
লীনা হাসিনা হক: আজ বাবা দিবস। বাবার উপস্থিতি আমাদের জীবন থেকে নাই হয়ে গেছে আজ থেকে ৩০ বছরেরও বেশী সময়। আমার সবচেয়ে ছোট ভাইয়ের কাছে বাবার স্মৃতি কেবলি দেয়ালে টানানো ছবি।
আমাদের ডাক্তার বাবা মাত্রই ৪৪ বছর বয়সে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আমার মা আমাদেরকে আগলে রেখেছেন নিজের জীবন দিয়ে, জাগতিক প্রয়োজনের কোনও কিছুতেই বাবার অভাব বুঝতে দেননি। কিন্তু বাবার জন্য বুকের মধ্যে শূন্যতা ছিল, আছে সব সময়ই। আমার বাবা আমাদের প্রত্যেক ভাইবোনের নাম রেখেছিলেন বড় ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে। নাম নিয়ে মায়ের সাথে নাকি ছোট খাটো মনোমালিন্যও হয়েছিল। কিন্তু বাবা তাঁর সন্তানদের জন্য সেরা নামটিই রাখতে চেয়েছিলেন।
পারিবারিক প্রথা হিসাবে বড় সন্তান হিসাবে আমার পোশাকি নাম রাখা হয়েছিল আমার দাদীর নামের সাথে মিলিয়ে। হাসিনা। বাবা রেখেছিলেন নামটি। নামটা আমার একদম পছন্দ না। কিশোরী বেলায় নাম নিয়ে মায়ের সাথে অনেক ঘ্যান ঘ্যান করেছি, নামটা বদলাতেও চেয়েছি, মাকে পটিয়ে রাজী করিয়েছিলাম যে এসএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের সময় এই নামটা বদলে অন্য একটা আধুনিক নাম নিব। মা মোটামুটি নিমরাজি হয়েছিলেন। আমার এসএসসি পরীক্ষার আগেই বড় শখ করে যিনি আমার নাম রেখেছিলেন তাঁর মায়ের নামে- আমার বাবা, পৃথিবী থেকে চলে গেলেন।
মা আর কোনভাবেই নাম বদলানোর কথায় কান দিলেন না। নামের বদলানোর ইতি বৃত্তান্ত এখানেই শেষ। নামটা রইল আমার সাথে লেগে সেই থেকে। ভালো লাগে না, আউটডেটেড, আনসফিসটিকেটেড, পুরনো পচা নাম। পাড়ায় ছেলেরা খেলাতে হেরে গিয়ে আমার নাম বিকৃত করে খেপায় -হাসিনা রে হাসিনা, তোর জ্বালায় বাঁচি না।
ইউনিভার্সিটির বন্ধুরা, সিনিয়র কয়েকজন ঝকঝকে বড়ভাই এমনকি কয়েকজন তরুণ শিক্ষক পর্যন্ত বলে থাকতেন, নাম শুনে তোমাকে কল্পনা করা মুশকিল! নামটি একজন পুরনো ভারিক্কী মহিলার কথা মনের মধ্যে আনে! ধরণী দ্বিধা হও! আমি মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে ম্লান হাসি- আমার বাবার রাখা নাম। নাম নিয়ে আমার এই ক্রমাগত কান্না কাটিতে কিছুটা অস্থির আর কিছুটা সান্ত্বনা দিয়ে আমাকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য আমার ছেলেমেয়েরা খুঁজে বের করলো তাদের মায়ের নামের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে ‘আকাশের সবচাইতে সুন্দর তারা’ – the beautiful star of the sky।
তবুও মনের খুঁতখুঁতানি যায় না। আউটডেটেড নামের সুন্দর অর্থের চাইতে আমার যে একটি ঝংকৃত আধুনিক নামের বড্ড ইচ্ছে ছিল গো। ইস! আমার সাহিত্য প্রেমিক বাবা রবি ঠাকুর না হোক নজরুল অথবা তলস্তয় বা শেকসপীয়র থেকেও আমার নাম রাখতে পারতেন! আচ্ছা না হয় নাই নিলেন ওইসব নাম। নিদেনপক্ষে তো ঘরোয়া নাম ‘আকাশ লীনা’ টাকেই পোশাকি নাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারতেন!
