সুপ্রীতি ধর:
অবকাশ যাপন কেন্দ্র থেকে ফিরে মনের ভেতরটা একেবারে শূন্য হয়ে গেল আমার। হোস্টেল বলতে প্রায় খালি। অনেকেই যার যার নির্ধারিত শহরে চলে গেছে। নাসির আগেই গিয়েছিল মস্কো। তার বড় ভাই জসীম ভাই থাকেন মস্কোতে। ওর আর চিন্তা কী! সবজায়গাতেই বড় ভাই, বাবা-কাকার দাপট তো আছেই, সেইসাথে আছে পার্টির দাপট। আমি এসেছি মৈত্রী সমিতির পক্ষ থেকে। মান্নান ভাই আমাকে পাঠাতেই চাননি, এখন শহর বদলের তদবির করবেন তিনি?
যাকগে, মন খারাপের আরও কারণ হচ্ছে বাংলায় কথা বলার জন্য একটি কাকপক্ষীও নেই। থাকতে হবে আরও পনের দিনের মতোন। পাকিস্তানি মেয়েদের সাথে মিলে সিনেমা দেখি, মার্কেটে ঘুরি, কিছু শপিং করি। বেড়াতে যাওয়া আর হচ্ছে না। মাহবুব ভাই দেশে চলে গেছেন। সুতরাং সপ্তাহান্তের দাওয়াত-পার্টিও নাই।
তার যাওয়ার দিনটা ছিল টক-মিষ্টি-ঝালের মতোন। ওলগা নামের একজন মাঝবয়সী নারী আর তার মা মাহবুব ভাইকে আদর করে ‘মাবু’ বলে ডাকতেন। তো তাদের মাবু দেশে যাবে বলে সেই কবে থেকেই কেনাকাটা শুরু করেছেন তারা। বস্তুত মাহবুব ভাইকে নিজে থেকে কিছুই কিনতে হয়নি। দুনিয়ার হাবিজাবি কিনে এনে হাজির। আমরা সবাই মিলে স্যুটকেস গোছাই। এয়ারপোর্টে যেদি গেলাম, ওলগাও গেল। তার দুচোখ বেয়ে তখন অশ্রুধারা বইছে। কখনও ফুঁপিয়ে, কখনও জোরে জোরে। সে জেনে গেছে, মাহবুব ভাই দেশ থেকে ফিরে তিবিলিসিতে চলে যাবেন।
মাহবুব ভাই বলছিলেন, একটা বছর দুজন বাঙালীর মাঝে থেকে আর একা থাকা সম্ভব না। তাই তিনিও শহর পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছিলেন। তার আবেদন মেনে নিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। তবে আমি নিশ্চিত, ওলগার সাথে দেখা হোক আর না হোক, আমার সাথে এভাবে আরও কখনই দেখা হবে না, এই শেষ দেখা। তারপরে যদিও বা দেখা হবে, বা হয়েছে, সেই দেখায় ভিন্নতা ছিল অনেক। আজ স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে মাহবুব ভায়ের সাথে আমার একটা ভালবাসার সম্পর্কই গড়ে উঠেছিল ওই নয় মাসে। তাই তার দেশে চলে যাওয়ার পর আমি ঘরে ফিরে চিৎকার করে কেঁদেছিলাম সেদিন।
এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে হোস্টেলের রুমে ঢুকতে পারছিলাম না। খুব একা লাগছিল। কোথায় যাওয়া যায়? গ্রীষ্মকাল বলে গরম জল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাই বলে ভাববেন না, ঠাণ্ডা জলে স্নান করা সম্ভব, হাড় কনকনে ঠাণ্ডা জল মুখে লাগানোই মুশকিল। প্রতিদিন বাসে করে বানিয়া’ বা স্নানঘরে গিয়ে স্নান করাও