টান টান দড়ির উপর সারাক্ষণ হাঁটি…

Urmi ATNইসরাত জাহান উর্মি: রাতে আমার আর নহলীর ঘরে দেড় টনি এসি চলে। পায়ের কাছে বক্স ফ্যান আর উপরের সিলিং ফ্যান তো আছেই। আমি একসাথে এসি আর বক্স ফ্যান চালাই না। এসি চালিয়ে ঘর ঠান্ডা করে ঘুমানোর আগ মুহূর্তে বক্স ফ্যান চালাই। তারপরও এই প্রচন্ড গরমে হাতের কাছেই এসির রিমোট রাখি, একটু পর-পরই টু টু। মানে অন করা অফ করা। সাব্বীর সারারাত তার ঘরে এসি চালিয়ে কাথা গায়ে দিয়ে ঘুমায়। সকাল বেলা ঐ ঘর বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে থাকে। আমি সারারাত একটানা এসি চালাতে পারি না, কোথায় যেন খচখচ করে, তাছাড়া বিদ্যুত বিলের কথাটাও মনে থাকে। গতবছরের আগের বছর যে বিল এসেছিল একমাসে, তা আমি প্রথম যখন চাকরীতে জয়েন করেছিলাম তার দ্বীগুনেরও বেশি।

কালরাতে পাখী বক্স ফ্যান আর এসি দুটোই চালিয়ে ঘর অন্ধকার ঘরে ড্রয়িং রুমে চলে গিয়েছিল টিভি দেখতে। এসির রিমোট তখন দেয়ালের গায়ে আটকানো, ঘুমন্ত নহলীও আমাকে ছাড়ছে না, ও জেগে যাবে বলে আমি পাখীকে শব্দ করে ডাকতেও পারছিলাম না। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল আমার। না খুব ঠান্ডায় নয়, একধরনের অস্বস্তিতে। এই অস্বস্তির শুরু অনেক দিন আগেই। নহলী যেবছর জন্মালো, সে বছরই প্রথম টের পেলাম এই অস্বস্তি।

বিদ্যুত চলে গেলে আইপিএস সাপোর্ট দ্যায় তিন/চার ঘন্টা। ততক্ষণে বিদ্যুত চলে আসে। বাসার সবাই অকাতরে ঘুমায়। আমি ঘর-বারান্দা করি। সাব্বীর বলে, পানি আর কারেন্ট না থাকলে তুমি মেন্টালি সিক হয়ে যাও। কথা মনে হয় মিথ্যা না। আমার খুব টেনশন হয়। ঢাকা শহরের আকাশমুখী বিল্ডিংগুলো দেখে, মাটির তলা থেকে ক্রমাগত পানি টেনে নেওয়ার খবরে, প্রতিদিন বুজে যাওয়া জলাভূমিগুলো দেখে, আমাদের বাড়ির যে পুকুরের পানি চৈত্রমাসের কঠিন খরাতেও শুকাতে দেখিনি-সেই পুকুর শুকানোর খবরে, চোখের সামনে আশে-পাশে তরতর করে ফ্ল্যাট বাড়ি উঠে যাওয়া দেখতে দেখতে, বৃষ্টির সময়ও ঘন বৃষ্টি না হওয়ায়–আমার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করে। গলা শুকিয়ে যায়। বিদ্যুত একসময় আসে, পানি আসে-কিন্তু আমার ভীতি কাটে না। সবাই হাসাহাসি করে, আমি কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারি না। ড্রামে-বালতিতে পানি ধরে রাখি,এসির জমা পানি দেই টবের গাছে। শুধু  মনে হয় আজ আসছে বটে, সেদিন তো খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন আর আসবে না বিদ্যুত, পাওয়া যাবে না জলের ধারা। কে আর ভাবছে এসব নিয়ে? মাটির তলা থেকে পানি টানতে টানতে ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে মাটি, যেদিন সবকিছু ভেঙে পড়বে, তখন কারোরই কিছু করার থাকবে না।

