মেয়েদের আর পেছনে তাকানোর প্রয়োজন নেই

Noorjahanপ্রথম আলো: শামিয়ানা টানানো। বিভিন্ন রঙের বেলুন উড়ছে। লাল, নীল রঙিন ঝালরে সাজানো হয়েছে জায়গাটি। একটি সোফায় বসে আছেন নূরজাহান বেগম। ফুল, নানা উপহারসামগ্রী নিয়ে এসে কেউ পা ছুঁয়ে সালাম করছেন। আবার কেউ নূরজাহান বেগমকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন। তাঁরা সবাই এসেছেন সাপ্তাহিক বেগম-এর সম্পাদক নূরজাহান বেগমকে ৮৯তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে।

বয়সের ভারে ক্লান্ত নারী সাংবাদিকতার জীবন্ত কিংবদন্তি নূরজাহান বেগম। ১৯৪৭ সালে নারীদের লেখা ও ছবি দিয়ে প্রকাশিত নারীবিষয়ক বেগম পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর অবিরামভাবে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। সেই পত্রিকাটির বয়সও এখন ৬৮ বছর।

নূরজাহান বেগমকে শুভেচ্ছা জানাতে আসা বেশির ভাগ নারীই বেগম-এর লেখিকা। জীবনে প্রথম ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে যে নারীরা পত্রিকাটিকে ভালোবেসেছিলেন, তাঁরা এখনো পত্রিকাটিকে নিজের পত্রিকা হিসেবেই মনে করেন। আর নূরজাহান বেগম, তিনি তো একান্ত আপনজন, ভালোবাসার মানুষ।

নূরজাহান বেগমের জন্মদিন এর আগে ততটা ঘটা করে পালন করা হয়নি। আজ বুধবার পুরান ঢাকার নারিন্দার শরত্ গুপ্ত রোডের ৩৮/৩৯ নম্বর বাড়ির নিচতলায় বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন খান ও তাঁর স্বামী গৌরব ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কর্ণধার ফজলুর রহমান খান জন্মদিনের আয়োজন করেন। এই দম্পতির মেয়ে নানির জন্য অনেক বড় একটি কেক ও শাড়ি পাঠিয়েছে। সেই শাড়ি পরেই মোমবাতি নিভিয়ে নূরজাহান বেগম কেক কাটেন। অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণার পাশাপাশি নূরজাহান বেগমের প্রিয়জনেরা গান গেয়ে মাতিয়ে রাখেন সবাইকে।

হুইল চেয়ার ছাড়া এখন আর চলাফেরা করতে পারেন না নূরজাহান বেগম। চোখেও তেমন একটা দেখেন না। কিন্তু জন্মদিনে বেলুন লাগবে, বড় মেয়ের কাছে এ আবদার আগেই করে রেখেছিলেন। 

গণমাধ্যমের কর্মীরা যখন ছবি তুলছিলেন, তখনো বারবার জানতে চাচ্ছিলেন সব ঠিক আছে কি না। ছবিটা ভালো হলো কি না, তা নিয়েও ছিল চিন্তা। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ছোট মেয়ে রিনা ইয়াসমিনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

শরীরের শক্তি কমে এলেও নূরজাহান বেগমের কণ্ঠের দৃঢ়তা একই আছে। তিনি বলেন, ‘মেয়েদের আর পেছনের দিকে তাকানোর প্রয়োজন নেই। পথ এখন প্রশস্ত। আপনারা এগিয়ে চলুন। পুরুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলুন।’

১৯২৫ সালের ৪ জুন জন্ম নূরজাহান বেগমের। তখনকার যে অবস্থা ছিল তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায় নূরজাহান বেগমের কণ্ঠে। তিনি বলেন, ‘আমি অন্ধকার যুগে জন্মগ্রহণ করেছি। যে যুগে মেয়েদের অবরুদ্ধ করে রাখা হতো। সেই ধরনের পরিবেশে মুসলমান মেয়েরা প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করেছে। হিন্দু মেয়েরাও তখন সাপ্তাহিক বের করার কথা চিন্তা করতে পারেনি। তাই বেগম অনেক বড় একটি গৌরবের বিষয়। ফেলে আসা দিনগুলো অনেক কঠিন ছিল। আমরা অনেক অবদান রেখেছি। দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করে গেছি। নারীদের শুধু আন্দোলন করলেই হবে না, উপলব্ধি করতে হবে। পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে আনতে হবে। তরুণ প্রজন্ম বিভ্রান্ত না হয়ে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে এলে দুই-তিন বছরে দেশের চেহারা পাল্টে যাবে।’

বেলা ১১টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত চলে জন্মদিনের আনুষ্ঠানিকতা। তারপর কয়েকজন মিলে হুইল চেয়ারে করে নূরজাহান বেগমকে দোলাতায় তাঁর ঘরে পৌঁছে দেন। খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেমেয়েরা এখনো সম্পত্তিতে সমান অধিকার পাচ্ছে না। যৌতুক, বহুবিবাহসহ বিভিন্ন নারী নির্যাতন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। নারীর ক্ষমতায়ন হলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। গ্রামীণ নারীদের ধর্মান্ধতা থেকে বের করে আনতে হবে।’

নূরজাহান বেগমের বাবা মাসিক সওগাত পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। নিজের পছন্দে বিয়ে করা দৈনিক ইত্তেফাকের ‘কচি-কাঁচার আসর’ নামের ছোটদের পাতার সম্পাদনাকারী রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই) মারা গেছেন অনেক আগেই। আশপাশের পরিচিতদের মধ্যেও দু-একজন ছাড়া সবাই মারা গেছেন। মেয়েরা যার যার সংসার নিয়ে দূরে থাকেন। ইট ও পলেস্তারা খসে পড়া বিশাল বাড়িটিতে নূরজাহান বেগমের একমাত্র সঙ্গী রংপুরের মধ্যবয়সী নারী মরিয়ম ও ১৫ বছরের কিশোরী শরিফা। এই দুজনই খাওয়ানো, দেখভাল করার সব দায়িত্ব পালন করেন। আছে দুটি বিড়াল আর একটি কুকুর।

(প্রথম আলো থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.