চন্দ্রমুখীর সঙ্গে তন্বির বসবাস…

Chandromukhiআঙ্গুর নাহার মন্টি: পুনর্জন্ম। এই শব্দটা ক’দিন ধরেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।পুনর্জন্ম বলে সত্যিই কি কিছু আছে? যদি থাকে ঈশ্বর, তুমি আমার প্রিয় বন্ধু নাজনীন আখতার তন্বি’র চন্দ্রমুখীকে আবার ওর কোলে ফিরিয়ে দাও। চন্দ্রমুখী ঐ দূর আকাশে তারা হয়ে চলে গেছে প্রায় নয় মাস। এই সময়ে চন্দ্রহারা ছোট্ট পৃথিবীতে হাহাকার আর শোক কমেনি এতটুকুও। সাংবাদিক দম্পতি রকিবুল ইসলাম মুকুল ও তন্বি’র সংসারের সর্বত্রই ওদের প্রাণপাখি চন্দ্রমুখী বিরাজ করছে। চন্দ্রমুখী চলে যাওয়ার পর নেয়া ছোট্ট ফ্ল্যাটটা একইরকমভাবে সাজানো হয়েছে পাখিটার ছবি ও খেলনায়। এই ফ্ল্যাটে তন্বি যেন চন্দ্রমুখীর সঙ্গেই বসবাস করছে। মেয়ের একটুকু পরশ পেতে মুকুলের হাহাকার তো ফেসবুকের স্ট্যাটাসগুলোতেই প্রতীয়মান।

গত সপ্তাহে দিল্লি থেকে এসেছেন সুভাষ চন্দ বাদল’দা। এসেই বললেন, গতবার নাজনীনকে দেখে যেতে পারিনি। খুব খারাপ লেগেছে। আমাকে নিয়ে চলো। আমিও যেন এমন সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। তন্বিকে আমি প্রতি মুহুর্তে মিস করি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ওর কাছে যাওয়া হয় না। মাঝে মাঝে ফোনে খোজঁ নিই এটুকুই। মন পোড়ে খুব, মন ভরে না ফোনে কথা বলে। তাই দাদা বলামাত্রই আমার মেয়ে তোড়া আর আমি রেডি হলাম। মুকুলের কাছ থেকে ঠিকানা নেয়া ছিল, গেলাম ওদের (মুকুল ও তন্বি’র) নতুন বাসায়। মুকুলই দরজা খুলে দিল। দাদাকে ড্রয়িংরুমে বসিয়ে তোড়াকে নিয়ে তন্বির কাছে গেলাম। বিছানায় শুয়ে আছে তন্বি। তোড়াকে দেখে চোখে-মুখে যেন একসঙ্গে আনন্দ-বেদনা-বিষাদের বিদ্যুৎ খেলে গেল। অনেক কষ্টে সামলে নিল নিজেকে। ওর জানপাখিটার ডোরা আপু (আমার মেয়েকে চন্দ্রমুখী ডোরা আপু ডাকতো) এসেছে। তোড়া ওর মাথার কাছে ও আমি পায়ের কাছে বসি। হাত বাড়িয়ে ছুয়েঁ দেখে তোড়াকে। তিনজনই চুপচাপ। আমি তোড়াকে কিছুই বলিনি। খালামনিকে চন্দ্রমুখীর কথা বলা যাবে না ও নিজে থেকেই বুঝে গেছে। নিরবতা ভেঙে বলি, বাদল’দা এসেছেন তোমাকে দেখতে। নড়ে উঠে তন্বি। মুকুলকে ডাকে। খালাম্মাকে (ওর মা) খবর দিতে বলে। সপ্তাহে এই একটি দিন মুকুল বাসায় থাকে বলে দিনের বেলায় খালাম্মা পাশের গলিতে নিজের বাসায় যান।

মুকুল জানায়, রাতে ঘুমায় না। খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো করে না। তন্বি বলে চলে, মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে বলেতে হাঁপিয়ে যাই। সারারাত ওর সঙ্গে কথা বলতে হয়। ঘুমাবো কিভাবে বলো? নিজের কোলের কাছে জায়গাটুকু দেখিয়ে বলে, এখানে ওর জন্য জায়গা রেখে দিই। সবাই চলে গেলেই ও আসে। কত্তো কথা যে বলে মেয়েটা। মেয়েটা একা একা ভীষণ ভয় পায়। আমাকে ছাড়া থাকতেই পারে না।

