সোভিয়েত নারীর দেশে-১০

Lake Sevan 2সুপ্রীতি ধর: দেশে থাকতে আমার প্রতি দুই মাস অন্তর অন্তর জ্বর হতো, ভীষণ মাথাব্যথায় কষ্ট পেতাম। মাথায় বৃষ্টির ছাঁট লাগলে, বা গরমে বের হলে তো আর কথাই ছিল না। কিন্তু আরমেনিয়ায় আসার পর লক্ষ্য করলাম, জ্বরও নেই, মাথাব্যথাও নেই। সেই বয়সে অতশত ভাবিনি, কেন এই রোগগুলো আমায় কষ্ট দিচ্ছে না। কিন্তু এখন বুঝি, বায়ু এবং শব্দদূষণ, সেইসাথে রোদের খরতাপ কোনটাই ছিল না ইরেভানে। বাতাসের আর্দ্রতাও সহনশীল। তাছাড়া দেশের জন্য, মায়ের জন্য মন কেমন করা ছাড়া তেমন কোন কারণও নেই মন খারাপের।

ফলে স্বাভাবিকভাবেই মস্তিষ্ক ছিল সুস্থির, শান্ত।

ক্লাস, হোস্টেল, নিত্যনতুন রেসিপিতে রান্নার অভিজ্ঞতা, বিকেল হলেই বেরিয়ে পড়া, প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গা দেখা, পাহাড়-টিলা আবিষ্কার, বিশ্বমানের সিনেমা দেখা আর সপ্তাহান্তে কারও না কারও বাড়িতে নিমন্ত্রিত হয়ে যাওয়া, এককথায় ‘লাইফ ওয়াজ বিউটিফুল’।

সময়ের সাথে সাথে আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়, গাছের পাতা হলুদ-লাল-কমলা বর্ণ ধারণ করে অবশেষে ঝরে যেতে থাকে। আমরা মচমচ করে হাঁটি সেই ঝরা পাতার ওপর দিয়ে। মনে পড়ে হলিক্রস কলেজে ড্যাফোডিল কবিতা পড়াতে গিয়ে সিস্টার আমাদের পাতার মচমচে শব্দ শুনতে শিখিয়েছিলেন। আমি আবারও সেই শব্দ শুনতে পাই। পরিচিত শব্দ। জীবনের ধন যায় না ফেলা, ঝরা পাতার সাথে জীবনের রংও বদলে যায়।

ক্লাস থেকেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন প্রোগ্রামে, কখনও ব্যালে নাচ দেখতে, কখনও রক, জ্যাজ শুনতে, কখনও বিখ্যাত কম্পোজিটর আরাম ইলিচ খাচাতুরিয়ানের কনসার্টে।

মনের মধ্যে তখন দৌড়ঝাঁপ করে মিউজিক, শিল্প, নান্দনিকতা। দেশ আর দেশ থাকে না। ভৌগলিক সীমারেখা ভেঙে দেশ আমার ছড়িয়ে যায় বহুদেশে, বহু ভাগে। পিওতর ইলিচ চাইকোভস্কির অপেরা আর সিম্ফনির সাথেও আমার তখনই পরিচয় হয়। মাথার ভিতর ভেসে বেড়ায় সোয়ান লেকের অপ্সরিরা। কী জীবনে ছিলাম দেশে, কী জীবন পেলাম এখানে এসে!

শোলোখভের ‘তিখি দন’ তখন রুশ ভাষাতেই পড়তে পারছি। সাথে অবশ্য অভিধান থাকে। তারপরও পড়ি, এই আমাকেই তো দস্তয়েভস্কি পড়তে হবে, তলস্তয় পড়তে হবে, পুশকিনকে পড়তে হবে। তারই প্রাথমিক চেষ্টা পর্ব চলছে।

এইদেশে আসার নয় মাস পর আমাদেরকে পরীক্ষা শেষে পাঠানো হয় কায়িক শ্রমের কাজে, এটা বাধ্যতামূলক। টানা ২৪ দিন কাজ শেষ করার আগেই আমি ভর্তি হই হাসপাতালে পেটে ব্যথা নিয়ে। হাসপাতালের যত্ন, বিশেষ করে আমার কেবিনমেট আরমিনের মা যখন আমার মা হয়ে উঠলেন, তখন হাসপাতালে থাকাটাই জীবনের শ্রেষ্ঠতম সময় মনে হতে লাগলো। কিন্তু আরও ভাল কিছু জীবনে অপেক্ষা করে ছিল।

