। কিন্তু অদ্বিতীয়া?
নিজের কাছেও মানুষ অনেক সময় সত্যি স্বীকার করতে চায় না, অদ্বিতীয়া যেন মুক্তির নিঃশ্বাস ফেললো। কাউকে বুঝতে দিলো না কিন্তু মুক্তির আনন্দে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও তাকে বেশী চিন্তায় ফেললো না। কিন্তু তার পড়া? অদ্বিতীয়া আবার গেল ভারতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপনী পরীক্ষা তাকে দিতেই হবে। তার এক নিঃসন্তান কাকা যিনি অদ্বিতীয়াকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন বহুবার, সেই কাকা নিয়ে গিয়ে রেখে এলেন তাকে। ছেলে রইল মায়ের কাছে। পরীক্ষা শেষে প্রায় চার মাসের মাথায় অদ্বিতীয়া ফেরত এলো দেশে। ভয় করতো না অদ্বিতীয়ার? ভয় করতো তার ভীষণ রকম। কিন্তু এটাও সে জানতো, হেরে গেলে চলবে না। নিজের ভাগ্য নিজেই লিখবে সে।
দেশে ফিরে অদ্বিতীয়া চাকরী পেলো একটি কর্পোরেট অফিসে। জুনিয়র জন সংযোগ কর্মকর্তা। চাকরিটি মোটামুটি তার মেধার জোরেই হলো, তবে একটু তদবিরও লাগলো। এই তদবিরের প্রক্রিয়াটিতে তার অকাল বৈধব্যের বিষয়টিকে করুণার চোখে দেখা হলো। যা অদ্বিতীয়ার মনে কাঁটার মতন বিঁধে গেল এবং পরবর্তীতে সে শুধুই নিজের যোগ্যতায় একটি চাকরি জোগাড়ের ব্যাপারে মনস্থির করে ফেললো। শুরু করলো বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি।
নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে তেইশ বছর বয়সে ১৫০০ টাকার একটি চাকরি, ৪ বছর বয়সের ছেলে নিয়ে শুরু হল অদ্বিতীয়ার একাকী জীবন। (চলবে)