ফর্সা মেয়ের গল্প

mourn picঅপরাহ্ন সুসমিতো`<div><b>অপরাহ্ণ সুসমিতো`র ছোটগল্প : ফর্সা মেয়ের গল্প</b></div><div><br></div>

আমার মা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারে না । বলি;
: মা বলো তো প্রথম
আমার মা বলেন;
: পেরথম
আবার বলি
<div><b>অপরাহ্ণ সুসমিতো`র ছোটগল্প : ফর্সা মেয়ের গল্প</b></div><div><br></div>
:বলো তো প্রফেসর
: পরবেসার
: বলো তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়
তখন মা লাঠি নিয়ে তেড়ে আসেন । আমি ঘরময় দৌঁড়াই,মা তার মটু শরীর নিয়ে আমার সাথে দৌঁড়ে কুলাতে পারেন না । হার মানেন,হাঁপাতে হাঁপাতে গজগজ করেন ।
: মাইয়া,তোরে লেহাপড়া শিখাইছি আমি । আমারে শিক্ষিত বানাবি ?
তাপ্পর চুপ করে সোফাতে বসে পড়েন । আমি পালানো অবস্থায় অন্য ঘর থেকে উঁকি মেরে মাকে আবডালে দেখি । আমার মাটা মোটাসোটা । খুব অল্প পড়াশোনা করা মানুষ ।
আমি আবার মায়ের একদম অপোজিট । ফর্সা । আর বাংলাদেশে মেয়ের গায়ের রং ফর্সা মানেই সে সুন্দর । তার চাহিদা ব্যারোমিটারের মতো বাড়তে থাকে । এসএসসি পাশের পর থেকেই আমার বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে । অধিকাংশ পাত্র সেনাবাহিনীর । বাসার সবাই রাজী হয়ে যায় একেকবার প্রস্তাব আসা মাত্র কিন্তু আমার এই সুইট মা`টা বিয়ে দিতে রাজী হন না । তার ভাষ্য;
: মেয়ে আমার পরবেসার (প্রফেসর) হইবে,তারপর বিয়া । এত ছোডো বয়সে বিয়া কিসের ? 
অবাক হয়ে যেতাম মা`র কথা শুনে । রাগ হয় আমার । পড়তে ইচ্ছা করে না,সংসার করতে ইচ্ছা করে । সিনেমায় দেখা মেয়েদের মতো শাড়ি পরে ঘরময় ঘুরে বেড়াব,পিছনে ঘুরঘুর করবে দাসী । বর ঘরে ফিরলে তাকে খেতে দিব,খাবার পর দুজনে নতুন মুক্তি পাওয়া সিনেমা নিয়ে এক্কা দোক্কা খেলব । গরমের দিনে তার ঘামাচিতে পাউডার মাখিয়ে দিব । তারপর দেশে সামরিক শাসন হলে আমি চুড়িদার দোপাট্টা পরে জলপাই রঙের জীপ গাড়ির সামনে বসব । আমার বর ছোট ছোট চুলে সানগ্লাস পরে গম্ভীর হয়ে বলবে;
: মেজর হলে বিডিআরে ডেপুটেশনে যাব ।
শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আবার বর আইভরি কোস্টে চলে গেলে আমি একাএকা ওর বিরহে বিলীন হবো ।
বিয়ের চতুর্থমাস থেকেই বরের সাথে আমার বনিবনা বন্ধ হয়ে যায় । মনের সেভিংস একাউন্টে জমানো স্বপ্নগুলো চুরচুর করে ভাঙ্গতে থাকে । টের পাই আমার বর সানগ্লাস পরা আস্ত একটা ছোটলোক ।
আমার সবকিছুতেই তিনি খুঁত আবিস্কার করতে থাকেন । সবচেয়ে অদ্ভুত খোঁচাটা তিনি দেন যে আমাদের বাসার সবাই কালো বা শ্যামলা,আমি কেন এত ফর্সা হলাম ?
কী আশ্চর্য ! আমি তা কি করে বলব ?
বাচ্চারা যেমন স্বরে অ স্বরে আ দিয়ে বর্ণমালা শেখে,তেমনি বর্বর বর আমাকে শুরু করলেন মৃদু চড় থাপ্পড় দিয়ে । আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে উঁচু শ্রেনীতে ওঠার মতো করে । অপমানে লজ্জায় চোখের পানি ছিটকে আসে । এ আমি কোন জলপাই বনে এলাম মা গো !
সবাই বোঝায় ছেলেরা একটু বদমেজাজের হয়ই,এডজাস্ট করো । এডজাস্ট করো । তোমার বরের ভবিষ্যত ভালো । বলা যায় না দেশে সামরিক শাসন হলে তুমি তো রাজরানি ।
মায়ের কাছে এলেই আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যেত । মা কেন যেন আমাকে বুঝতে পারতেন । আমাদের বাসায় এলেই মা`র কাছে হুড়মুড় করে কাঁদতাম । মা বলত:
: আমি শিক্ষিত না,তোর বাপে আমার কথা হোনে নাই । মুই তো চাইছিলাম তুই এম এ পাশ কর । এই তোরে কি এ খাকি বেশি মারে ?
জলের গানের মতো আমি হাউমাউ কাঁদি । মা আমাকে নিয়ে আস । আমি তোমার সাথে থাকি ।
বিকেলের রোদ বাবু বাবু করে হানাহানি ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার বাড়ি ফিরতে শুরু করে । বাবার পিঠে আমার সদৃশ এক অদৃশ্য কুঁজ দেখতে পাই,বুঝতে পারি আমাকে নিয়ে টেনশন তার । ভাইয়েরা ক্রমাগত চাপা বিরক্ত আমার ইস্যুতে । 
আমাকে নিয়ে বাসায় বেশ কয়েকবার সর্বদলীয় পরিষদ আলোচনার আয়োজন হয়েছিল । বর আমার নির্দলীয় পরিষদ সভার দাবীতে মিটিং এ আসেননি ।
মায়ের গা ঘেঁষে আমি অনিশ্চিত জীবনের দিকচক্রবাল রেখার সন্ধান করি,চোখে নামে করুণ সকাতর ভয় । মা আমার এলো চুলে হাত বুলাতে থাকে । আমি মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করেই ফেলি অক্ষম যন্ত্রণায়;
: ও মা মা আমি এতো ফর্সা কেন ?
মা চমকে ওঠেন । 
সন্ধ্যাটা তখনি নেমে এলো বৈরাগ্যে আমাদের বাসার দেরাজে,কার্নিশে । আজকের যাপন সন্ধ্যা একদম অন্যরকম ।
আমার মোটা,অশিক্ষিত,শ্যামলা মা`টা কাঁদছে …
শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.