আলসেমি লাগে। মাঝে মাঝে কাপড় ধোয়ার বড় পাত্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে কোনরকমে একটু জল ঢেলে কাকস্নান সেরে নেই। তবুও যাই না দূরে। হোস্টেলের ক্যান্টিন বন্ধ, ছাত্ররা নেই। নিজের রান্না করা ছাড়া কোন উপায় নেই। হঠাৎ করেই জীবনটা যে এমন কঠিন হয়ে পড়বে কে জানতো! এমন বিদেশে একেবারে একা। ভাগ্যিস পাকিস্তানি মেয়েগুলো ছিল। আমি নিলাম বাজারের দায়িত্ব, আর ওরা রান্নার। তাতে করে ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়ে যাচ্ছিল কোনরকমে।
ভাবছিলাম, কবে আবার যাত্রা শুরু হবে নতুনের পথে। লেনিনগ্রাদ। ছোটবেলা থেকে গল্পের বইয়ে পড়েছি শহরটির কথা। নেভস্কি প্রসপেক্ট, কাজানস্কি সাবোর, পেত্রো-পাভলভস্কি ক্রেপোস্ত, জিমনি দভারেৎস, বিশ্বখ্যাত মিউজিয়াম হেরমিটেজ, এসবই মনে ছবির মতো স্পষ্ট আঁকা আছে। বিশেষ করে আন্না কারেনিনার সুবাদে লেনিনগ্রাদ আরও বেশি চেনা। এতোদিন আরমেনিয়াকে খুব একটা বিদেশ মনে হয়নি। চুল সবার কালো, মনের দিক থেকে অনেকটাই আমাদের মতোন রক্ষণশীল সমাজ। কিন্তু এখন যাচ্ছি ইউরোপে, ওপেন একটা সোসাইটিতে। ভাল-মন্দ মিশ্র অনুভূতি নিয়ে আমার নতুন জীবনের যাত্রা শুরুর অপেক্ষায় আমি তখন।
এদিকে গত নয় মাসে এখানে টাকাও জমেছে হাতে। খরচ করার কিছু নেই। সবই এমন সস্তা যে, অনেক কিনে, অনেক খেয়েও শেষ হয় না। গুণে দেখলাম ৪৫২ রুবল আমার হাতে। মাসে মাসে পেয়েছি ৮০ রুবল করে। সবচেয়ে বেশি খরচ ছিল মাসে ৩০ রুবল। সুতরাং তিনদিনের ট্রেন যাত্রাটাকে আমি একটু বিলাসী করতেই পারি। বেছে নিলাম, প্লেনে করে যাবো। সেই কবে প্লেনে উঠেছিলাম দেশ থেকে আসার সময়। আর এবার। এখানকার পাতানো বোন আরমিনে আর তার মা এসে আমার ব্যাগ ভরে জামা-কাপড়-জুতা দিয়ে গেল, বিনিময়ে আমি রেখে গেলাম শুধুই ভালবাসা আর সাকুরা থেকে কিনে নেয়া সাপের চামড়ার ব্যাগ, সাথে একগুচ্ছ বাংলাদেশি নতুন টাকার নোট ও কয়েন। ওরা তখন সেগুলোকেই সযত্নে রেখে দেয় অমূল্য উপহার হিসেবে। এমন ধন ওরা পাবে কোথায়!
৫২ রুবল দিয়ে তিন ঘন্টার প্লেন জার্নি। গাধামিটা ঘটালাম যে বড় কাউকে জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করলাম না, লেনিনগ্রাদে আমি কোথায় যাচ্ছি! যেহেতু প্লেনে যাবো, কেউ আমাকে নিতে আসবে না। ট্রেনে গেলে ইউনিভার্সিটি থেকে লোক থাকতো, হোস্টেল থাকতো। এসব কিছুই জিজ্ঞাসা না করে, মস্কোর সাথেও যোগাযোগ না করে রওনা দিলাম আমি। প্লেনে করে যাচ্ছি একা একা, ভাবসাবই আলাদা আমার। কিন্তু কপালে যে কি লেখা ছিল তা যদি জানতাম?