হাসপাতাল থেকে ফিরেই চলে গেলাম ‘দোম আদ্দিখা’ বা ‘রেস্ট হাউজ’ এ। আমাদের গন্তব্য ‘সিভান লেক’। যাওয়ার আগে ছোটখাটো একটু স্টাডিও করে নিলাম লেক সম্পর্কে। আনন্দ আর ধরে না। এ আমি কোথায় যাচ্ছি? সমুদ্র সমতলের মানুষ আমরা, যাচ্ছি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতর জায়গায় আরেক জলের আধারে।

আরমেনিয়া এবং পুরো ককেশাস অঞ্চলের সর্ববৃহৎ লেক এই সিভান। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ছয় হাজার ২০০ ফুট ওপরে এটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সুপেয় পানির লেক। এর এলাকা ৯৪০ কিলোমিটার পর্যণ্ত বিস্তৃত, দৈর্ঘ্য ৭৮ কিলোমিটার, প্রস্থ ৫৬ কিলোমিটার। এর সাথে যুক্ত ২৮টি নদী আর অসংখ্য ঝরণা।

Lake Sevan 3এই লেককে ঘিরে বহু মিথও প্রচলিত আছে। আরমেনিয়ার এক রাজকুমারি ছিলেন তামার নামে। উনি থাকতেন লেক ভানের আখতামার দ্বীপে। খুবই সাধারণ এক যুবককে তিনি ভালবেসেছিলেন। প্রতিরাতে সেই যুবক সাঁতরে তাঁর কাছে আসতো। আর রাজকুমারী আলো জ্বেলে ধরে রাখতেন। একদিন রাজকুমারির বাবা এটি জানতে পেরে মুষড়ে পড়েন। তিনি তখন মেয়ের কাছে গেলেন। রাজকুমারি তখন হাতে প্রদীপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন প্রেমিকের। রাগান্বিত বাবা প্রদীপটি ভেঙে ফেলেন। ফলে প্রেমিক যুবকটি মধ্য লেকে পথ হারিয়ে ফেলেন। কেবল তার চিৎকার শোনা যায়, আখ….তামার……….(ওহ, তামার)। প্রচলিত আছে, এরপর থেকেই ওই জায়গাটিতে মধ্যরাতে কেউ গেলে কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়, সেই থেকেই দ্বীপটির নামকরণ হয় ‘আখতামার’। ভাস্কর্যটি এখনও আছে। সেইসাথে গল্পটিও। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক গিয়ে গল্পটি শুনে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।

সিভান লেকের একেবারে ধার ঘেঁষে আমাদের রিসোর্ট হাউজ। এক রুমে দুজন করে থাকি, আমার রুমমেট ভেনিজুয়েলার আরমেলিন্দা। রুমমেট একজন হলেও সারাক্ষণ হাট বসে থাকে ওদের কোলাহলে। ওরা আবার প্রচণ্ড রকমের ফুর্তিবাজ, দলবদ্ধভাবে থাকতে পছন্দ করে। নাচ-গান ওদের শরীরে-মনে। দেখে মনে হয়, পৃথিবীর কোন দু:খ, কষ্ট ওদের জন্য তৈরি হয়নি।

সারাদিন ধরে বিচে ঘুরাঘুরি, পাহাড়ি শহর ঘুরে, ঐতিহাসিক, প্রাগৈতিহাসিক, প্রাচীন সব নিদর্শণ দেখে দেখে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে রাতের আকাশে জ্বলজ্বলে চাঁদের নিচে বসে আমরা আলুপোড়া খাই, ইকুয়েডরের রবার্তো গিটার হাতে তুলে নিলে এক স্বর্গীয় আবহ ঘিরে ধরে আমাদের, গোল হয়ে বসি আমরা বিচের বালুতেই, আগুন জ্বলছে কাঠখড় জ্বালিয়ে, একের পর এক গান চলছে, চাঁদ আকাশের এক কোণ থেকে উঠে যাচ্ছে মধ্য আকাশে তার সমস্ত আলোর বিকিরণ ঘটিয়ে, আমরা সকলেই সেখানেই আধো ঘুমে, আধো জেগে থাকি। রাত দুটা-তিনটার দিকে ঘরে যাওয়ার তাড়া দেয় কেউবা। মাতালের মতোন টলতে টলতে গা এলিয়ে দেই বিছানায়। কেবল রাতটাই আমাদের একান্ত নিজের।

ভোরবেলা চোখ না খুলেই এক অপূর্ব দৃশ্য দেখে মনটা ভরে যায়। দরজাটা খোলাই ছিল আমাদের তস্করের ভয় নেই বলে। এই ফাঁকে দরজা গলিয়ে ভেতরে চলে এসেছে মেঘেরা। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের মাঝখানে। হাত বাড়িয়ে ছুঁই মেঘ, ঠাণ্ডা পেলব মেঘ। নামে লেক হলেও সমুদ্রের মতোন শব্দ করে জানান দেয় নিজের অস্তিত্ব। কানে ভেসে আসে সেই শব্দ, জলের কলকল শব্দ। আহা, কী অপূর্ব সেই বাদন!