তোড়ার হাতটা ধরে বলে, ডোরা আপুকে খুব ভালবাসতো। আমেরিকা ওর খুব পছন্দ। দেশে ফিরে আসতে চায়নি। আমেরিকায় হলুদ বাসে স্কুলে যেতে চেয়েছিল।

এরইমধ্যে বাদল’দা রুমে আসেন। তন্বি বলেই চলে, ছয়তলা থেকে পড়েও মানুষ বাঁচে! কতো মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি কেন যে বেঁচে আছি। মুকুল পাশে বসা ছিল। ওর মুখের দিকে তাকাতে পারিনা। বুঝতে পারছি তন্বির এমন আহাজারিতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। তন্বিকে বলি, মুকুলের কি হবে তুমি মরে গেলে? ম্লান হেসে তন্বি বলে, ও ছেলে মানুষ!

তন্বি একটু থেমে জানতে চায়, আচ্ছা মুসলমানদের মধ্যে কি পুনর্জন্ম হয়? বাদল’দা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যান, বুঝতে পারেন না কি বলবেন। আমি নিজের অজান্তেই আমার সম্পূর্ণ অজানা বিষয়ে অবলীলায় বলি, পুনর্জন্ম হয়! হয়তো পুনর্জন্ম। তুমি সুস্থ হয়ে উঠো। ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করো। স্বাভাবিক হও। দেখবে, চন্দ্রমুখী আবার তোমার কোলে জন্ম নেবে।

সত্য-মিথ্যা না জেনে তন্বিকে হরহরিয়ে বলে আসা কথাগুলো মাথা থেকে সরছে না। পুনর্জন্ম হয় কি হয় না আমার জানা নেই। তবুও বারবারই মনে হচ্ছে, চন্দ্রমুখী মুকুল-তন্বির কোল আলো করে আবার ফিরে আসলে আগের মতো হেসে খেলে উঠতো ওদের সাজানো বাগানটা।

কথায় কথায় মুকুলের কাছে জানতে পারি, তন্বির ডান হাতটি নাকি জোড়া লাগেনি। গুড়ো হয়ে যাওয়া কনুইটা কয়েকমাস খাঁচাবন্দী রেখেও জোড়া লাগানো যায়নি। কনুই প্রতিস্থাপন নাকি সিঙ্গাপুর ও ভারতে হয়। তবে বিশাল অংকের খরচ। বাদল’দা সবশুনে বলেন, তিনি দিল্লি ফিরে এব্যাপারে খোঁজ নিবেন। ৬০/৭০ লাখ টাকা খরচ শুনে কেমন জানি অসহায় লাগে। এতো টাকা কোথা হতে যোগাড় করবে মুকুল। তাহলে কি তন্বির চিকিৎসা হবে না?

তন্বিটা একটা পাক্কা সাংবাদিক। জগৎ সংসারের সব খবরই সে রাখে। নারায়নগঞ্জের সাত খুন থেকে শুরু করে ভারতের নির্বাচনের খবরও আলোচনা করে সে। শুধু চন্দ্রমুখী নেই কথাটা মানে না, বলে না, বলতে চায়ও না। অন্য কেউ বললেও মুখ ঘুরিয়ে রাখে। নিজের অজান্তে দু’একবার অতীত কালে রেখে কথা বললেও চন্দ্রমুখী ওর পুরো বর্তমান জুড়ে। ওরসঙ্গে কাটানো কয়েক ঘন্টায় এই আমিই ভুলে যাই আইসিইউতে শেষবার দেখা নিথড় চন্দ্রমুখীকে। তন্বি’র বর্ণনায় আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে, মুকুল-তন্বির ঘরময় দৌড়ে বেড়ানো ছোট্ট চন্দ্রমুখী। ও হাসছে, খেলছে। চটপটে ভঙ্গিতে সব্বাইকে বলছে, আমি ডোরা আপুর সাথে দুইটা প্লেনে চড়ে আবার আমেরিকা যাব।

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.