নাম কাহিনীর এখানেই সমাপ্তি হতে পারতো। কিন্তু বাদ সাধল শখের কারণে খোলা ফেসবুক। ছেলে যখন আমার ফেসবুক একাউনট খুলে দিলো, ‘মা, এই-ই সুযোগ, তোমার ডাক নামে এই একাউনট খোলো’ রাজী হলাম, ফেসবুক তো প্রফেশনাল কিছু নয়, কাজেই ডাক নামেই সই।
ডাক নামটা আমার প্রিয়- আকাশলীনা থেকে ছোট হয়ে এখন শুধু লীনা। আমার খুশীর অন্ত নাই। আধুনিক এই নামটি ফেসবুকের পাতায় জ্বলজ্বল করছে। নামের সৌন্দর্যে অন্ধ আমি বুঝি না, এটি একটি অপরিচিতি তৈরি করছে আমার জন্য। মাঝের কতোগুলো বছর ডাক নামের ফেসবুক কোন সমস্যা হচ্ছিলো না। কিন্তু ইদানীং অনেক ক্ষেত্রেই প্রফেশনাল কাজে ব্যবহার করতে হচ্ছে ফেসবুক, এবং প্রফেশনাল কাজে এর ব্যবহার বাড়ছেই। মানুষ হিসেবে আমার যে পরিচিতি তাতো আমার কাজের সূত্রেই। ব্যক্তিমানুষটি তো পেছনেই সবসময়। প্রফেশনাল পরিচিতি এক নামে আর ফেসবুক আরেক নামে, এই কারণে কনফিউশনও তৈরি হচ্ছে।
লোকে আমাকে চিনছে না। নিজের তৈরি করা আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে পড়েছি আমি। আমার পোশাকি নামটি বড় ভালবেসে আমার বাবা রেখেছিলেন। যিনি হয়তো ভেবেছিলেন কন্যাটি তাঁর আসলেই ‘হাসিনা’– আকাশের সবচেয়ে সুন্দর তারা’! যদিও বাস্তবে সে হয়তো খসে পরা ধুমকেতুর খণ্ডিত টুকরোমাত্র!
আধুনিক একটি নামের আকাংখায় জীবনের প্রায় চার দশক পার করে দিয়ে তাঁর বোকা মেয়েটি দিনশেষে বুঝতে পেরেছে বাবার রাখা নামটিকে বাদ দিলে সে আসলে অর্ধেক একটি মানুষ। পৃথিবীব্যাপী বাবা দিবসে সন্তানেরা বাবার জন্য কতকিছু করছে, আমার বাবা আমাদের ছেড়ে গেছেন অনেক আগেই।
আজ সকালে হঠাৎই মনে হল, এতো চমৎকার অর্থের একটি নাম, যেই নামের মাঝে আমার বাবা তাঁর মায়ের ছায়া দেখতে চেয়েছিলেন সেই নামটিকে পুরনো আর সেঁকেলে বলে শুধু অফিসে কেন সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করছি আমি! আমারই মূর্খতা!
বাবা, এখন থেকে তোমার দেয়া ‘লীনা হাসিনা হক’ এই নামটিই আবার লিখতে শুরু করলাম আমি। সবখানে। বাবা দিবসে এইটুকুই তোমার বোকা মেয়েটির ভালবাসা তোমার জন্য, বাবা। যেখানেই আছো, দেখো নাম নিয়ে ছিঁচকাঁদুনে তোমার মেয়েটি আজ মেয়ে থেকে মানুষে পরিণত হয়েছে, জীবনের সব সংঘাত পেরিয়ে নিজের একটি পরিচিতি তৈরি করতে পেরেছে, দেশে এবং বিদেশে তার অল্পপরিসরের কাজের জগতে লোকে তাকে এক নামে চেনে আর সেই পরিচিতির প্রথম ভিত্তি তোমারই আত্মজা হিসাবে তোমারই দেয়া নামে বাবা। তোমার বোকা মেয়েটির এই অবুঝপনা ক্ষমা করে দিয়ে তাকে নিয়ে একটুখানি অহংকারও করতে পারো হয়তো বাবা।
বন্ধুরা, আপনাদের ফ্রেন্ড লিস্টে শো করবে যখন নামটি তখন যেন অচেনা কেউ ভেবে ‘আনফ্রেন্ড’ করে দিয়েন না।