বিজ্ঞান কি মেয়েদের শত্রু?

Sheetal
সাদিয়া শীতল

সাদিয়া আফরোজ শীতল : কিছুদিন আগে প্রথম আলোতে বিজ্ঞানের গবেষণায় নারীর অভাব নিয়ে একটি লেখা পড়ছিলাম, লেখাটার নিচে প্রথম কমেন্ট হলো-

“ছেলেদের মস্তিষ্ক মেয়েদের থেকে বড়, তাই মেয়েরা  বিজ্ঞানের গবেষণায় ভালো না…”
আমিও কমেন্টের উত্তরে বললাম-
হাতি, তিমি মাছ, ডলফিনের মস্তিষ্ক মানুষের থেকে অনেক বড়, তো আপনার মতে হাতি আর তিমি মাছ সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানী?” 
মস্তিষ্ক শুধু বড় থাকলেই হয় না তা ব্যবহার করতেও জানতে হয়
জ্ঞান-বিজ্ঞানে মেয়েরা ছেলেদের থেকে পিছিয়ে থাকার কারণ কিন্তু সামাজিক। পৃথিবীর যেকোনো দেশেই মেয়েদের আর ছেলেদের আলাদা করে বড় করা হয়। বেশীরভাগ মেয়ে তো পড়াশুনা শেষ করারই তো সুযোগ পায় না। তারপর ঘরের বেশিরভাগ কাজের দায়িত্ব মেয়েদের। জ্ঞান-বিজ্ঞানে অবদান রাখতে গেলে গবেষণায় প্রচুর সময় দিতে হয়, যা বিভিন্ন সামাজিক কারণে মেয়েরা দিতে পারে না।
তারপর অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েদের অবদানকে ছোট করে দেখা হয়, যথাযথ মূল্য দেয়া হয় না- যেমন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন প্রথম ডিএনএ এর গঠন আবিস্কার করেছিলেন, অথচ তিনি বেঁচে থাকতে তাকে নোবেল প্রাইজ দেয়াই হয়নি।
হেনরিয়েটা লেভিটের  কথা খুব কম মানুষ জানে অথচ তার আবিস্কৃত পদ্ধতি দিয়েই প্রথম পৃথিবীর সাথে  অন্যান্য গালাক্সীর দূরত্ব পরিমাপ করা হয়। সামাজিক অনেক বাধা অতিক্রম করে যে মেয়েরা বিজ্ঞানের কত ক্ষেত্রে কত অবদান রেখেছেন ভাবলে আমার খুবই অবাক লাগে আর গর্ব হয়।যেমন ধরুন আমার সাবজেক্ট কম্পিউটার সাইন্সের কথা। কম্পিউটার সাইন্সে বিখ্যাত নারীর অভাব কিন্তু এই বিষয়ে গবেষণা করা অনেক প্রতিষ্ঠিত নারী আছেন যাদের কথা মানুষ বেশি জানে না।
আমি আমেরিকা আসার আগে ড. গ্রেইস হপারের কথা জানতামই না।  কম্পিউটার সাইন্সে তার অবদান অস্বিকার করার উপায় নেই। উনি প্রথম কম্পাইলার আবিস্কার করেন যা কিনা কম্পিউটার প্রোগ্রামকে মেশিন কোডে রুপান্তরিত করবে যাতে কম্পিউটার তা বুঝতে পারে। কম্পিউটার  সবকিছু বোঝে ০-১ দিয়ে, কম্পাইলার ইংলিশে লিখা কম্পিউটার প্রোগ্রামকে ০-১ এ রুপান্তরিত করে। চিন্তা করে দেখুন ০-১ দিয়ে সব কিছু লিখতে হলে কম্পিউটারে কাজ করা কতই না কঠিন হত!

তারপর শুনুন এডা লাভলেসের কথা, ওনাকে বলা হয় প্রথম প্রোগ্রামার। এডা কম্পিউটার প্রোগ্রামের কথা চিন্তা করেছিলেন সেই ১৮৫০ সালের আগে, এমন সময় যখন কিনা কম্পিউটারই আবিস্কার হয়নি!

এডা লাভলেসআরেকজন বিখ্যাত নারী হলেন ড. ফ্রান্সিস অ্যালেন যিনি প্রথম মহিলা টিউরিঙ পুরস্কার পেয়েছেন, যা কম্পিউটার সাইন্সে নোবেল পুরস্কারের সমান।

ড. রাদিয়া পার্লমানকে বলা হয় “মাদার অব দা ইন্টারনেট”।  তার  আবিস্কৃত “স্পানিং ট্রি প্রোটোকল”  ইন্টারনেটের যে কোনো দুইটি অংশের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করেতে ব্যবহার করা হয়।

গত বছর আরেকজন নারী টিউরিঙ পুরস্কার পেলেন ড. শাফি গোল্ডওয়াসার, ক্রিপ্টোগ্রাফিতে অবদানের জন্য। ড. শাফির গবেষনার জন্যই আমরা  ইন্টারনেটে নিরাপদে টাকা আদান-প্রদান করতে পারি, যে কেউ চাইলেই ইন্টারনেট থেকে টাকা চুরি করতে পারবে না। আরো অনেক নারী বিজ্ঞানীর কথা জানতে পারবেন এখানে

ড. শাফি গোল্ডওয়াসারএত এত ট্যালেন্ট নারী থাকার পরও যখন মানুষ বলে “মেয়েদের বুদ্ধি কম,” “মেয়েদের জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং না,” এর পরও যখন মানুষ মেয়েসন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত না করে অল্পবয়সে বিয়ের কথা ভাবে কি যে রাগ লাগে আমার! আমাদের দেশে ওনাদের মত নোবেল/টিউরিঙ পুরস্কার পাওয়া নারী এখনো না থেকে থাকে তার দায়ভার আমাদের সবার। আমরাই এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারিনি যেখানে মেয়েরা গবেষণা করতে পারে, বিজ্ঞানে অবদান রাখতে পারে।আজ থেকে আপনার পরিবারের বা চেনা পরিচিত মেয়ে শিশুটিকে শুধু একজন নারী হিসাবে চিন্তা না করে ভবিষ্যত বিজ্ঞানী হিসাবে চিন্তা করুন, ভেবে দেখুন আজ তাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে হয়ত আপনি গোটা মানবজাতিকে এক যুগান্তকারী আবিস্কার থেকে বঞ্চিত করছেন!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.