আমি তাই বিদ্যুত চলে গেলে ঘরে ঘুমন্ত স্বামী-সন্তানকে রেখে ঘর-বারান্দা করি। নানান চিন্তা মাথায় আসে। বাইরে তখন না ঘুমানো মানুষের দল জড়ো হয়েছে। তালের পাখায় বাতাস নিতে নিতে গল্প-গাছা করছে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ। আমাদের বাসার পরেই একটা এপার্টমেন্ট, তারপর নিম্নআয়ের মানুষের থাকার জন্য ঠিক বস্তি নয়, তার থেকে সামান্য উন্নত কিছু ঘর-বাড়ী, ওরা ঐসব ঘরেই থাকে। বিদ্যুত গেলে ১০ফুট বই ১০ফুট ঘরে টেকা যায় না, তাই রাত যতই হোক, ঘুমহীন মানুষগুলো বাইরে বেরিয়ে আসে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় বসে গল্প-গাছা করে। সঙ্গে থাকে কোলের শিশুটিও। হয়তো ঘুমন্ত, হয়তো কান্নারত। ওদের কথার টুকরো শব্দ ছিটকে আসে চারতলার ওপরে আমার রকিং চেয়ারের কাছে। ওদেরই মধ্যে কেউ ভোর সকালে আসবে আমার বাসায় কাজ করতে। রাতে ঘুমের ডির্স্টাব হওয়া বিরক্ত আমাকে সন্তপর্নে জাগিয়ে জানতে চাইবে আজ কি রান্না হবে। জেনে নিয়ে রাতে গরমে ঘুমাতে না পারা ক্লান্ত মানুষগুলো আমার আলো-বাতাসহীন হেসেলে ঢুকবে। রাধবে। রাতে খেতে বসে দেখবো কোন তরকারীতে লবণ বেশি হয়েছে, কোনটায় আবার ঝাল। আমি বিরক্ত হবো। আমার শাশুড়ী বলবেন, জানো না, গরীবরা লবণ বেশি খায়। আমি বা আমরা একবারও বিবেচনা করবো না, এরাও মানুষ। একটু বিশ্রাম, একটু আরাম ওদের শরীর-মনও চায়। মনোযোগ আমাদের মতো ওদেরও ব্যাহত হতে পারে মাঝে-মধ্যে।

আমি ঘর-বারান্দা করি। ও ঘর থেকে সাব্বীর রেগে ওঠে, বলে, তুমি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছো, আইপিএস ফুল সাপোর্ট দিচ্ছে, পাখা চলছে তোমার ঘরে দুইটা, তুমি ঘুমাও না ক্যান?

ঠিক। আমার সব চলছে। আমি পুরো সুবিধা পাচ্ছি। কিন্তু তবু কেন ভয়? খচখচানী?তবু কেন অস্থির পায়চারী? কে আমাকে জাগিয়ে রাখে?

খচখচানী ঐ না ঘুমানো মানুষগুলোর জন্য। আজ ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করছে বটে। একদিন যদি দলবেঁধে উঠে আসে চারতলায়। যদি চুলের মুঠি ধরে আমার, বলে, আমরা ঘুমাতে পারি না, তুই কেন আরামে ঘুমাবি? যদি আমার বাচ্চাটাকে টেনে তুলে বলে, আমাদের বাচ্চা কি তোর বাচ্চার চেয়ে কম আদরের? ওরা ঘুমাতে পারে না, কাঁদে, তোর বাচ্চা কেন আরামে ঘুমাবে? আমরাই তো তোদের জন্য সব আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করি…

আমি কাউকে বুঝাতে পারি না, একা একা কখনও ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকতে হয় সবাইকে নিয়ে। একা সুখে বাচতে শেখানো এই সমাজকে একদিন ঠিকই দাম দিতে হবে। রাস্তার ঐ মানুষগুলো না ঘুমালে, একদিন ঠিকই ঘুমহীনতার শোধ নেবে। সেই শোধ খুব মধুর কিছু হবে না।

তাই এসি ঘরে শুয়েও আমি ঘামতে থাকি, আমার গলা শুকিয়ে আসে..

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.