সুপ্রীতি ধর: আরমেনিয়ান খাবারের গুণে খুব সহজেই ভাতের অভ্যাস থেকে একটু একটু করে অনভ্যস্ত হচ্ছিলাম। একেবারে যখন হাঁপিয়ে উঠতাম, তখন ঘরে ডাল-চাল ফুটিয়ে খেয়ে নিতাম টমেটো-ক্যাপসিকাম দিয়ে ডিম ভেজে। ডিম ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা একটা খাবার। তাই কেবল যে খেতাম, তাই নয়। মুখে-চুলে, ওমলেট-মামলেট, ডিম কারি সবই খাওয়া হতো। বলা চলে, হোস্টেল লাইফে ডিম ছাড়া আমাদের দিনই চলতো না। মাত্র ৯০ কোপেকে ১০টা ডিম, এক রুবলও লাগতো না।
বৃত্তি পেতাম প্রথম বছর ৮০ রুবল করে। খেয়ে-ঘুরে-সিনেমা দেখেও শেষ হতো না এই টাকা। মাস শেষে হাতে থাকতো ৩০ থেকে ৩৫ রুপি। সেগুলো দিয়ে সোয়েটার-জামা-কাপড় কিনতাম। কিন্তু সোভিয়েত আমলে খুব একটা চয়েজ থাকতো না দোকানপাটে। অনেককিছু না পেলেও কষ্ট হতো না, মানিয়ে নিয়েছিলাম অন্য প্রাপ্তিগুলো দিয়ে।
আমরা যে হোস্টেলে থাকতাম, সেখানে ছেলেমেয়েরা একই ভবনে থাকলেও বাইরের কেউ ‘অ্যালাউড’ ছিল না। একেবারেই কেউ এলে তাকে অনুমতি নিয়ে আসতে হতো। গেইট কিপারের সাথে মাহবুব ভাইয়ের ছিল পুরনো দোস্তি। তাই দেখতাম, সে অনায়াসেই উঠে আসতো আমাদের রুমে। কিন্তু একদিন ঘটলো এক ঘটনা। আমি অবাক হয়ে গেলাম। বিশাল একটা ধাক্কাও খেলাম। দেখি, দুইটা স্থানীয় মেয়ে নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে, তাদের পেছনে ইয়েমেনের দুটি ছেলে। যে ছেলেদের দেখলেই নির্দোষ মনে হয়, সেই ছেলেরা কিনা এমন উদ্ভট সাজের মেয়েদের সাথে। এদের মধ্যে একটা ছেলে আবার গালিগালাজ করে বের করে দিচ্ছে মেয়েদের। মুখ থেকে ওদের ভুর ভুর করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। উঠতে উঠতেই শুনলাম, মেয়েরা টাকার বিনিময়ে এসেছিল এখানে। ২০ রুবল দেবে বলে লোভ দেখিয়ে এনে একসাথে চারজন থেকেছে, কিন্তু টাকার অংক বাড়ায়নি। মেয়েরা প্রতিবাদ করেছিল বলে ওদের মারধর করে ছেলেগুলো। এই ঘটনার পর যতদিন ছিলাম আমি ইরেভানে, একটা কথাও বলিনি আমি। ঘেন্না লেগেছে। সত্যি বলছি। তাছাড়া যে ইরেভানে এসে আমি কোনদিন কোন মেয়েকে কাঁদতে দেখিনি, এমনকি কোন বাসা থেকেও ঝগড়ার আওয়াজ পাইনি, সেখানে আজ দুটি মেয়েকে এমন অবস্থায় বেরিয়ে যেতে দেখে আমার ক্যালকুলেশনে ভুল হয়ে যাচ্ছিল বার বার।