ইয়েমেনের ছেলে ছোটখাটো খালিদ আল মুসাননেফ ভাল গান গায়। ওর আরবী গানের একটা অক্ষরও বুঝি না। কিন্তু এইটুকু আমাদের হৃদয়ে ছুঁয়ে যায় যে, এই গানে প্রচণ্ড একটা যত্ন আছে কোন এক অদেখা প্রেমিকার প্রতি। মনটা নরম নরম লাগে তখন। Lake Sevanডোমিনিকান রিপাবলিকের (আজ আর নামটা মনে নেই) হারকিউলিস মার্কা ছেলেটা দূর থেকে দেখে আমাকে। আমি সেই তাকানোয় অন্য এক দৃষ্টি খুঁজে পাই। কিন্তু এক পা, দু পা করে পিছিয়ে থাকি এসব দৃষ্টি থেকে। বুঝি, সিভান লেক সবার ভিতরে আলোড়ন তুলেছে।

শিক্ষক ভিক্তোরিয়ার বয়স বেশি না। আমাদের দলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোর দায়িত্বে তিনি। কী অসাধারণ, কী মুগ্ধতা আর প্রেম তার চোখে-মুখে, যেন সিভান লেক এতোদিন তারই প্রতীক্ষায় ছিল। নিত্যনতুন অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে হাজির হন তিনি। আর আমরা তা লুফে নিয়ে জীবনটাকে কেবলই প্রসারিত করি। গান শিখি, গান গাই, গাইতে গাইতে কাঁদি, কাঁদতে কাঁদতে জীবনকে ভালবাসি, আরও বেশি বাঁচার স্বপ্ন দেখি। বুঝে যাই, প্রেম শুধু মানুষে মানুষেই নয়, প্রকৃতির সাথে প্রেমও মানুষকে অনেক দীর্ঘায়ু করে।

গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই এখানে, তবে আছে গরম একটা ভাব, মন্দ লাগে না। লেকের জল ঠাণ্ডা। সুশীতল জলে আমরা দাপিয়ে বেড়াই। লাতিনরা আমার সালোয়ার-কামিজে সাঁতার কাটতে দেখে অবাক হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই, আমি একেবারেই অপারগ এখানে।
শহরের বাইরে এতো উচ্চতায় এসে বেশ ভালোই জমিয়েছিলাম সংসার। রান্নার চিন্তা নেই, খাওয়ার চিন্তা নেই। ঘুম আর বেড়ানো। এভাবেই শেষ হয়ে আসে দিনগুলি। আমরা সকলে মিলে গান ধরি, ‘লাভান্দা, গোরনাইয়া লাভান্দা, স্কোলকা লেত প্রাশলো’………..এখনও কানে বাজে গানটি। কত বছর হয়ে গেল? ভুলেছি কি কিছু? সেই তো একই দীর্ঘশ্বাস, একই না পাওয়ার কষ্ট! আসলে জীবনে যা খুঁজি, যা পেতে চেয়েছি, তা অধরাই থেকে গেছে।

আমরা ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেই পরিচিত শহরের দিকে, ইরেভানের পথে। সেখানে থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবো একে-অপরের থেকে। ভাষা শিক্ষা কোর্স শেষে শুরু হবে আমার মূল পড়াশোনা। বিভিন্ন শহরে ছিটকে পড়বো আমরা। আমি যাচ্ছি লেনিনগ্রাদ (বর্তমানের সেন্ট পিটার্সবুর্গ)। ইচ্ছে ছিল মস্কো যাওয়ার। হয়নি। মন খারাপ হলেও তাই মেনে নিয়েছি। মেনে নেয়া আর মনে নেয়া, রবী ঠাকুরের এই লাইন শিখেই তো আমার বড় হওয়া, তাহলে আর অসুবিধা কোথায়! (চলবে)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.