আমার সাথে চিলির গ্রুপটা গেল ট্রেনে। আর আমি এবং ইথিওপিয়ার একজন প্লেনে। বিমানে চড়ার পর মাথায় এলো আমার কাছে লেনিনগ্রাদের কারও কোন ঠিকানা নেই। শুনেছি ওখানে ৪৫ জনের মতোন বাঙালী আছে। কিন্তু তারা কোথায়? লেনিনগ্রাদ কি ছোট একটা শহর? আমি হিসাব করে দেখলাম, পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে যাবে। তাহলে? এতোক্ষণে মাথায় দু:শ্চিন্তা এসে ভিড় করতে লাগলো। ওপর থেকে দেখা সব সৌন্দর্য তখন মাটি হতে সময় লাগলো না। তবে ইথিওপিয়ার ছেলেটি অভয় দিল, সে একটা হোস্টেলের ঠিকানায় যাচ্ছে, কেউ না কেউ থাকবেই সেখানে আমাকে জায়গা দিতে।
ওর কথা ব্যর্থ হয়নি। ইউনিভার্সিটিরই একটা হোস্টেলে উঠেছি ট্যাক্সি ভাড়া করে এসে। সেই ছেলেটিকে দেখলাম বেশ কজন তাদের দেশি এসে একেবারে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেল। ও তখন আমার বিষয়টা বোঝাতেই অন্যরা জানালো, এই হোস্টেলেও একজন বাংলাদেশি থাকে। তবে উনি এই মূহূর্তে নেই। কিন্তু সমস্যা নেই। শ্রীলংকার একটি মেয়ের রুমে আমার সাময়িক জায়গা ওরাই করে দিল। কী আশ্চর্য! চিনি না, জানি না, দিব্যি জায়গা পেয়ে গেলাম।
সিনিয়র এক ভাই থাকতেন ওই হোস্টেলে। নাম আসাদ। তিনি এলেন রাত করে। ভেবেছিলাম আমাদের বয়সীই কেউ হবে। না, উনি এখানে পিএইচডি করতে এসেছেন। দেশে থাকতে চাকরি করতেন। বেশ ভারী ভারী একখান চেহারা। কেমন যেন রাগী একটা ভাব। আমার মতোন এমন চপল কিশোরীর সাথে কথাই হয়ে উঠে না। বিষয় নেই কথা বলার। তবে এই ফাঁকেই উনি বললেন, এখান তার ভালো লাগছে না। ভুল ধারণা নিয়ে এই দেশে এসেছিলেন। আর আমি তখন এইসব ধারণা-টারনার ঊর্ধ্বে।
তবে ধারণা তার যাই হোক রাতে রান্না করে খাওয়াতে ভুললেন না। পরদিন আমাকে এখানকার বাঙালীদের কাছে নিয়ে যাবেন, হোস্টেলে নিয়ে যাবেন আমার, সেই প্রতিশ্রুতিও দিলেন। এমনটিও বললেন যে, আমার হোস্টেলটি আন্তর্জাতিক মানের, খুবই সুন্দর। এই কথা শুনে মনের আনন্দে খেয়ে-দেয়ে শ্রীলংকান ওই মেয়ের রুমে ঘুমাতে চলে গেলাম। পরদিন একটা নতুন দিন হবে আমার, এই অপেক্ষায় ঘুম হলো অনেকদিন পর।
আমি এখন লেনিনগ্রাদে। পেত্রোগ্রাদ, পিটারবুর্গ কত নামেই না ডাকা হয়েছে এই শহরকে। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, দস্তয়েভস্কির শহর লেনিনগ্রাদ। মহান রুশ বিপ্লবের শহর এই লেনিনগ্রাদ। অবশেষে আমি সেই শহরে। কী যে ভাল লাগছে!
(চলবে)