ইয়েমেনের প্রচুর ছাত্রছাত্রী পড়তো আমাদের সাথে। এর মধ্যে দুই বোনও ছিল। সালা ছিল খুবই হাসিখুশি মিশুক, আর তার ছোট বোনটা ছিল ঠিক তার বিপরীত। সালা প্রায় প্রতিরাতেই প্যাসেজে ডিসকোটেক এর আয়োজন করতো। আরবী গানও যে এমন সমধুর, রিদমিক, ধূমধাড়াক্কা হতে পারে, ওখানে না গেলে আমার জানাই হতো না। ফুল ভলিউমে মিউজিক ছেড়ে দিয়ে ছেলেরা নাচতো। প্রথম দিকে আমরা শুধুই দর্শকমাত্র থাকলেও, বেশিদিন থাকিনি। উন্মাতাল মিউজিক বসিয়ে রাখতে জানে না কাউকে। আমাকেও নাচিয়ে ছেড়েছে। লজ্জার প্রাথমিক ধাক্কাটা কেটে যাওয়ার পর আর একদিনও মিস হয়নি। নেপালি ছেলেরা আসতো গিটার নিয়ে। ওরা গাইতো। ভাষা না বুঝলেও মনে হতো, খুব কাছের কোন এক ভাষাতেই ওরা গাইছে। সেই যে ওদের বিখ্যাত গান, মুছু মুছু হাসি………আমরাও গলা মেলাতাম ওদের সাথে।
ভারতীয়রা মনে হয় সিনেমার গান ছাড়া আর কিছুই গাইতে পারতো না। আমি বা নাসির গান না গাইলেও চেষ্টার ত্রুটি থাকতো না। সেখানেই দেখলাম মাহবুব ভাইয়ের কেরামতি। লাতিন আমেরিকান ছাত্রদের একটা মিউজিক অ্যানসাম্বাল ছিল। মাহবুব ভাইয়ের হেঁড়ে গলায় গানের সাথে ওরা অপূর্ব বাদনের দ্যোতনা তুলতো। এতেই উৎরে যেতো মাহবুব ভাই। চুলগুলো নাড়িয়ে নাড়িয়ে গাইতো, ইস্কুল খুইলা ছে রে মওলা, ইস্কুল খুইলাছে, আর দর্শকরা হাততালিতে ফেটে পড়তো।
কিছুদিন পরই ছিল নিজ দেশের ওপর উপস্থাপনা। দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া পোস্টার আর সাকুরার নিচ থেকে কেনা পাটের শো-পিসগুলো দিয়ে বেশ প্রদর্শনী করে ফেললাম। ক্যাসেট বাজিয়ে নাচও নাচতে হলো আমাকে। তবে সবচেয়ে বেশি ভাল করেছিলাম, সিনডারেলা, নাটকটি। আমাকে দেয়া হয়েছিল সিনডারেলার সৎ বোনের চরিত্র। টিচাররা মহাখুশি আমার বাঁকা হাসি দেখে।
দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিল। গ্রীষ্মের আরামদায়ক আবহাওয়ার পর বরফ পড়তে শুরু করলো। কিন্তু তাপমাত্রা খুব একটা হিমাংকের নিচে নামলো না। এতো ভালবাসার রং আবহাওয়ায়, না দেখলে, না মাখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
ইয়েমেনের সালা প্রেম করে বসলো কাশ্মিরের সানির সাথে। এ নিয়ে দুই বোনের মারামারিও দেখতে হয় আমাদের। আর সানি এদিকে সিগারেটের পর সিগারেট ফুঁকে ফুসফুস ঝাঁঝরা করে ফেলেছে। কিন্তু সালা পাগল। দিন নেই, রাত নেই, সালা দরজায় পড়ে থাকে সানির। আমার দরজার পাশেরটাই সানির হওয়াতে সব ঘটতে থাকে চোখের সামনে। প্রেমের আসলে কোন দেশ নেই, একই রকম। সালাকে দেখে এটাই মনে হয় আমার।
আরেকটা প্রেম হলো জর্ডানের নিঝারের সাথে সিরিয়ার নাহলার। কিন্তু নিঝারের সামর্থ্য ছিল না মেয়েকে সোনার বেল্ট দেয়ার। প্রেমটা ভেঙ্গে যায় এই একটা কারণেই। তবে একটা প্রেম তখন বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল সবার মাঝে।
ডোমেনিকান রিপাবলিকের এক ছেলের সাথে স্থানীয় এক আরমেনিয় মেয়ের প্রেম হয়। সেই কী ধুন্দুমার প্রেম। মেয়েটি প্রায়ই চলে আসতো হোস্টেলে। বেশ সুন্দর, ছিমছাম, লাজুক স্বভাবের। ঠিক ইউরোপীয় মনে হয় না। কিন্তু বাদ সাধলো মেয়েটির পরিবার। একদিন দেখি ছেলেটি রক্তাক্ত অবস্থায় হোস্টেলে ফিরছে। এরপর আবার পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। ছেলেটি আবার ফেরত আসে। মেয়েটি ছিল অন্ত:সত্বা। পরিবার জোর করে ওর গর্ভপাত ঘটায়। কাহিনী এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হয়নি।
এক বছর ভাষা কোর্স শেষে আমি যখন তৎকালীন লেনিনগ্রাদ (বর্তমানের সেন্ট পিটার্সবুর্গ) আসি, ছেলেটিও আসে ডাক্তারি পড়তে। বেশ কয়েকমাস পরে একদিন রাস্তায় দেখা। ওর পাশে সেই মেয়েটি। আবারও পেট ভারী তার। দুজনের মুখেই তখন তৃপ্তির হাসি। ছেলেটি জানায়, মেয়েটা পালিয়ে এসেছে ইরেভান থেকে। আর তারা বিয়েও করে ফেলেছে। মনটা ভাল হয়ে যায় এ খবরে।
আমাদের সাথে ছিল পাঁচজন পাকিস্তানি মেয়ে। এরা সব ছিল বালুচ। পোশাক-আশাকে দারিদ্র্য ছিল, কিন্তু মন ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বলীয়ান। আর ভীষণরকমের মিশুক। দিনের পর দিন ওদের সাথে থেকে চলে যায় আমার জীবন। প্রায়ই ক্লাস শেষে হাঁটতে বের হতাম। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যেতাম। এভাবেই চেনা হয়ে গিয়েছিল শহরটা। মাঝে মাঝে ক্লান্তি লাগলে রাস্তার পাথরের ওপর বসে পড়তাম। একদিন এক বাবুশকা (দাদী) খুব কষে ধমক লাগালেন আমাদের। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কারণ জানতে চাইলে উনি বললেন, ‘তোমরা পাথরের ওপর বসছো কেন? মা হতে চাও না জীবনে? পাথরের ঠাণ্ডা লেগে তো সমস্যা হয়ে যাবে’। তাইতো, এমন কথা তো কখনও ভাবিনি। সেই থেকে পাথরের ওপর বসা আমাদের বন্ধ হয়ে যায়। মা হওয়া নিয়ে কথা!
তখন পেরেস্ত্রোইকা, গ্লাসনস্ত শব্দগুলো বেশ আলোচিত। যার সাথে কথা হয়, জিজ্ঞ্যেস করি, কি মনে করছেন তারা এ নিয়ে? বেশিরভাগেরই কিছু নেই বলার। দু’একজন অতি উৎসাহী মানুষ বলেন যে, তারা চান উন্মুক্ত সীমান্ত, বাইরের জগতটা দেখতে চান, ভাল-মন্দ থাকতে চান। তবে একটু বেশি বয়সীরা ভাবেন যে, ভালোই তো আছি, নতুন কিছুর দরকার কেন?
আরমেনিয়ানদের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের প্রায় সবার একটা না একটা দাঁত সোনা দিয়ে বাঁধানো। দেখতে ভীষণ অড লাগতো। এটা নাকি তারা শখ করেই করেন। তবে ওইদেশে দাঁত মাজার পেস্টের যে হাল, তাতে দাঁত নষ্ট হতে সময় লাগার কথা না। আমার ভাগ্য ভালো, মা আমাকে নিয়মিতভাবে পেস্ট পাঠাতেন। সেই পেস্ট মস্কো ঘুরে পার্সেলে করে হাতে আসতো আমার।
আজ এতোবছর পর স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে দেখলাম, অনেক কিছু হারিয়ে গেছে দৃশ্যপট থেকে। অক্টোবর থেকে মে মাস, কখনও পড়াশোনা, কখনও এক্সকারশান, কখনও বা বেড়াতে যাওয়া এদিক-সেদিক, এভাবেই কেটে যায়। গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাদেরকে কাজে পাঠানো হয়, এটা বাধ্যতামূলক, স্বেচ্ছাশ্রম যাকে বলে। সবাইকেই করতে হয় যারা এখানে থেকে যায়।
তো, জীবনের যে মানুষ আমি জলটা ভরে খাইনি, সেই কিনা নির্মাণ কারখানায় কাজ নিলাম। পাহাড় কাটা থেকে শুরু করে পাথরভর্তি (বিটুমিন) বালতির পর বালতি টানতাম। সিনেমায় দেখা শ্রমিকদের পোশাক বানিয়ে নিলাম। মাথায় স্কার্ফ। কেন যে ছবি তুলে রাখিনি তখন, আফসোস হয় মনে পড়লেই। মধ্যাহ্ন বিরতিতে মাটির অস্থায়ী ঘরে বসে রুম থেকে নিয়ে যাওয়া খাবার খাই সবাই মিলেমিশে। মাঝে মাঝে ওখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা দুধ নিয়ে আসেন, মাখন নিয়ে আসেন, ছানা নিয়ে আসেন। আমরা তাও খাই।
২৪দিন টানা কাজ করার পর একদিন পেটে ব্যথা শুরু হয়। সাথে সাথেই জায়গা হয় হাসপাতালে। এপেন্ডিসাইটিস ভেবেছিলেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু তা নয়, ভারী জিনিস টানার কারণেই এই ব্যথা।
এই প্রথম সোভিয়েত কোন হাসপাতালে আমার থাকা। প্রবাস জীবনে এরপরে আরও অনেকবার আমার যাওয়া হবে। তাই হয়তো প্রথম দিন থেকেই আমার ভাল লাগে এখানকার পরিবেশ। বিশেষ করে আরমিনের মতোন একজন বন্ধু যদি জুটে যায়, আর তার মা যদি আমার মা হয়ে যান, তাহলে কি আর দু:খ থাকে? আরমিনের বয়স তখন ১৬, অ্যাপেন্ডিসাইটিস এর অপারেশন হয়েছে তার। এশিয়ান আমাকে দেখেই আরমিনের ভাল লেগে যায়। তাই খাবার নিয়ে আমার কোন দু:শ্চিন্তাই থাকে না। আমার সহপাঠিরা হাসপাতালে দেখতে এসে তো অবাক। দিব্যি সুস্থ মানুষ আমি গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিচ্ছি, বিনিময়ে যদিও কিছু ইনজেকশনের ব্যথা সহ্য করতে হচ্ছে।
এরপর অনেকদিন পর্যন্ত আরমিনের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। এমনকি লেনিনগ্রাদে আসার পরও আমার নতুন মা আমাকে জুতা থেকে শুরু করে কাপড়-জামা অনেককিছুই পাঠিয়েছেন। দুই মাকে নিয়ে আমার জীবন বিদেশের মাটিতে বসেও আনন্দপূর্ণ হয়েই থাকে।
যতবেশি অবজ্ঞা আমি পেয়েছি জীবনে, ভালবাসা পেয়েছি তার চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি। আমার বিদেশ জীবন এর জ্বলজ্বলে প্রমাণ।
আরেকটা কথা এখানে না বললেই না। সেই ছোটবেলা থেকে গায়ের রং নিয়ে হতাশাগ্রস্ত ছিলাম। কালো শব্দটা শুনতে শুনতে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমার জীবনে কিছুই হবে না এই এক রংয়ের জন্য। কিন্তু আরমেনিয়ায় এসে শুনলাম, ‘জেভুশকা সিমপাতিচনাইয়া’, এর মানে হচ্ছে ‘মেয়েটি আকর্ষণীয়া’। আসলেই কী তাই? আমি আকর্ষণীয়া? কি বলে এসব? তাহলে বাসার মানুষগুলোর কেউ কোনদিন একথা বলেনি কেন? (চলবে)